বুধবার, ১৭ নভেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

হাসান আজিজুল হক স্যার স্মরণে

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

হাসান আজিজুল হক স্যার স্মরণে

অধ্যাপক মুহম্মদ আবদুল হাই ও সৈয়দ আলী আহসান সংরচিত ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত’ গ্রন্থে উল্লেখ ছিল ‘শকুন’ হাসান আজিজুল হকের একটি বিখ্যাত গল্প। সে সময় (১৯৭৩) আমি দৌলতপুর সরকারি ব্রজলাল কলেজে পড়তাম। আমাদের কলেজেই তখন পড়াতেন হাসান আজিজুল হক স্যার। সবুজ ঘাসের গালিচা ছিল কলেজের বিশাল মাঠে। উত্তরের প্রশাসন ভবন থেকে সবুজ ঘাসের গালিচা মাড়িয়ে স্যার যাচ্ছিলেন দক্ষিণের কলা ভবনের দিকে। আমি সন্তর্পণে স্যারের পিছু নিলাম এবং কাছাকাছি এসে হন্তদন্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম ‘স্যার, শকুন গল্পটি কি আপনার লেখা?’ আমার এ ধরনের আকস্মিক প্রশ্নে স্যার বিস্মিত অবয়বে আমার দিকে তাকালেন। উত্তর দিলেন হাসতে হাসতে ‘হ্যাঁ’। এই হলো স্যারের সঙ্গে আমার প্রথম ব্যক্তিগত যোগাযোগ। একজন লেখককে এভাবে আমাদের শিক্ষক হিসেবে পাওয়ায় সেই নবীন বয়সে আমার মধ্যে এক ধরনের অন্যরকম অনুভূতির জন্ম দেয়। ‘শকুন’ গল্পটি বারবার পড়ার সময় গরুর ভাগাড়; শকুনের গায়ে গন্ধ, পচা মাংস এসবেরই যেন ঘ্রাণ পেতে লাগলাম। খুলনা পাবলিক লাইব্রেরিতে স্যারের ‘সমুদ্রের স্বপ্ন’ ‘শীতের অরণ্য’ : (১৯৬৪) বইটিতে অন্তর্ভুক্ত ‘শকুন’ গল্পটি যে সন্ধ্যায় প্রথম পড়ছিলাম সে সন্ধ্যাটিতেও ছিল ভ্যাপসা গরম এবং লাইব্রেরির বইসারির মধ্যে তেমন ধরনের একটা গন্ধও যেন পাচ্ছিলাম। স্যার বি এল কলেজে বেশিদিন ছিলেন না। ১৯৭৩ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে যোগ দেন এবং পত্রপত্রিকায় তাঁর গল্প (সাধারণ সাদামাটা গল্প নয়, নিরীক্ষাধর্মী, প্রাকরণিক উৎকর্ষতায় এবং জীবন ঘষে আগুনের মতো বক্তব্য তুলে ধরার অনন্যতায়) প্রকাশিত হচ্ছে। ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’, ‘জীবন ঘষে আগুন’ ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। সাপ্তাহিক বিচিত্রা ১৯৭৪ সালে খুলনার ওপর একটি বিশেষ পরিচিতি সংখ্যা প্রকাশ করে। স্যার সে সংখ্যায় লিখেছিলেন ‘যে ভিতরে আসে’- স্মৃতিচারণামূলক লেখা। স্যার বি এল কলেজের ছাত্র ছিলেন। কলেজের ছাত্রদের সঙ্গে স্থানীয়দের মাঝেমধ্যে গরম-ঠান্ডা যুদ্ধ চলত সে সময়। প্রগতিশীল ছাত্রনেতা টাইপের ছিলেন তিনি। সেসব সরস ঘটনা লিখেছেন স্যার। ১৯৭৫ সালে আগস্টের আগে সাপ্তাহিক বিচিত্রার কোনো এক সংখ্যায় ‘তিন ইঞ্চি সংবাদ চাই’ শীর্ষক স্যারের একটি অণুগল্প প্রকাশিত হয়। রাতে এক রিকশাচালকের যাত্রীর সবকিছু ছিনতাইকারীরা কেড়ে নেয়, তারা বৃদ্ধ হতভম্ব রিকশাচালককেও রেহাই দেয় না। অত্যন্ত হৃদয়বিদারক ঘটনা সেখানে ঘটে। দৈনিক পত্রিকার বার্তা সম্পাদক গভীর রাতে পেজ মেকআপ করতে গিয়ে তিন ইঞ্চি জায়গা ধরানোর মতো স্কুপ নিউজ খুঁজছিলেন। তার দরকার ততটুকুই। মানবিক বিপর্যয়ের শিকার যাত্রী ও রিকশাচালক এবং তাদের প্রতি ছিনতাইকারীদের তৎকালীন আচরণসংবলিত ঘটনাটির খবর অবশেষে ওই তিন ইঞ্চিতে ঠাঁই পায়। সমকালীন আইনশৃঙ্খলা সামাজিক নিরাপত্তা পরিস্থিতির বাস্তব আখ্যান স্যারের এ অণুগল্পটিতে উঠে আসে। এ গল্পের সূত্র ধরেই ১৯৭৬ সালের মার্চের এক ঝড়ো বর্ষণমুখর সন্ধ্যায় স্যারের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মতিহার চত্বরের পশ্চিমপাড়ার বাসায় সুদীর্ঘ আলাপে মুখোমুখি হয়েছিলাম। উপলক্ষ ছিল স্যারের লেখার পটভূমি এবং চৌহদ্দি আমার অনুভবে আনা। তাঁর গল্পের মানব-মানবী, প্রকৃতি ও পরিবেশ, তাঁর কথা ও কথাসাহিত্য, তাঁর গল্পের চরিত্রদের চিন্তা-ভাবনা অবয়ব আখ্যান সবই সে আলোচনায় উঠে আসে। স্যারের কাছে জেনেছিলাম কমল কুমার মজুমদারের ‘অন্তর্জলী যাত্রা’র যে প্রতিভাষ তাঁর লেখায় দেখা যায় তা কি তাঁর জন্মভূমি রাঢ় অঞ্চলের কঠিন কর্কশ জীবন-বৈশিষ্ট্যের সাযুজ্য ধরেই? এমনকি কত নরম-গরম প্রসঙ্গ। স্যার তখন তাঁর সৃষ্টিশীল রচনার মধ্যগগনে দীপ্যমান আর আমি সবে ¯œাতক হতে চলেছি এ রকম একটা সময়ে আমার কাছে মনে হয়েছিল স্যারের মতো একজন কথাসাহিত্যকর্মী প্রকৃত অর্থে প্রাগ্রসরমান চিন্তা-চেতনার সারথি। তাঁর আর আমার মধ্যে সে সন্ধ্যায় এমন একটা মেলবন্ধন অনুভূত হলো আজও যেন তার যৌক্তিকতা জাজ্বল্যমান। ইচ্ছা ছিল স্যারের সঙ্গে আমার আলাপনটি কোনো ম্যগাজিনে বড় সাক্ষাৎকার হিসেবে প্রকাশের। কিন্তু তা আর হয়ে ওঠেনি। এখনো তা স্মৃতির খেরো খাতায় রয়ে গেছে। তবে আমি ২০১৮ সালে তাঁর সামগ্রিক সাহিত্যকর্মের ওপর ‘হাসান আজিজুল হক : অতল জলে ডুব’ শীর্ষক সন্দর্শন গ্রন্থ সম্পাদনা করি। স্যার ভীষণ খুশি হয়েছিলেন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ স্যারের লেখায় যতটা আবেগ অনুভব ও অবয়বে ধরা পড়েছে সচরাচর অন্যত্র তা চোখে পড়ে না। ‘নামহীন গোত্রহীন’ গ্রন্থের গল্পগুলোয় মুক্তিযুদ্ধের, মুক্তিযোদ্ধাদের, মুক্তিযুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের অভিব্যক্তি ফুটে ওঠে। ‘ফেরা’ গল্পে যুদ্ধফেরত মুক্তিযোদ্ধা আলেফ তার অস্ত্রটি পুকুরে ছুড়ে ফেলে দেয়- সময়মতো তা খুঁজে হাতে তুলে নেওয়ার পরিকল্পনায়। বিষয়গুলো ১৯৭২-৭৫ সময়ে বাংলাদেশের তৎকালীন আর্থসামাজিক পরিবেশের চিত্র তুলে ধরে। ‘কৃষ্ণপক্ষের দিন’ গল্পে পড়ন্ত বেলায় বিলের মাঝে গাছতলায় দুই পক্ষের সম্মুখযুদ্ধের যে ছবি আঁকা হয়েছে তা এতটা বাস্তবতাসংবলিত যে মনে হয়েছে এই কিছুক্ষণ আগে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাক সেনাদের সম্মুখসমর ঘটে গেল। মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোয় শহর খুলনায় স্যারের নিজের অবস্থান ও নিজের চোখে দেখা অনুভবের অবয়বে তুলে আনা আত্মজৈবনিক প্রতিকৃতি তাঁর ‘একাত্তর করতলে ছিন্নমাথা’ শীর্ষক গল্পে ফুটে উঠেছে। আমি তখন দশম শ্রেণির ছাত্র। শহর খুলনায় আমিও স্যারের কাছাকাছিই অবস্থান করছিলাম। স্যার যেভাবে অবরুদ্ধ খুলনা শহরে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোর ছবি এঁকেছেন, বর্ণনা করেছেন আমার কাছে সেগুলো একান্ত আমার দেখা বলে মনে হয়েছে। খালেদ রশীদ গুরুর কথা তিনি যেভাবে চিত্রিত করেছেন তা শুধু একান্ত বিশ্বস্তই নয়, সেখানে নির্মোহ আবেগের প্রতিফলন ঘটেছে।

স্যারের লেখার একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য গল্পের শুরু বাক্যে তাৎক্ষণিক সারৎসারতা প্রকাশের প্রয়াস। ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’ গল্পের শুরু এভাবে- ‘এখন নির্দয় শীতকাল, ঠান্ডা নামছে হিম, চাঁদ ফুটে আছে নারকেল গাছের মাথায়। অল্প বাতাসে একটা বড় কলার পাতা একবার বুক দেখায় একবার পিঠ দেখায়। ওদিকে বড় গঞ্জের রাস্তার মোড়ে রাহাত খানের টিনের চাল হিম ঝকঝক করে। একসময় কানুর মায়ের কুঁড়েঘরের পৈঠায় সামনের পা তুলে দিয়ে শিয়াল ডেকে ওঠে।’ যেমন ফেরা গল্পের শুরু ‘দুবার গুলির শব্দ শোনা গেল।’ ‘শোণিত সেতু’ গল্পটিতে রক্তক্ষরণের বিষয় তো আছেই এবং তার সঙ্গে সঙ্গে আছে নির্জীব মানুষেরও ফুঁসে ওঠার কথা। শুভ এবং অশুভ শক্তির যুদ্ধের ব্যাপারটা দুটি ষাঁড়ের লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে জীবন্ত হয়ে উঠেছে এবং শেষ পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে যে শুভ ষাড়েরই জয় হচ্ছে এবং অশুভ শক্তিটি বিদেশি।  ‘একাত্তর করতলে ছিন্নমাথা’ শুরু হয়েছে এভাবে- ‘আমার জানা ছিল না যে পানিতে ভাসিয়ে দিলে পুরুষের লাশ চিৎ হয়ে ভাসে আর নারীর লাশ ভাসে উপুড় হয়ে। মৃত্যুর পরে পানিতে এদের মধ্যে এটুকু তফাৎ। এ জ্ঞান আমি পাই ’৭১ সালের মার্চ মাসের একেবারে শেষে- ৩০ বা ২৯ তারিখে। আগের রাতে একটুও ঘুম হয়নি। ২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় কী ঘটেছে, খুলনায় বসে তা জানার উপায় ছিল না। এমনই ল-ভ- হয়ে গিয়েছিল পথঘাট যোগাযোগের ব্যবস্থা। খবরের কাগজ আসা বন্ধ হয়েছিল। রেডিও বোধহয় চলছিল, কিন্তু তা শুনে কিছু বোঝার উপায় ছিল না। দেশ অতি চমৎকার চলছে এ কথাটা রেডিও থেকে বোঝা যেত বটে, তবে এ কথা বিশ্বাস করার লোক তখন বাংলাদেশে একজনও ছিল না।’

১৯৬৪ সালে তাঁর প্রথম লেখা ‘শকুন’ প্রকাশের পর থেকে অদ্যাবধি হাসান আজিজুল হক প্রচন্ডভাবে সৃজনশীল মননে বয়ানে বামপন্থি, মানবিক মনোভঙ্গি নিয়ে, আর্থসামাজিক ও রাজনীতি নিয়ে তাঁর তির্যক দর্শন, ভাবনা প্রক্ষেপণে ভাষা ও বাকপ্রতিমা, বড় অন্তর্ভেদী এবং উদ্দেশ্যের অয়োময়তায় প্রকট ও প্রবুদ্ধ সূক্ষ্ম কারুকার্য নিয়ে। ১৯৯৬ সালের প্রথম দিকে তাঁর কাছে দাবি করা হয়েছিল পূর্ণাঙ্গ উপন্যাসের। দাবি পূরণ করেছিলেন তিনি। যদিও ‘বৃত্তায়ন’ তাঁর প্রথম উপন্যাস। তবে ‘আগুনপাখি’ তাঁর সেরা উপন্যাস। ‘সাবিত্রি’ উপাখ্যান’ (২০১৩) এবং ‘শামুক’ (২০১৫) তাঁর পরবর্তী উপন্যাস।

সুপ্রতিষ্ঠিত কথাশিল্পী, মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী বিপর্যস্ত বাংলার সার্থক জীবনশল্পী হাসান আজিজুল হক (১৯৩৮-২০২১) ১৫ নভেম্বর সোমবার রাত সাড়ে ৯টায় পরলোকগমন করেছেন। তাঁর আত্মার মাগফিরাত কামনা করি।

লেখক : সরকারের সাবেক সচিব ও এনবিআর চেয়ারম্যান।

সর্বশেষ খবর