শনিবার, ৩০ অক্টোবর, ২০২১ ০০:০০ টা

অ্যাডভোকেট আবদুল বাসেত মজুমদার স্মরণে

হুসেইন ফজলুল বারী

অ্যাডভোকেট আবদুল বাসেত মজুমদার স্মরণে

বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ফাউন্ডেশনের বৃত্তির জন্য চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত হয়ে আমি প্রথম আবদুল বাসেত মজুমদারের নাম শুনি। তখন আমি হাইস্কুলের ছাত্র। আরও জানলাম ঘোর মেঘবরণ সুঠাম মানুষটি হাই কোর্টের  একজন দুঁদে আইনজীবী। তিনি আবার এ মহতী ফাউন্ডেশনের সভাপতি। তিনি শুধু আমাদের ডাকাতিয়া-বিধৌত জনপদের সন্তানই নন, দক্ষিণ কুমিল্লার মশহুর বিদ্যাপীঠ হরিশ্চর ইউনিয়ন হাইস্কুলের প্রথম ব্যাচের ছাত্র। অনেক আগে সেই ভাষা আন্দোলনের বছর ১৯৫২ সালে তিনি মেট্রিকুলেশন পাস করেছেন শুনে কিশোর আমি খুদে আঙুলে হিসাব কষতাম, সেই কবে তিনি স্কুলের ছাত্র ছিলেন! একদিন আলী আকবর স্যার আমাদের বললেন, বাসেত সাহেব যেমন তেমন উকিল নন, তিনি সুপ্রিম কোর্টের দুই তারকাযুক্ত সিনিয়র আইনজীবী। সুপ্রিম কোর্ট বারের এই মহিরুহ-তারকা মানুষটিই আমার দেখা প্রথম রক্তমাংসের উকিল। এর আগে গাঁয়ের দোকানে ভাজা জিলাপির গন্ধে ঢোক গিলে তন্ময় হয়ে উকিল-আদালতের সাদাকালো ছায়াচিত্র দেখেছি নাটকে-সিনেমায়। উকিল হওয়ার কোনো লক্ষ্য না থাকলেও কিছুটা বড় হয়ে আমিও আইন পড়েছি। খানিকটা কি অনিচ্ছায়? নাকি কিশোর বয়সে দেখা আইনজীবীর প্রতি গোপন কোনো ভালোলাগা কাজ করছিল তা আজ নিশ্চিত করে বলতে পারব না। পড়ে-না পড়ে আইন স্নাতক হয়ে বন্ধুদের দেখাদেখি ওকালতির সনদও নিয়েছি। পুরো কাগজের ওকালতির সনদেও দেখি কিশোর বয়সে বৃত্তির কাগজে দেখা সেই আবদুল বাসেত মজুমদার স্যারের বাঁকাচাঁদের স্বাক্ষর। আইনজীবী-সনদ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে তিনি এ সই করেছেন। এ সনদ হাতে পেয়ে কী করব স্থির করতে পারছিলাম না। কিছুদিন বিশুদ্ধ বেকার থেকে একসময় উকিলবেশে বিখ্যাত মজুমদার স্যারের চেম্বারে যাতায়াত শুরু করলাম।

