প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে বিশ্বব্রহ্মান্ডের সবকিছুই গতিশীল ও পরিবর্তনশীল। পার্থিব জগতের প্রতিটি প্রাণীই জন্মগ্রহণের পর থেকে জীবনকালের কয়েকটি ধাপ অতিবাহিত করে পরম ও চরম প্রাপ্তির দিকে অগ্রসর হয়। মানবজীবনও এর ব্যতিক্রম নয়। প্রতিটি মানুষ জন্মগ্রহণের পর শৈশব, কৈশোর ও যৌবনকাল অতিবাহিত করে বার্ধ্যকে উপনীত হয়। আর বার্ধক্যেই প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে নানা রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হয়। ফলে রোগাক্রান্ত ব্যক্তির আত্মীয়স্বজন ও কাছের মানুষ উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় ভোগে। বিএনপি চেয়ারপারসন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াও বর্তমানে বার্ধক্যজনিত গুরুতর অসুস্থতা নিয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তাঁর শারীরিক পরিস্থিতি বেশ জটিল ও কঠিন। স্বাভাবিক কারণেই তাঁর আত্মীয়স্বজন এবং দলীয় নেতা-কর্মীরা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে আছেন। খালেদা জিয়া বাংলাদেশের প্রথম শ্রেণির একটি উন্নতমানের হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তাঁর জন্য গঠন করা হয়েছে দক্ষ চিকিৎসকের সমন্বয়ে মেডিকেল বোর্ড। এ বোর্ডের অধীনেই চিকিৎসা চলমান। কিন্তু কিছুদিন আগে থেকেই খালেদা জিয়ার লিভার সিরোসিসের কারণে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। এ অবস্থায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের অভিমত, অচিরেই তাঁকে বিদেশে নিয়ে চিকিৎসা দেওয়া অত্যাবশ্যক। বিশেষত আমেরিকা, ইংল্যান্ড ও জার্মানি এ তিন দেশেই শুধু তাঁর সঠিক চিকিৎসা চলতে পারে।
কিন্তু এ তিনটি দেশে তথা বিদেশে পাঠানোর মাধ্যমে খালেদা জিয়ার চিকিৎসা করাটাই সরকারের কাছে জটিল ও কঠিন হয়ে দেখা দিয়েছে। কারণ আইনের দৃষ্টিতে দোষী সাব্যস্ত হয়ে দন্ডপ্রাপ্ত আসামি হওয়া সত্ত্বেও খালেদা জিয়া শুধু চিকিৎসা প্রাপ্তির জন্যই সরকারের অনুকম্পায় ও উদারতায় জামিনে মুক্ত হয়ে বাংলাদেশের একটি প্রধানতম হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা নিতে পারছেন। থাকতে পারছেন ঘরোয়া আবেশে পারিবারিক পরিবেশে। খালেদা জিয়ার জন্য এ বিশেষ ব্যবস্থা করেছেন বর্তমান সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা তাঁর নির্বাহী ক্ষমতার আদেশ অনুবলে। কিন্তু আইনের বাইরে গিয়ে এর থেকে বেশি কিছু করতে পারাটা তাঁর পক্ষে বেশ কঠিন। কারণ খালেদা জিয়াকে জামিনে মুক্ত করার সময় একটি শর্ত যুক্ত ছিল। তা হলো তিনি কোনো দিনও চিকিৎসার জন্য বা অন্য কোনো কারণে দেশের বাইরে যেতে পারবেন না।
বিএনপি দেশের প্রধান একটি রাজনৈতিক দল। এ দলের রয়েছে দেশব্যাপী প্রচুর নেতা-কর্মী-সমর্থক। তাই তাদের সবারই দাবি তাদের দলীয় প্রধানকে বিদেশে পাঠিয়ে উন্নত ও যথাযথ চিকিৎসা প্রদানের।
