শুক্রবার, ২২ অক্টোবর, ২০২১ ০০:০০ টা

জল-স্থল-অন্তরিক্ষে বাংলাদেশ আজ অনুকরণীয়

মোস্তাফা জব্বার

জল-স্থল-অন্তরিক্ষে বাংলাদেশ আজ অনুকরণীয়

বিশ্বে স্পেস সোসাইটিতে ৫৭তম স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণকারী দেশ বাংলাদেশ। মহাকাশ জয় আমাদের অহংকার। বাঙালির মহাকাশ জয়ের স্বপ্ন পূরণের ঐতিহাসিক দিনটি ছিল ২০১৮ সালের ১২ মে। ওই দিন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে উৎক্ষেপণ করা হয় দেশের প্রথম যোগাযোগ উপগ্রহ বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১। ইতিহাস সৃষ্টিকারী ঘটনাটি ঘটেছিল বাংলাদেশ সময় রাত ২টা ১৫ মিনিটে। মহাকাশ বিজয়ের এ মাহেন্দ্রক্ষণটি ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের পথ বেয়ে অর্জিত হয়েছে। এ অর্জন একজন ভিশনারি রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার দূরদৃষ্টি চিন্তার সোনালি ফসল। এরই ধারাবাহিকতায় জল-স্থল-অন্তরিক্ষে বাংলাদেশ আজ অনুকরণীয়।

মহাকাশে বাংলাদেশের এ অস্তিত্ব জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠায় চলমান ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের সংগ্রাম এগিয়ে নেওয়ার এক উজ্জ্বল সোপান। টেলিকম প্রযুক্তির অপার সম্ভাবনা কাজে লাগাতে যুদ্ধের ধ্বংসস্তুপের ওপর দাঁড়িয়েও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দূরদৃষ্টিসম্পন্ন বলিষ্ঠ নেতৃত্বের কারণে ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়ন (আইটিইউ) ও ইউপিইউর সদস্যপদ লাভ করে। ১৯৭৫ সালের ১৪ জুন বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র উদ্বোধনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু বহির্বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশের আধুনিক টেলিযোগাযোগব্যবস্থার সূচনা করেন। তাঁরই সুযোগ্য উত্তরসূরি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’-এর রূপকল্প বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে বাংলাদেশকে ৫৭তম স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণকারী গর্বিত দেশ হিসেবে তুলে ধরেন। মহাশূন্যে বাংলাদেশের প্রথম স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের লক্ষ্য স্থির করেন। ২০০৯ সালের মে মাসে বিটিআরসির একজন কমিশনারকে আহ্‌বায়ক করে স্যাটেলাইট কমিটি নামে একটি কমিটি গঠন করে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের প্রস্তুতিমূলক কার্যাদি শুরু করা হয়। ২০১৩ সালের ৩১ মার্চ পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের স্পেস পার্টনারশিপ ইন্টারন্যাশনালের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এরই ফলে মহাকাশে অরবিটাল স্লটের জন্য আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ সংস্থা-আইটিওতে আবেদন দাখিল করা হয়। উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পরামর্শক প্রতিষ্ঠান স্পেস পার্টনারশিপ ইন্টারন্য্যাশনাল-এসপিআই নিয়োগ, ইন্টারস্পুটনিক থেকে ১১৯ দশমিক ১ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ অরবিটাল স্লট লিজ গ্রহণ এবং আন্তর্জাতিক উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে স্যাটেলাইট নির্মাণ প্রতিষ্ঠান থ্যালেস এলিনিয়া স্পেস ফ্রান্সের সঙ্গে ১১ নভেম্বর ২০১৫-এ স্যাটেলাইট নির্মাণ ও উৎক্ষেপণের জন্য চুক্তি স্বাক্ষর সম্পন্নের মধ্য দিয়ে প্রকল্পের মূল কার্যাদি শুরু হয়। প্রকল্পে প্রাক্কলিত ব্যয় প্রায় ২৭৬৫.৬৬ কোটি টাকা, এর মধ্যে চুক্তিমূল্য প্রায় ১৯০৮.৭৫ কোটি টাকা। মহাশূন্যে উৎক্ষেপিত ৩ হাজার ৭০০ কিলোগ্রাম ওজনের বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ নিরবচ্ছিন্নভাবে ১৫ বছরের অধিক সময় মহাশূন্যে থেকে সেবা দিয়ে যাবে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের মাধ্যমে টেলিযোগাযোগ সুবিধার ব্যাপক প্রসার ঘটছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো সমগ্র বাংলাদেশের স্থল ও জলসীমায় নিরবচ্ছিন্নভাবে টেলিযোগাযোগ ও সম্প্রচারের নিশ্চয়তা, বর্তমানে বিদেশি স্যাটেলাইটের ভাড়া বাবদ প্রদেয় বার্ষিক ১৪ মিলিয়ন ডলার সাশ্রয়, ট্রান্সপন্ডার লিজের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা আয়, টেলিযোগাযোগ ও সম্প্রচার সেবার পাশাপাশি টেলিমেডিসিন, ডিজিটাল লার্নিং, ডিজিটাল এডুকেশন, ডিটিএইচ প্রভৃতি সেবা প্রদান করা। প্রাকৃতিক দুর্যোগে সাবমেরিন অথবা টেরিস্ট্রিয়াল অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হলে সারা দেশে নিরবচ্ছিন্নভাবে ইন্টারনেট যোগাযোগ সুবিধা প্রদান, স্যাটেলাইটের বিভিন্ন সেবার লাইসেন্স ফি ও স্পেকট্রাম চার্জ বাবদ সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধি, স্যাটেলাইট টেকনোলজি এবং সেবা প্রসারের মাধ্যমে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১-এর ১৪টি সি ব্যান্ড ও ২৬টি কিউ ব্যান্ড ট্রান্সপন্ডার- মোট ৪০টি ট্রান্সপন্ডার রয়েছে। ৪০টি ট্রান্সপন্ডার দ্বারা বাংলাদেশ, সার্কভুক্ত দেশ, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন ও ‘স্তান’ভুক্ত দেশগুলোয় টেলিযোগাযোগ সুবিধা প্রদান করা যাবে। এরই মধ্যে ফিলিপাইন ও নেপালে স্যাটেলাইট সেবা বিক্রির প্রক্রিয়া চলছে।

বর্তমানে বিটিভি, বিটিভি ওয়ার্ল্ডসহ দেশের সব টেলিভিশন চ্যানেল বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১-এর মাধ্যমে অনুষ্ঠান সম্প্রচার করছে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের মাধ্যমে বিটিভি ও বিটিভি ওয়ার্ল্ড সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ ও আফ্রিকায় অনুষ্ঠান সম্প্রচার করছে। এ স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ইন্টারনেট সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান, ভি-স্যাট ও রেডিও স্টেশনগুলো কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। এতে প্রতি বছর বিপুল অর্থ সাশ্রয় হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১-এর মিশন লাইফ ১৫ বছর এবং ডিজাইন লাইফ ১৮ বছর। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও মানুষের স্বচ্ছন্দের বিষয়টি সামনে রেখে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ২০২৩ সালের মধ্যে দ্বিতীয় স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ উৎক্ষেপণের লক্ষ্য নির্ধারণ করে কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নে সরকার সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় মহাকাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১-এর পর বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ উৎক্ষেপণের অভিযাত্রা শুরু হয়েছে। নির্বাচনী ইশতেহার অনুযায়ী ২০২৩ সালের মধ্যে এর কার্যক্রম চালুর চেষ্টা অব্যাহত আছে। দেশ প্রথম স্যাটেলাইটের মাধ্যমে স্যাটেলাইটনির্ভর সম্প্রচার ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে স্বনির্ভরতা অর্জন করে। অন্যান্য প্রকৃতি ও ধরনের স্যাটেলাইট প্রযুক্তিতে স্বনির্ভরতা অর্জনের জন্য বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ উৎক্ষেপণ একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত।

ডিজিটাল বাংলাদেশের জন্য ডিজিটাল সংযুক্তির সক্ষমতা তৈরির জন্য বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ জাতীয় জীবনের জন্য আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্জন হতে যাচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ আরও একটি নতুন যুগে পদার্পণ করবে। এর ওপর ভর করে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বে জ্ঞানভিত্তিক ডিজিটাল সাম্য সমাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম আরও বেগবান ও অর্থবহ হবে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১-এর ওপর নির্ভর করে আমরা চর, দ্বীপসহ দুর্গম অঞ্চলের ডিজিটাল কানেকটিভিটি তৈরি করছি। আমরা বেতার ও টিভি চ্যানেলসমূহের সম্প্রচার অব্যাহত রাখছি। দেশের দুর্গম এলাকায় টেলিমেডিসিন কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের দিকনির্দেশনায় নিবিড় পর্যালোচনা করে আমরা দেখেছি একটি স্যাটেলাইট দিয়ে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রয়োজন মেটানো যাবে না। স্যাটেলাইটে এমন ব্যবস্থা রাখতে হবে যাতে যোগাযোগব্যবস্থার বাইরে উপগ্রহের মাধ্যমে নতুন সেবা দিতে পারি। আমরা ইতিমধ্যে তৃতীয় সাবমেরিন ক্যাবল সংযোগের কার্যক্রম শুরু করেছি। নির্বাচনী ইশতেহার অনুযায়ী সেটিও আমাদের ওপর অর্পিত একটি বড় কাজ। এরই মধ্যে বাংলাদেশ প্রযুক্তির লেটেস্ট ভার্সন ফাইভ-জি ট্রায়াল সম্পন্ন করেছে এবং ফাইভ-জি পলিসি চূড়ান্ত ও ইকোসিস্টেম তৈরির কাজ হচ্ছে। এ বছরের মধ্যেই পরীক্ষামূলকভাবে ফাইভ-জি সেবা চালুর কার্যক্রম চলছে।

বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ হতে যাচ্ছে ভূপৃষ্ঠ পর্যবেক্ষণ স্যাটেলাইট। ইংরেজিতে এ স্যাটেলাইটের নাম দেওয়া হয়েছে আর্থ অবজারভেশন (ইও)। কারিগরি সহায়তার কারণে এবারের স্যাটেলাইটটি হতে যাচ্ছে জি টু জি পদ্ধতির। অর্থাৎ আরেকটি দেশের সহায়তা নিয়ে স্যাটেলাইটটি উৎক্ষেপণ করবে বাংলাদেশ। কিন্তু নিয়ন্ত্রণ থাকবে সম্পূর্ণ বাংলাদেশের হাতে।

মহাকাশে বঙ্গবন্ধু, জয় বাংলা নিজস্ব স্পেস দেখে আমাদের গর্ব হয়। দেশ স্বাধীন না হলে আমরা মহাকাশ বিজয়ী হতে পারতাম না। মহাকাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ বাংলাদেশের সক্ষমতা অনেক দূর বাড়িয়ে দিয়েছে।

উল্লেখ্য, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে সরকার গঠনের পর মহাকাশে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের চূড়ান্ত প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য, ২০০১ থেকে ২০০৮ সালে সরকারসমূহ সে কর্মসূচির কবর রচনা করে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট দেশের সার্বিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে এবং এর মাধ্যমে নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের জন্য সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এ স্যাটেলাইটের মাধ্যমে আমাদের সন্তানরা মহাকাশবিজ্ঞান, পরমাণু প্রযুক্তি, সমুদ্রবিজ্ঞান ও বিজ্ঞানের অন্যান্য ক্ষেত্র, সংস্কৃতি ও প্রকৃতি সম্পর্কে জানতে পারছে। যা দেশের উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন। সজীব ওয়াজেদ ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র গাজীপুর এবং সজীব ওয়াজেদ ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র বেতবুনিয়া থেকে আমাদের সন্তানরাই উদ্বোধনের দিন থেকে আজ পর্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে স্যাটেলাইটটি পরিচালনা করছে।

লেখক : ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী।

সর্বশেষ খবর