একটু রাত হলে অনেক বিখ্যাত মানুষকে দেখতাম বড় বড় গাড়ি থেকে বিড়াল-পায়ে নেমে এসে নিঃশব্দে চেম্বারে হাজির হতেন। ডাকসাইটে এসব মানুষের ছবি আর কর্ম আমি পত্রিকায় দেখেছি। ইদানীং মামলার জালে আটকে পড়ে তাদের চোখে মরা মাছের মতো উ™£ন্ত দৃষ্টি। তারা করুণ স্বরে আইনি সেবা দেওয়ার জন্য স্যারকে অনুনয়-বিনয় করতেন। তিনি নিশ্চুপ হয়ে বিচারপ্রার্থীদের অনুযোগ শুনতেন আর মাঝেমধ্যে টুকটাক প্রশ্ন করতেন। তাঁর ইশারা পেয়ে তর্জনী, মধ্যমা আর অনামিকায় হরেক রকম পাথুরে আংটি আঁটা ঝানু সহকারী মুখ কাঁচুমাচু করে নীল ওকালতনামা এগিয়ে দিতেন। চকিতেই বিষণ্ণ আসামিদের মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠত। স্যারও অন্যমনস্ক হয়ে খসখস করে স্বাক্ষর করে সব মক্কেলকে আশ্বস্ত করতেন। লক্ষ্য করলাম, মার্ডার কেস, কোয়াশমেন্ট, জামিন এসব স্যারের কাছে ডালভাত! আর শুনানির দিন আদালতে নাছোড়বান্দা হয়ে তিনি সাবমিশন দিতেন প্রদীপ্ত কণ্ঠে, আন্তরিক ভঙ্গিতে। প্রায় সময়ই রুল, স্টে, কোয়াশড, বেল এসব মঞ্জুর হতো আমাদের অনুকূলে। আদেশ মনঃপূত হোক না হোক তিনি বিচারককে সবিনয়ে ‘মাচ অবলাইজড’ বলে আরেকটা শুনানির জন্য দৌড়াতেন। কোনো আদেশে সংক্ষুুব্ধ হয়ে আমরা জুনিয়ররা সবাই হয়তো বিচারককে ‘একচক্ষু-হরিণ’ গণ্যে মনে মনে শাপশাপান্ত করতাম। অভিজ্ঞ আইনজীবী কোনো দিকে ভ্রæক্ষেপ না করে আপিলের কয়েকটি জরুরি পয়েন্ট বলার মধ্যেই হয়তো আরেক উকিল এসে হাজির হতেন। উটকো অনুরোধেও তিনি হন্তদন্ত হয়ে নতুন বেঞ্চে গিয়ে নতুন মামলার শুনানি করতেন। উদীয়মান আইনজীবীদের কাছে তিনি ছিলেন ত্রাতার মতো। ক্লান্ত অপরাহ্ণে ফিরতি পথে মুহুর্মুহু সালামের প্রত্যুত্তর দিতে দিতে ঘর্মাক্ত হয়ে দোতলার চেম্বারে হাজির হতেন। ঠান্ডা পানিতে তৃষ্ণা মিটিয়ে মুহুরিকে হাঁক দিতেন- টাই দে, নতুন কোট দে। একটা মিটিংয়ে যাব, দেরি হয়ে গেল রে। বলা বাহুল্য, বারের নেতৃত্বের বাইরে জাতীয় রাজনীতিতেও তাঁর উজ্জ্বল পদচারণ ছিল। তিনি আমৃত্যু আইনের শাসন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা আর গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে গভীরভাবে বিশ্বাসী ছিলেন। মজুমদার স্যারের সঙ্গে অল্প কিছুদিন কাজ করে মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রে কিছুটা সময় পার করে মফস্বলের দেওয়ানি আদালতে জজিয়তি শুরু করলাম। চামড়ায় বাঁধানো ফৌজদারি কার্যবিধি, ডি এল আর আর সি ডবলু এন আর লর্ড মেকলের খুনখারাবির ধারাপাত-পেনাল কোড একদম ভুলে গিয়ে লাল সালুতে ঢাকা এজলাসে বসে কপট গাম্ভীর্যে ন্যায়বিচার তালাশ করি। নোয়াখালী-চাটগাঁর আদালতে হন্যে হয়ে নথি-বালাম-খতিয়ান ঘাঁটতে ঘাঁটতে মাঝেমধ্যে আত্মবিস্মৃতও হতাম। লাজুক অবসরে কোনো ছায়াচ্ছন্ন বেলকনিতে বসে গন্ধলেবু-মাখা চায়ে চুমুক দিয়ে ঢাকায় ফেলে আসা জীবনের জন্য আক্ষেপও কি হতো? স্বল্পায়ু আইনজীবী জীবনকে মনে হতো কোনো সুদূর অতীতের ছবি। এরপর স্যারের সঙ্গে কালে-ভদ্রে দেখা হয়েছে হাই কোর্টের বারান্দায়, কোনো পুনর্মিলনীতে, দাওয়াতে বা সামাজিক-রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে। তিনি আন্তরিক ভঙ্গিতে সালামের জবাব দিয়ে কুশলাদি জিজ্ঞাসা করেছেন। শেভনিং বৃত্তি নিয়ে বিলেত যাচ্ছি শুনে শুভাশিস জানিয়েছিলেন।

একদিন অপরাহ্ণে তিনি আমার ছোট্ট খাসকামরায় হাজির হলে বেশ অবাকই হলাম। বিলেত-ফেরত আমি তখন কিশোরগঞ্জের ম্যাজিস্ট্রেসির স্যাঁতসেঁতে চেম্বারে বসে মন খারাপ করে কী একটা আদেশ টাইপ করছিলাম। স্যারের সঙ্গে ছিলেন আরও বেশ কিছু আইনজীবী। তাঁর পা ছুঁয়ে সালাম করলে তিনি বললেন, তুমি তো জজ! শেষে অতিশয়োক্তি করে হাজির সবাইকে লক্ষ্য করে আমাকে দেখিয়ে আঞ্চলিক ভাষায় বললেন, ‘আমার জুনিয়র ছিল অল্প কিছুদিন, বিলাতের সব ডিগ্রি নিয়া ফেলছে!’ আমি লজ্জায় আধোমুখ হয়ে বললাম, স্যার, আমি সব সময় জুনিয়র। কী খাবেন জিজ্ঞাসা করতেই বললেন, ‘ধন্যবাদ, এখানকার বারে একটা কাজে আইলাম। তুমি এখানে আছ খবর পেয়ে শুধু তোমারে দেখতে আইলাম। বারে তোমার সুনাম শুনে ভালো লাগল। আজকে চলি। সময় নাই। সন্ধ্যার আগে বানানী পৌঁছতে হবে। বাসায় আসিও।’

বিভিন্ন সময় স্যারের বাসায় গেলে স্যার হেসে বলতেন, ‘সবাই কাজ নিয়া আসে। তুমি আসো আমারে দেখতে।’ আমি ব্যস্ত স্যারকে এড়িয়ে বরং তাঁর পুত্র অ্যাডভোকেট সাঈদ আহমেদ রাজা ভাইয়ের সঙ্গে আলাপচারিতায় মগ্ন হতাম। আরেক বার চেম্বারে গেলাম তাঁর আইনজীবী জীবনের ৫০ বছর পূর্তির কথা শুনে। সেদিন হরিশ্চর হাইস্কুলের বেশ কয়েকজন সফল সাবেক ছাত্রকে পেয়ে রাশভারি মানুষটি মনের অর্গল খুলে তাঁর সংগ্রামমুখর জীবনের অনেক কথা বললেন। তাঁর বাবা-মায়ের কথা আর স্কুল-জীবন বিশেষত তাঁর প্রিয় শিক্ষক মকবুল আহমদ-বিএসসি বিটি স্যারের কথা স্মরণ করে বেশ স্মৃতিকাতর হয়ে পড়লেন। ক্লান্ত মানুষটি শেষে বললেন, ‘এলাকায় কিছু সামাজিক কাজ করছি, একটা হাসপাতাল করব। যত দিন বাঁচি আরও কাজ করতে চাই।’

আফসোস, আর কোনো দিনই এরূপ একজন আপাদমস্তক আইনজীবীর জলদগম্ভীর কণ্ঠ শুনতে পাব না। তিনি মহাকালে মিশে গেছেন, তবে তাঁর কর্ম যুগযুগান্তরে বেঁচে থাকবে। পরম করুণাময়ের অনিঃশেষ রহমতের ছায়া প্রয়াত স্যারকে নিয়ত ঢেকে রাখুক।

লেখক : যুক্তরাজ্যের শেফিল্ড ইউনিভার্সিটির পিএইচডি গবেষক।

সর্বশেষ খবর