শনিবার, ১৫ জানুয়ারি, ২০২২ ০০:০০ টা

তারুণ্যের কৃষির সমন্বিত আয়োজন

শাইখ সিরাজ

তারুণ্যের কৃষির সমন্বিত আয়োজন

কৃষি ঘিরে শিক্ষিত তরুণরা স্বপ্ন বুনতে শুরু করেছেন। নিচ্ছেন নানামুখী উদ্যোগ। ফলে আমি বিশ্বাস করি বাংলাদেশের কৃষি একদিন সারা বিশ্বের কাছে অনন্য স্থানে পৌঁছাবে। দেরিতে হলেও অনেক তরুণ অনুধাবন করছেন সাফল্যের প্রকৃত সংজ্ঞা খাদ্য নিরাপত্তা ও নিরাপদ খাদ্য পর্যন্ত বিস্তৃত। আগামীর পৃথিবীকে আরও বাসযোগ্য করে তোলার তাগিদ অনুভব করছেন তারা- এ বিষয়টিও দেখেছি অনেক তরুণের মধ্যে। আমি এ তরুণদের নিয়ে খুবই আশাবাদী। এমনই এক তরুণের ফোন পেলাম একদিন। আবেগমাখা কণ্ঠে বললেন, ‘স্যার আমি বিল্লাল। আপনার অনুষ্ঠান দেখে দেখে কৃষি নিয়ে আমিষ অ্যাগ্রো নামে একটা ছোট্ট উদ্যোগ নিয়েছি। আপনি যদি একবার দেখে যান তবে আরও বেশি অনুপ্রাণিত হতাম।’

নাম ‘আমিষ অ্যাগ্রো’ শুনে মনে পড়ল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়া কাউন্টির আমিষ ভিলেজের কথা। চ্যানেল আইয়ের ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’ অনুষ্ঠানে ২০১৮ সালে আমিষ ভিলেজের ওপর একটি প্রতিবেদন প্রচার করেছিলাম। যান্ত্রিক আধুনিক আমেরিকার মধ্যে ভিন্ন রকম আমিষ ভিলেজের মানুষ। তারা সনাতন জীবনব্যবস্থার সৌন্দর্যই উপভোগ করছেন। সেখানে কোনো যন্ত্র-গাড়ি চলে না। মাঠে গরু-গাধা ব্যবহার করে হালচাষ হয়। এমনকি নেই কোনো বৈদ্যুতিক বাতি, সন্ধ্যা নামলে ঘরে ঘরে জ্বলে হারিকেন। কায়িক শ্রমে চলে খাদ্য উৎপাদন থেকে শুরু করে নানামুখী কাজ। সবাই অর্গানিক খাদ্য খান। পড়শোনা করেন নিজেদের নির্দিষ্ট কারিকুলামে। সব মানুষের জন্য একই নিয়ম সেখানে। নগর যান্ত্রিকতা, বহুতল অট্টালিকা নেই ওই গ্রামে। গ্রামীণ কৃষিনির্ভর জীবিকা কেন্দ্র করে স্বাচ্ছন্দ্যে কাটে তাদের জীবন। ভেবেছিলাম বিল্লালের আমিষ অ্যাগ্রোও বোধহয় এমন কিছু হবে। কিন্তু গত সপ্তাহে যখন নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে আমিষ অ্যাগ্রোয় পৌঁছলাম, দেখলাম উদ্যোগটি আমিষ ভিলেজের সঙ্গে নামে কিছুটা মিল থাকলেও তাদের আয়োজনে কোনো মিল নেই। আর বিল্লালের কণ্ঠ শুনে যতটা গুরুগম্ভীর মনে হয়েছিল, বাস্তবে শীর্ণদেহের হাস্যোজ্জ্বল এক তরুণ। কথা হলো তার সঙ্গে। টেকনিক্যাল শিক্ষা বোর্ডে মেধা তালিকায় স্থান পাওয়া মতিউর রহমান বিল্লাল পড়াশোনা শেষ করেছেন মেকানিক্যাল প্রকৌশলবিদ্যায়।

বিল্লাল জানালেন, খামারটি সর্বসাকল্যে আয়োজন ১২৩ বিঘায়। এর মধ্যে রকমারি প্রাণবৈচিত্র্য ও প্রাণিসম্পদের খামারের আয়োজনটি ১০ বিঘায়। বিল্লালকে সঙ্গে নিয়ে প্রথম যে শেডটিতে প্রবেশ করি সেটা গরুর শেড। এরই মধ্যে কয়েক ব্যাচ মাংসের গরু বিক্রি হয়েছে। গত কোরবানিতেও এ খামারের একটি বাণিজ্যিক সাফল্য রয়েছে, জানালেন বিল্লাল। এর বাইরে এখন রয়েছে ৫৬টি গরু। দুটি গাভী দুধ দিচ্ছে ৩০ লিটার। শীতের পরই কোরবানির জন্য গরু মোটাতাজাকরণ শুরু হবে। সেজন্য প্রস্তুত রয়েছে এ শেড। উদ্দেশ্য শতভাগ বাণিজ্যিক। কিন্তু কাজগুলোর মধ্যে বাণিজ্যের জোরালো তাড়া নেই। এ বিষয়টি বেশি ইতিবাচক মনে হলো।

বিল্লাল তার আত্মবিশ্বাস দিয়ে বোঝাতে চাইলেন নিশ্চিত সম্ভাবনার ক্ষেত্রটি। বর্তমান সময়ে প্রাণিসম্পদের খামার পরিকল্পনার সঙ্গে ঘাস চাষের বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিতে হয়। সফল খামারিরা মনে করেন খাদ্যের নিশ্চয়তাবিধান না করে খামার গড়লে লাভবান হওয়া কঠিন। এই শিক্ষিত ও মেধাবী তরুণ এ সময়ের কৃষির প্রয়োজনীয় পদক্ষেপগুলো সম্পর্কে যথেষ্টই সচেতন। জানালেন, শেডে গরু তোলার আগেই ঘাসের শতভাগ জোগান নিশ্চিত করে নিচ্ছেন তিনি।

খামারে রয়েছে চার প্রজাতির ৫৬টি ছাগল, ১১টি দুম্বা, হরিণ, দুই প্রজাতির হাঁস, পুকুরে মাছের চাষ ইত্যাদি। কোনো কিছুই স্বল্পমেয়াদি লাভের জন্য নয় বরং একে একটি পরিবেশসম্মত আধুনিক খামার হিসেবে গড়ে তোলার মিশন রয়েছে উদ্যোক্তাদের। একটি শেডে ঢুকতেই চোখে পড়ল রংবেরঙের পাখপাখালি। কিচিরমিচির শব্দে মুখরিত।

খামারের এক পাশে বেশ কয়েকটি হরিণ। শেডে খোপ খোপ করে রাখা হয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির ছাগল। বৈচিত্র্যময় খামার আয়োজনের পেছনে জোরালো যুক্তিবুদ্ধি রয়েছে বিল্লালের। সবচেয়ে আশাব্যঞ্জক, এখানকার কৃষি ও প্রাণবিজ্ঞানের প্রতিটি বিষয় গভীরভাবে রপ্ত করেছেন বিল্লাল। দুম্বা নিয়ে বিল্লালের চিন্তাভাবনাও বেশ গোছাল। এখনই বিক্রয়যোগ্য দুম্বা রয়েছে গোটা পাঁচেক। বলছিলেন চাইলেই আড়াই লাখে বিক্রি করে দিতে পারেন একেকটি। কিন্তু দুম্বা নিয়ে একরকম গবেষণা তার রয়েছে। খামারের এক পাশে পুকুর। সেখানে চলছে মাছ চাষ। পুকুর পাড় ঘেঁষে হাঁসের খামার। আছে দুই প্রজাতির হাঁস। রাজহাঁস ও খাকি ক্যাম্বেল। বিল্লাল বলছিলেন, হাঁস পালনের চিন্তা আসে তার হালাল সরকারের হাঁসের প্রতিবেদন দেখে। ৬০০ রাজহাঁস ও ১৫০০ খাকি ক্যাম্বেল হাঁস দিয়ে এর যাত্রা। রাজহাঁস থেকে সফলতা পেলেও হতাশ করেছে খাকি ক্যাম্বেল। ভ্যাকসিন জটিলতায় বেশ কিছু খাকি ক্যাম্বেল ঝরে যায় মৃত্যুতে। তাই বিল্লালের আস্থা রাজহাঁসেই। বলছিলেন, খাকি ক্যাম্বেলের তুলনায় ৫ গুণ বেশি খাবার খেলেও রাজহাঁস বেশ লাভজনক।

পুকুরের পাশেই বিশাল রান্নাঘর। সেখানে বড় পাত্রে রান্না হচ্ছে নানান খাবার। জানতে চাইলাম এত খাবার রান্না হচ্ছে কাদের জন্য? বিল্লাল জানালেন, পাশেই তাদের একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। সেখানে আবাসিক শিক্ষার্থীদের জন্য রান্না হচ্ছে। রান্নার সব উপকরণ আসছে এ খামার থেকেই।

সব মিলিয়ে খামারটি দারুণ সম্ভাবনাময়। সবখানেই সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার ছোঁয়া। বিল্লাল বলছিলেন, একটি শিল্প গ্রুপের বহুমুখী উদ্যোগের ছোট একটি অংশ এ খামার। উদ্যোগের সঙ্গে যতটা না বাণিজ্যিক লাভের বিষয় যুক্ত তার চেয়ে বেশি সামাজিক দায়বদ্ধতা।

আমিষ ফুডস অ্যান্ড অ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেডের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. আবদুল আজিজ বলেন, বাণিজ্যের পাশাপাশি মানুষকে নির্ভেজাল পণ্য পৌঁছে দেওয়ার প্রচেষ্টাতেই এ উদ্যোগ। তার সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পারলাম কৃষিপণ্যের একটা বিজনেস চেইন গড়ে তুলতে চাইছেন। তাদের রয়েছে নিজস্ব সুপার শপ। আর সেখানেও এসব অর্গানিক পণ্যের দারুণ চাহিদা। তাদের পরিচালিত বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আবাসিক শিক্ষার্থীদের খাদ্য চাহিদার একটা অংশ মেটাতেও ভূমিকা রাখছে আমিষ অ্যাগ্রো।

যে কোনো শিল্পোদ্যোগ ও অর্থনৈতিক বিনিয়োগের সঙ্গে কৃষি এখন আপনা-আপনিই এসে যাচ্ছে। বিশ্বব্যাপী কৃষিবাণিজ্য বহুমুখীভাবে সম্প্রসারিত হচ্ছে। কৃষি যদিও প্রাচীন পেশা কিন্তু আজকের বিবেচনায় এ এক টেকসই ও আধুনিক শিল্পোদ্যোগ। প্রচলিত অনেক বাণিজ্যের ভিড়ে কৃষির ভিতরে ভিতরে বাণিজ্যের নানা দিক এখনো অনাবিষ্কৃত রয়ে গেছে। তার মানে এখানেই রয়ে গেছে বিপুল সম্ভাবনা। সেটি আজকের দিনে এই মতিউর রহমান বিল্লালের মতো তরুণদের কাছে অনায়াসেই ধরা দিচ্ছে। এখন যা প্রয়োজন তা হলো পরিশ্রম ও নিষ্ঠা। তাহলেই কাক্সিক্ষত লক্ষ্য নিশ্চিতভাবেই পূরণ করা সম্ভব।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।  

[email protected]

সর্বশেষ খবর