সোমবার, ৮ নভেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

বাংলাদেশ ভারত সম্পর্ক ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি

মেজর আখতার (অব.)

বাংলাদেশ ভারত সম্পর্ক ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি

আমাদের চারপাশের প্রায় সবটা জুড়েই ভারত এবং আমরা মনে করি আমাদের হিতৈষী প্রতিবেশী। আমরা প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই ভারত উপমহাদেশের সমৃদ্ধ বাংলা ছিলাম। মহাভারতের অংশ হিসেবে বাংলার ধর্ম, সংস্কৃতি, আচার-আচরণ প্রায় অভিন্ন ছিল। আজকের বাংলাদেশ একটি অখন্ড স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র নামে জনপদ এক দিনে হয়নি। এর যাত্রা শুরু হয় বিভিন্ন প্রাচীন জনপদ থেকে যার মধ্যে অন্যতম ষোলোটি জনপদের কথা জানা যায়। এই ষোলোটি জনপদের মধ্যে অন্যতম হলো- বঙ্গ, পুণ্ড্র, বরেন্দ্র, সমতট, চন্দ্রদ্বীপ, গৌড়, শ্রীহট্ট ও হরিকেল। (১) বর্তমান বৃহত্তর ঢাকা, ময়মনসিংহ ও ফরিদপুর নিয়ে ছিল বঙ্গ। (২) পুণ্ড্র (সবচেয়ে প্রাচীনতম জনপদ) : বৃহত্তর বগুড়া (মহাস্থানগড়), রাজশাহী, রংপুর ও দিনাজপুর অঞ্চল। রাজধানী ছিল পুণ্ড্রনগর যা বর্তমানে মহাস্থানগড়। (৩) বরেন্দ্র : রাজশাহী বিভাগের উত্তর-পশ্চিমাংশ, বগুড়ার পশ্চিমাংশ, রংপুর ও দিনাজপুরের কিছু অংশ। (৪) সমতট : বৃহত্তর কুমিল্লা ও বৃহত্তর নোয়াখালী। রাজধানী ছিল বড়কামতা যা বর্তমানে কুমিল্লার দেবিদ্বার থানায় অবস্থিত। (৫) চন্দ্রদ্বীপ : বরিশাল, পটুয়াখালী, বাগেরহাট, খুলনা ও গোপালগঞ্জ। (৬) গৌড় : মালদহ, মুর্শিদাবাদ, বীরভূম, বর্ধমান ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ। রাজধানী ছিল কর্ণসুবর্ণ। (৭) শ্রীহট্ট : সিলেট অঞ্চল। (৮) হরিকেল : পার্বত্য সিলেট, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম।

বাঙালি জাতির উৎপত্তি : ইতিহাস ঘাঁটলে সমগ্র বাঙালি তথা বাংলাদেশি জাতিগোষ্ঠীকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যথা- প্রাক আর্য (অনার্য) এবং আর্য জনগোষ্ঠী। আর্যপূর্ব জনগোষ্ঠী মূলত নেগ্রিটো, অস্ট্রিক, দ্রাবিড় ও ভোটচীনীয় এই চারটি শাখায় বিভক্ত ছিল। নিগ্রোদের মতো দেহযুক্ত এক আদিম জাতি এ দেশে বাস করত। এরাই ভিল, সাঁওতাল, মুন্ডা প্রভৃতি উপজাতির পূর্ব পুরুষ। অস্ট্রিক জাতি থেকে বাঙালি তথা বাংলাদেশি জাতির প্রধান অংশ গড়ে উঠেছে বলে মনে করা হয়। কেউ কেউ তাদের ‘নিষাদ জাতি’ বলে মনে করেন। প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে নেগ্রিটোদের উৎখাত করে ইন্দোচীন থেকে আসাম হয়ে বাংলায় প্রবেশ করে অস্ট্রিক জাতি। অস্ট্রিক জাতির সময়কালে বা কিছু পরে দ্রাবিড় জাতি এদেশে আসে। তারা সভ্যতায় উন্নত বলে অস্ট্রিক জাতিকে গ্রাস করে। পরবর্তীতে অস্ট্রিক-দ্রাবিড় জাতির সঙ্গে মঙ্গোলীয় বা ভোটচীনীয় জাতির সংমিশ্রণ গড়ে ওঠে। গারো, ত্রিপুরা, চাকমা ইত্যাদি মঙ্গোলয়েড। অস্ট্রিক-দ্রাবিড় জনগোষ্ঠীর মিশ্রণে যে প্রবাহের সৃষ্টি তার সঙ্গে আর্য জাতি যুক্ত হয়ে গড়ে উঠেছে বাঙালি জাতি। আর্যরা সনাতন ধর্মের ছিল। তাদের আদি নিবাস ছিল ইউরাল পর্বতের দক্ষিণে বর্তমান মধ্য এশিয়া-ইরানে। অষ্টম শতাব্দীতে আরবীয়রা ইসলাম ধর্ম প্রচার ও বাণিজ্যের মাধ্যমে বাঙালি জাতির সঙ্গে সংমিশ্রিত হয়। নৃতাত্ত্বিকভাবে বাংলাদেশের মানুষ প্রধানত আদি অস্ট্রেলীয় নরগোষ্ঠীয়ভুক্ত।

গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাবলি : প্রাক-বৌদ্ধ যুগ তথা খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ থেকে পঞ্চম শতাব্দীর মধ্যে রচিত উপনিষদ ‘ঐতরেয় আরণক’-এ সর্বপ্রথম ‘বঙ্গ’ শব্দের উল্লেখ পাওয়া যায়। মুঘল সম্রাট আকবরের সভাকবি আবুল ফজল তাঁর ‘আইন-ই-আকবরি’ গ্রন্থে সর্বপ্রথম দেশবাচক বাংলা শব্দের ব্যবহার করেন। তিনি ‘বাংলা’ নামের উৎপত্তি সম্পর্কে দেখান, এদেশের প্রাচীন নাম ‘বঙ্গ’ এর সঙ্গে বাঁধ বা জমির সীমানাসূচক ‘আল’ যোগে ‘বাংলা’ শব্দ গঠিত হয়। চতুর্থ বা পঞ্চম শতাব্দীর ধ্রুপদি সংস্কৃত ভাষার কবি কালিদাসের গ্রন্থে ‘বঙ্গ’ জনপদের উল্লেখ পাওয়া যায়। খ্রিস্টপূর্ব ৪০০ বছর আগে রচিত পাণিনি গ্রন্থে প্রথম ‘গৌড়’র উল্লেখ পাওয়া যায়।

প্রাচীন শিলালিপিতে ‘বিক্রমপুর’ ও ‘নাব্য’ নামে বঙ্গের দুটি অঞ্চলের উল্লেখ পাওয়া যায়। বতর্মান ফরিদপুর বরিশাল ও পটুয়াখালী নিম্ন জলাভূমি ছিল ‘নাব্যের’ অন্তর্ভুক্ত। প্রাগৈতিহাসিক যুগ হলো পাথরের যুগ। পাথরের পরবর্তী যুগ ধাতুর যুগ। বিশ্বসভ্যতার যাত্রা শুরু হয় খ্রিস্টপূর্ব ৫০০০ অব্দে। মৌর্যদের আমল তথা খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে বাংলাকে সাম্রাজ্যভুক্ত করা হয় ও স্বাধীন বাংলা রাজ্যের গোড়াপত্তন হয়। গুপ্তোত্তর সপ্তম শতাব্দীতে বাংলার প্রথম স্বাধীন সম্রাট ছিল শশাঙ্ক। ১৩৩৮-১৩৪৯ সময়কালে সোনারগাঁয়ে রাজধানী স্থাপন করে বাংলার স্বাধীনতার সূচনা করেন ফখরুদ্দীন মুবারক শাহ। ১৩৮৯-১৪১০ সন পর্যন্ত ক্ষমতাসীন সুলতান গিয়াসউদ্দিন আযম শাহ বাংলায় প্রথম নৌবাহিনী গড়ে তোলেন।

প্রাচীন বাংলাদেশের বিভিন্ন সময়কালের শাসকদের সংক্ষিপ্ত বিবরণ তুলে ধরা হলো।

আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট : আলেকজান্ডার ছিলেন ম্যাসিডনের রাজা ফিলিপসের পুত্র। জাতিতে ছিলেন আর্য গ্রিক। বাল্যকালে তার শিক্ষিক ছিলেন বিখ্যাত গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটল। খ্রিস্টপূর্ব ৩৩৫ খ্রিস্টাব্দে তার বাবা ফিলিপসের মৃত্যু হলে তিনি সিংহাসনে বসেন। আলেকজান্ডার খ্রিস্টপূর্ব ৩২৭ অব্দে ভারতবর্ষ আক্রমণ করেন। খ্রিস্টপূর্ব ৩২৫ অব্দে ব্যাবিলনে অর্থাৎ বর্তমান ইরাকে তাঁর মৃত্যু হয়। আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য উপমহাদেশে গ্রিক প্রাধান্যের অবসান ঘটান।

চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য : ভারতীয় উপমহাদেশীয় প্রথম সাম্রাজ্যের নাম মৌর্য সাম্রাজ্য। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য খ্রিস্টপূর্ব ৩২১ অব্দে মগদের সিংহাসনে বসেন। তিনি ভারতের প্রথম সম্রাট, পাটালিপুত্র বর্তমান ভারতের বিহারে ছিল তাঁর রাজধানী। চাণক্য ছিল তাঁর প্রধানমন্ত্রী। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য আলেকজান্ডারের সেনাপতি সেলুউকাসকে পরাজিত করে ভারত উপমহাদেশ হতে গ্রিকদের বিতাড়িত করেন।

সম্রাট অশোক : মৌর্য বংশের তৃতীয় সম্রাট ছিলেন অশোক। উত্তর বাংলায় মৌর্য শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় তাঁর রাজত্বকালে। মহাস্থানগড়ে সম্রাট অশোকের একটি শিলালিপি পাওয়া গেছে। তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো ‘কলিঙ্গের যুদ্ধ’। এই যুদ্ধে কলিঙ্গরাজ সম্পূর্ণ পরাজিত হয় এবং প্রায় ১ লাখ লোক মারা যায়। এই যুদ্ধের রক্তস্রোতের ভয়াবহতা তার মনে গভীর বেদনার সৃষ্টি করে। তখন তিনি তার কৃতকর্মের জন্য অনুশোচিত হয়ে বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষা নেন। তার চেষ্টায় বৌদ্ধধর্ম বিশ্বধর্মের মর্যাদা পায়।

গুপ্তশাসন : গুপ্ত যুগকে প্রাচীন ভারতীয় উপমহাদেশের স্বর্ণযুগ বলা হয়। এ সময় সাহিত্য, বিজ্ঞান ও শিল্পে খুবই উন্নতি হয়। প্রথম চন্দ্রগুপ্ত ভারতে গুপ্ত বংশের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ৩২০ সালে পাটালিপুরের সিংহাসনে আরোহণ করেন। সমুদ্রগুপ্ত চন্দ্রগুপ্তের মৃত্যুর পর পাটালিপুত্রের (পাটনা) সিংহাসনে বসেন। তিনি ছিলেন গুপ্ত বংশের শ্রেষ্ঠ রাজা। তাকে প্রাচীন ভারতের ‘নেপোলিয়ন’ বলা হয়। তাঁর সময়ে সমতট ছাড়া বাংলার অন্য সব জনপদ গুপ্ত সাম্রাজ্যের অধীনে আসে। পু-্রনগর ছিল বাংলার রাজধানী। দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত সমুদ্রগুপ্তের পর পাটালিপুত্রের (পাটনা) সিংহাসনে বসেন। তার উপাধি ছিল ‘বিক্রমাদিত্য’। অনেক প্রতিভাবান ও গুণীব্যক্তি তার দরবারে সমবেত হয়েছিলেন। এদের মধ্যে প্রধান নয়জনকে ‘নবরত্ন’ বলা হতো। তার সভায় আর্যভট্ট ও বরাহমিহির ছিলেন বিখ্যাত বিজ্ঞানী। আর্যভট্ট পৃথিবীর আহ্নিক ও বার্ষিক গতি নির্ণয় করেন। আর্যভট্টের গ্রন্থ ‘আর্য সিদ্ধান্ত’। বরাহমিহির ছিলেন একজন বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ। তার বিখ্যাত গ্রন্থ হলো ‘বৃহৎ সংহিতা’। ষষ্ঠ শতকের প্রথম দিকে মধ্য এশিয়ার দুর্র্ধর্ষ যাযাবর জাতি হুনদের আক্রমণে গুপ্তসাম্রাজ্য টুকরা টুকরা হয়ে।

গৌড় শাসন : গুপ্ত রাজাদের অধীনে বড় কোনো অঞ্চলের শাসনকর্তাকে বলা হয় ‘মহাসামন্ত’। শশাঙ্ক ছিলেন গুপ্তরাজা মহাসেন গুপ্তের একজন মহাসামন্ত। শশাঙ্ক গৌড়ের রাজা হয়েছিলেন ৬০৬ সালের কিছু আগে। তিনি প্রাচীন বাংলা জনপদগুলোকে ‘গৌড়’ নামে একত্রিত করেন। শশাঙ্কের উপাধি রাজাধিরাজ। তিনি বাংলার প্রথম স্বাধীন ও সার্বভৌম রাজা। শশাঙ্কের রাজধানী কর্ণসুবর্ণে। এটি বর্তমানে মুর্শিদাবাদ জেলায়। শশাঙ্কের অন্য নাম নরেন্দ্রগুপ্ত। হর্ষবর্ধন পুষ্যভূতি এই বংশের শ্রেষ্ঠ রাজা। তার সময় কৌনজ ছিল এদেশের রাজধানী। তাঁর সময়ের বিখ্যাত সাহিত্যিক হলো বানভট্ট। বানভট্টের বিখ্যাত গ্রন্থ হলো ‘হর্ষচরিত্র’। প্রাচীনকালে রাজারা তামার পাতে খোদাই করে বিভিন্ন ঘোষণা দিতেন। এগুলোকে তাম্রশাসন বলে। স্বাধীন বঙ্গরাজ্য আমলে এ রকম সাতটি তাম্রলিপি পাওয়া গেছে।

পাল বংশ : ৭৫৬ খ্রিস্টাব্দে বাংলার অরাজক পরিস্থিতির অবসান হয় এবং বৌদ্ধ শাসক পাল রাজত্বের উত্থানে। পাল বংশের প্রথম রাজা গোপাল। বাংলায় প্রথম বংশানুক্রমিক শাসন হয় পাল শাসনের মধ্য দিয়ে। তারা প্রায় একটানা ৪০০ বছর রাজত্ব করেন। এত সময় ধরে আর কোনো রাজবংশ বাংলা শাসন করতে পারেনি। তারা ছিলেন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। পাল রাজাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ছিলেন গোপালের ছেলে ধর্মপাল। বিক্রমশীল তাঁর উপাধি। তার সময়ে তিনটি রাজবংশ প্রতিযোগিতায় নামে যা ইতিহাসে ‘ত্রিশক্তি’ নামে পরিচিত। নওগাঁর পাহাড়পুরে অবস্থিত ‘সোমপুর বিহার’ নির্মাণ করেন ধর্মপাল। সোমপুর বিহারে আব্বাসীয় খলিফা হারুনর রশীদের সময়ের মুদ্রা রক্ষিত আছে। রাজা দ্বিতীয় মহীপালের রাজত্বকালে প্রথম সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণে বাংলায় বিদ্রোহ হয়। রাজা দ্বিতীয় মহীপালের শাসনামলে কৈবর্ত বিদ্রোহ হয়। কৈবর্ত বিদ্রোহ বা বরেন্দ্রী বিদ্রোহ বলতে পাল কর্মচারী দিব্যের নেতৃত্বে শুরু হওয়া কৈবর্ত সম্প্রদায়ের তৎকালীন দ্বিতীয় মহীপালের (১০৭০-১০৭৭) পাল সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে বিপ্লবকে বোঝানো হয়। এটিকে বাংলাদেশ এমনকি ভারতবর্ষের প্রথম সফল বিদ্রোহ হিসেবেও অভিহিত করা হয়। এই বিদ্রোহের মাধ্যমে কৈবর্ত নেতারা বরেন্দ্রীকে নিজেদের অধীনস্থ করে। ১০৮২ খ্রিস্টাব্দে পাল রাজা রামপাল সামান্তরাজাদের সহযোগিতায় পরবর্তী কৈবর্ত নেতা ভীমকে হারিয়ে পিতৃভূমি বরেন্দ্রীকে নিজেদের দখলে ফিরিয়ে আনেন। এর মাধ্যমে বাঙালিদের প্রথম রাষ্ট্রবিপ্লবের সমাপ্তি ঘটে।

পালবংশের শেষ রাজা ছিলেন রামপাল। সন্ধ্যাকর নন্দীর ‘রামচরিত’ গ্রন্থ থেকে তার সম্পর্কে জানা যায়। পানিকষ্ট দূর করতে তিনি অনেক দিঘি খনন করেন। দিনাজপুর শহরের কাছে ‘রামসাগর’ দিঘি তার অমর কীর্তি।

সেন বংশ : ১১ শতকে সামন্ত সেন কর্নাট থেকে বৃদ্ধ বয়সে বাংলায় আসেন। তিনি রাঢ় অঞ্চলের গঙ্গা নদীর তীরে বসতি স্থাপন করেন। বাংলায় সেন বংশের প্রতিষ্ঠাতা সামন্ত সেন হলেও রাজ্য স্থাপন না করায় সেন বংশের প্রথম রাজার মর্যাদা পান তার ছেলে হেমন্ত সেন। সেন বংশের শ্রেষ্ঠ রাজা বিজয় সেন। হুগলি জেলার ত্রিবেণীতে অবস্থিত বিজয়পুর ছিল তার প্রথম রাজধানী। তিনি মুন্সীগঞ্জের বিক্রমপুরে দ্বিতীয় রাজধানী স্থাপন করে। বল্লাল সেন বাংলায় কৌলীন্য প্রথা প্রবর্তন করেন। এটি হলো ব্রাহ্মণ, বৈদ্য ও কায়স্থ এই তিন শ্রেণির মিশ্রণ। দানসাগর ও অদ্ভুতসাগর তার রচনা। তবে অদ্ভুতসাগর তার পুত্র লক্ষণ সেন শেষ করেন। ১২০৪ সালে ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি নদীয়ার বুড়ো রাজা লক্ষণ সেনকে পরাজিত করলে সেন বংশের পতন ঘটে। সেন বংশের রাজারা ছিলেন হিন্দু। গৌড়েশ্বর উপাধি লক্ষণ সেনের।

বাংলাদেশে মুসলমান শাসনের সূচনা : তেরো শতকের শুরুতে তুর্কি বীর ইখতিয়ারউদ্দীন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি বাংলার উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাংশে সেন শাসনের অবসান ঘটিয়ে মুসলমান শাসনের সূচনা করেন। তিনি আফগানিস্তানের গরমশির বা আধুনিক দশত-ই-মার্গের অধিবাসী ছিলেন। বাংলাদেশে মুসলমান শাসনের সূচনাকালকে বাংলাদেশে মধ্যযুগের শুরু বলা হয়। ইতিহাসে এক যুগ থেকে অন্য যুগে প্রবেশ করতে হলে বিশেষ কতকগুলো যুগান্তকারী পরিবর্তন দরকার। মুসলমানদের বঙ্গ বিজয়ের ফলে বঙ্গের রাজনৈতিক ক্ষেত্রেই শুধু পরিবর্তন আসেনি। এর ফলে বঙ্গের সমাজ, ধর্ম, অর্থনীতি, ভাষা ও সাহিত্য, শিল্পকলাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে এ দেশবাসীর জীবনে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসে।

১২০৪ সালে বখতিয়ার খিলজির বাংলা বিজয় থেকে ১৭৫৭ সালে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌল্লাহর ইতিহাস, এবং ১৯৪৭ এ ভারত ভাগ-পরবর্তী পূর্ব পাকিস্তান এবং ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ শেষে অর্জিত স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদ্বয়, সমগ্র এই সময়কালটি আমাদের বিশেষ করে বাংলাদেশের মুসলমানদের গর্বিত ইতিহাসেরই অংশ। মধ্যে ১৭৫৭ সাল থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত ছিল আমাদের কালো এবং অন্ধকার যুগ। পরে ১৯৪৭ সালে ইংরেজ শাসন থেকে মুক্ত হলেও পুনরায় পাকিস্তানের অপশাসনের খপ্পরে পড়ে গেল বাংলাদেশ। তারপর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে রক্তাক্ত মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ইতিহাসের মাটি খুঁড়ে জন্ম নিল স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। শুরু হয় মাটি ও মানুষের শাসন যাদের জন্ম এ দেশের কাদা মাটিতে। এই দীর্ঘ ইতিহাসের পরতে পরতে আছে বিভিন্ন ধর্ম গোত্রের শাসন। খ্রিস্টপূর্ব ৩২৭ সালে গ্রিক সম্রাট আলেকজান্ডার থেকে মৌর্য, গুপ্ত, পাল, সেন, সুলতান ও মুঘল শাসন আমলে বাংলাদেশের সনাতন, হিন্দু, বৌদ্ধ ও মুসলমানরা একসঙ্গে বাস করেছে। সুখে দুঃখে পাশে থেকে জীবন যুদ্ধ চালিয়ে গেছে। ১৭৫৭ সালে এসে ব্রিটিশ বেনিয়ারা এদেশে বিশ্বাসঘাতকতার বীজ বপন করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেয়। ১৯৪৭ সালের আগে ভারত ছাড়ার আগে এ দেশে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা বাধিয়ে যে রক্তক্ষরণ সৃষ্টি করেছে সেই রক্তক্ষরণ এখনো আমরা বন্ধ করতে পারি নাই। এ আমাদের লজ্জা, এ আমাদের দীনতা। বাংলাদেশ মুসলমান, সনাতন, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সবার। রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম কিন্তু নাগরিক অধিকার সবার সমান। ধর্মভিত্তিক বৈষম্য সৃষ্টি করার কোনো সুযোগ কারও নেই এবং থাকতে পারে না। বাংলাদেশ অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ।

                লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য।

সর্বশেষ খবর