লক্ষণীয় বিষয় হলো, চিকিৎসার জন্য বিদেশ গমনের অনুমতি প্রদানকারী ব্যক্তি হলেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি আবার ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দলেরও প্রধান। আর চিকিৎসা গ্রহণকারী খালেদা জিয়া প্রধানতম বিরোধী দল বিএনপির প্রধান। খালেদা জিয়া চিকিৎসা গ্রহণের জন্য বিদেশে যাওয়া মাত্রই অন্যসব দেশে অবস্থানরত বিএনপির পলাতক সমর্থকরা এক জায়গায় একত্রিত হবেন। কেউ তখন এদের আটকে রাখতে পারবে না। আর এ ধরনের লোকজন এক জায়গায় একত্রিত হওয়ার সুযোগ পেলে তা বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের জন্য খুব একটা সুখকর হবে না। আর খালেদা জিয়ার চিকিৎসা যেহেতু শুধু আমেরিকা, ইংল্যান্ড ও জার্মানির মতো তিনটি শক্তিশালী দেশেই সম্ভব, তাই চিকিৎসা চলাকালে ওইসব দেশের প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাদের প্রভাবিত করার যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকবে। রাজনীতির প্রধানতম অনুষঙ্গ কূটনীতি। কূটনীতির কূটচালের মাধ্যমেই সব দেশের সব সরকারপ্রধান ক্ষমতায় টিকে থাকেন। কূটনীতির মাধ্যমে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের কারণেই কালে কালে দেশে দেশে বড় বড় রাজনৈতিক নেতার জীবন বিপন্ন হয়েছে। হয়েছেন ক্ষমতা থেকে উৎখাত এমনকি দেশান্তরী। রাজনৈতিক নেতাদের চলার পথ খুবই কঠিন, বন্ধুর। এতটুকু ভুলের কারণে ঘটে যেতে পারে মহাবিপর্যয়।
খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসা গ্রহণ প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত হলেও সরকারের জন্য এক ধরনের জটিলতা। সৃষ্টিকর্তা না করুন বিদেশে তাঁর কিছু হয়ে গেলে তা-ও সরকারের জন্য জটিলতা হিসেবে দেখা দেবে। দেশে দেখা দিতে পারে চরম অস্থিরতা, অরাজকতা। যা সরকারের জন্য সুখকর হবে না। আবার বিপরীতক্রমে তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং বিএনপির মতো শক্তিশালী দলের প্রধান খালেদা জিয়া তাঁর জীবনের সংকটময় মুহূর্তে সরকারের অনুমতি নিয়ে বিদেশে যথাযথ চিকিৎসাসেবা পাবেন না তা-ও দেশবাসীর কাছে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। তাই তো অনেকে সরকারকে অনুরোধ করেছেন, শেষ জীবনে যেন বেগম খালেদা জিয়াকে বিদেশে পাঠিয়ে সরকার তার যথাযথ দায়িত্ব পালন করে। বিএনপি নেতা-কর্মীদের শেষ আকুতি প্রাণের দাবি পূরণ করে সরকারের উচিত অচিরেই খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বিদেশ পাঠানো। তা না হলে সরকারকে এ অপবাদ জীবনভর বহন করতে হবে। আম-জনতার কথা হলো, খালেদা জিয়া একজন নারী। আবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও একজন নারী। তাই শেখ হাসিনা এ ক্ষেত্রে মানবিকতার পরিচয় দিয়ে যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করে হতে পারেন স্মরণীয়-বরণীয়।
পরিশেষে সবাইকে মনে রাখতে হবে, বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসা প্রাপ্তির বিষয়টি রাজনৈতিক এবং উচ্চমার্গের কূটনৈতিকও বটে। এ ক্ষেত্রে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী। কাজেই এখানে সাধারণ মানুষের এমনকি উভয় দলের নেতা-কর্মীদের আবেগপ্রবণ হওয়ার এতটুকুও সুযোগ নেই। সবারই মত প্রকাশ করার স্বাধীনতা ও সুযোগ আছে। কিন্তু আমাদের সবার অবশ্যই মনে রাখতে হবে, সিদ্ধান্ত আসবে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে। কাজেই সবাইকে ধৈর্য ধারণ করতে হবে। হতে হবে সহনশীল। আমাদের সবাই পরম করুণাময় সৃষ্টিকর্তার কাছে খালেদা জিয়ার দ্রুত রোগমুক্তি ও দীর্ঘ জীবন কামনা করতে হবে। তা হলেই দেশমাতৃকার জন্য সবকিছু সার্বিকভাবে সুন্দর হয়ে উঠবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক।