রবিবার, ২৩ জানুয়ারি, ২০২২ ০০:০০ টা

আইভী না শামীম কার প্রয়োজন আওয়ামী লীগে

নঈম নিজাম

আইভী না শামীম কার প্রয়োজন আওয়ামী লীগে

ভদ্রলোক হাসিমুখে ঢুকলেন সেলুনে। জানতে চাইলেন- চুলে রং করার কী ব্যবস্থা আছে তোমাদের। জবাবে ক্ষৌরকার বললেন, চিন্তা করবেন না। সব ব্যবস্থা আছে। চোখ বন্ধ করে বসুন। ভদ্রলোক চেয়ারে বসলেন। চুলে আজব এক রং লাগিয়ে দিলেন সেলুনের কর্মীটি। ভদ্রলোক চিৎকার করে উঠলেন। আজগুবি রং মাখানো মাথা নিয়ে কোথাও যেতে পারেন না। এমনকি বাসার ভিতরেও হেলমেট পরে থাকতে হয়। স্ত্রী-সন্তানও মুখ টিপে হাসে। এমন একটি বিজ্ঞাপন টিভিতে সম্প্রচার হয়। বিজ্ঞাপনের শেষ লাইনটি ছিল- চোখ বন্ধ করে সবার ওপর ভরসা রাখা যায় না। নির্ভরশীলতার জন্য বিশ্বস্ততা লাগে আলাদা করে। চলার পথে বাস্তব জীবনে সবাই কমবেশি এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হই। বিশ্বাস শব্দটি ডিকশনারি থেকে উঠে যাচ্ছে। সমাজের ঘাটে ঘাটে বসে থাকা মানুষ নিজেকে লুকিয়ে রাখে মুখ-মুখোশের আড়ালে।

কিছুদিন আগের কথা। হারিছ চৌধুরীর এক আত্মীয় ফোন করলেন বিদেশ থেকে। বললেন, হারিছের চাচাতো ভাই আশিক চৌধুরী মৃত্যু নিয়ে যে তথ্য প্রকাশ করলেন তা সঠিক নয়। হারিছ চৌধুরী লন্ডনে মারা যাননি। মারা গেছেন ঢাকায়। ভদ্রলোক আরও বললেন, লন্ডন-আমেরিকায় একজন মানুষ মারা গেলে তা লুকিয়ে রাখা যায় না। মৃত ব্যক্তির ডকুমেন্ট হাসপাতালে ও গোরস্থানে থাকবে। ইচ্ছা করলেও কেউ বেওয়ারিশ থাকতে পারে না। মারা গেলে আরও না। হারিছ মারা গেছেন ঢাকায়। দাফনও ঢাকায় হয়েছে। বিস্মিত হলাম কথা শুনে। আসলেই উন্নত বিশ্বে কেউ বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন হতে পারে না। আর দাফন করলেও পুলিশ ধরবে। লাশও কোথাও লুকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। তাহলে বিএনপির এই নেতাকে নিয়ে কেন এত লুকোচুরি? মৃত্যুর চার মাস পর কেন ঘোষণা? একদা হারিছ চৌধুরী ভীষণ ক্ষমতাশালী ছিলেন। তাঁর ক্ষমতার দানবীয় রূপের কঠিন খেসারত বিএনপিকে কড়ায় গন্ডায় বুঝিয়ে দিতে হয়েছে। ওয়ান-ইলেভেন থেকে এ পর্যন্ত মোকাবিলা করতে হচ্ছে কঠিন পরিস্থিতি। অনেকেই মনে করেন বিএনপির শাসনকালের সব অপকর্মের খলনায়ক এই হারিছ চৌধুরী। আদালতে তাঁর সাজা হয়েছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার রেড অ্যালার্টের আসামি তিনি। সময়মতো তাঁকে ধরা গেলে অনেক প্রশ্নের জবাব মিলত। জানা যেত ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা, চট্টগ্রামে অস্ত্র উদ্ধার, শাহ কিবরিয়াসহ সব রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের আড়ালে কারা জড়িত তাদের নাম।

ইতিহাস অনেক কিছু আড়ালেই রেখে দেয়। হারিছ ২০০৭ সালে অন্তর্ধানে চলে গেলেন। আর ফিরলেন না। তাঁর নিষ্ঠুর দাপুটে যুগ আমরা দেখেছি ২০০১ সালের পর। তখন কাজ করতাম এটিএন বাংলায়। বার্তা সম্পাদক ছিলাম। হারিছের অফিস থেকে নানা নির্দেশনা আসত। তাঁর খবর গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশের ব্যাপারে কঠোর নির্দেশনা ছিল। তিনি ছিলেন সীমাহীন ক্ষমতাশালী। সেই হারিছের শেষটা ভালো ছিল না। ক্ষমতার বাড়াবাড়ির খেসারত তাঁকে দিতে হয়েছে। তাঁর সহচর একাধিক গোয়েন্দাপ্রধান এখন কারাগারে। মৃত্যুদন্ডের আসামি। ওয়ান-ইলেভেন সরকারের সময় দেশবাসী তাঁদের অপকর্ম জেনেছে। বিচারের প্রক্রিয়াও তখন শুরু। এ সরকার বিচারের ধারাবাহিকতা রক্ষা করেছে। মৃত্যুর ঘোষণার পর প্রশ্ন তৈরি হয়েছে আসলে তিনি কোথায় ছিলেন? এত নিরাপত্তার জাল ভেদ করে ঢাকায় কীভাবে অবস্থান করলেন? তাঁর লেভেলে কারও এভাবে বছরের পর বছর লুকিয়ে থাকা কি সম্ভব? ছদ্মবেশ ধারণ করলেও তাঁর লেভেলের একজনকে কারা লুকিয়ে রেখেছিল? হারিছের মেয়ে বলেছেন, তাঁর বাবা ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেছেন। আত্মীয়রা একটি হাসপাতালের নামও বলেছেন। এ ঘটনার তদন্ত প্রয়োজন। হারিছ ঢাকায় মারা গেলে এ শহর কোনোভাবেই নিরাপদ নয়। তিনি ছিলেন ক্ষমতায় থাকার সময় জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদের পৃষ্ঠপোষক। ওয়ান-ইলেভেনের এক দিন পর থেকে সেনা সরকারের লোকজন তাঁকে খুঁজে পায়নি। তখন শুনেছিলাম আসামের করিমগঞ্জে নানাবাড়ি আছেন। দীর্ঘদিন সেখানে ছিলেন। করিমগঞ্জ থেকে লন্ডন গেছেন। আবার কেউ বলছেন, অবস্থান করতেন ইরানে। দীর্ঘদিন পর প্রকাশ করা হলো অন্য কথা। সত্যি-মিথ্যা বের হওয়া দরকার। ঘটনা সত্যি হলে বুঝতে হবে নাকে তেল দিয়ে চুলের রং করার গল্পের মতো নির্ভরশীলতা নিয়েই সরকার বসে আছে। এ নির্ভরতা নীরবে সর্বনাশ করে ছাড়ছে।

টানা ক্ষমতার কারণে অনেক কিছু সাদা চোখে ধরা পড়ে না। দেশ-বিদেশে ক্ষমতাবান মানুষের অভাব নেই এখন। কিন্তু সত্যিকার অর্থে কাজ করার মানুষের অভাব আছে। যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার খবর সরকার আগে জানল না কেন? আমাদের দূতাবাসগুলোর কাজ কী? সরকার ঘটনা আগে টের পেলে অনেক কিছু করার থাকে। আর সঠিক সময়ে দূতাবাস তথ্য জানাতে না পারলে কূটনৈতিক সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। জানি এসব কথা বলে লাভ নেই। সরকারের নীতিনির্ধারকরা সবকিছুই স্বাভাবিকভাবে নিচ্ছেন। নারায়ণগঞ্জের বিজয় অনেকের কনফিডেন্স আরও বাড়িয়েছে। কিন্তু বাস্তবে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলার কিছু নেই। সেলিনা হায়াৎ আইভী ব্যাপক জনপ্রিয় একজন নেত্রী। তিনি নিজের সক্ষমতা ও চ্যালেঞ্জ নিয়ে রাজনীতি করেন। তাঁর আলাদা একটা স্বকীয়তা আছে। দেশের সিভিল সোসাইটির কাছে আছে গ্রহণযোগ্যতা। আওয়ামী লীগবিরোধী মিডিয়া ও ব্যক্তিরাও তাঁকে সমর্থন দেন। পছন্দ করেন তাঁর ইতিবাচক ধারার চিন্তার কারণেই। শামীম ওসমান ও আইভীকে এক পাল্লায় মাপা কোনোভাবেই ঠিক নয়। শামীমের রাজনীতি আওয়ামী লীগের ট্র্যাডিশনাল ধারার। দলের বাইরে তাঁর সমর্থন নেই। একটা সময় ঢাকার বাইরে আওয়ামী লীগের আলোচিত অনেক নেতা ছিলেন। বরিশালের কথা ভাবলে আসে আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ, চট্টগ্রামের এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী, সিলেটের বদর উদ্দিন আহমদ কামরান, খুলনার তালুকদার আবদুল খালেক, ফেনীর জয়নাল হাজারীর নাম। এমন আরও অনেক নেতা আওয়ামী লীগের ছিলেন এবং আছেন। একটি জেলার নাম এলে তাঁদের নাম উঠে আসে। শামীম তাঁদের মতোই একজন। বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার কর্মী হিসেবে ক্ষমতার রাজনীতিতে অভিমানী। পারিবারিক, সামাজিক রীতিনীতি-ঐতিহ্য নিয়ে রাজনীতি করছেন ছাত্রজীবন থেকে। ভুলত্রুটির ঊর্ধ্বে নন। ড. কামাল হোসেনদের সঙ্গে মিশতে জানেন না। কথা বলতে পারেন না। যেতে পারেন না চিরচেনা জগতের বাইরে। এ কারণে বারবার বিপর্যয়ে পড়েন। কিন্তু আবার উঠে দাঁড়ান। মিডিয়া বা সিভিল সোসাইটির সমর্থন কখনো পাননি। পাবেনও না। কিন্তু আওয়ামী লীগের কর্মীদের কাছে নিজেকে ধরে রেখেছেন। কর্মীরা দুঃসময়ের সাহসী নেতাদের পছন্দ করেন। আবার কঠিন বাস্তবতাও মেনে নেন। কারণ এর বাইরে আওয়ামী লীগ কর্মীদের যাওয়ার জায়গা নেই। তাদের কাছে নেত্রীর নির্দেশই বড়। তারা মনে করেন দলে আইভীর দরকার আছে। আবার শামীমকেও। সাধারণ মানুষকে কাছে টেনে উৎসবমুখর নির্বাচনে সবাইকে জয় করে ভোটে জিততে পারেন আইভীরা। আবার বিএনপি-জামায়াতের সব চ্যালেঞ্জ ধরাশায়ী করতে রাজপথে শামীম ওসমানদেরও প্রয়োজন রয়েছে। দুঃসময়ে এ নেতারাই হয়ে ওঠেন কর্মীদের সাহসের প্রতীক। আজকের এ সুসময় কাল না-ও থাকতে পারে। আবারও দরকার হতে পারে মাঠের ত্যাগী নেতা-কর্মীদের।

কবি বলেছেন, ‘চিরদিন কাহারো সমান নাহি যায়।’ আসলেও তাই। রাষ্ট্র, সমাজ, ব্যক্তি সবকিছুরই ওঠানামা আছে। ক্ষমতার একই গতি সব সময় থাকে না। আওয়ামী লীগ ক্ষমতার তৃতীয় মেয়াদের শেষ ধাপে এখন অবস্থান করছে। ক্ষমতার এ মেয়াদে সমস্যার শেষ নেই। করোনা মহামারি তৈরি করেছে এক ধরনের চ্যালেঞ্জ। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে যেতে হচ্ছে সরকারকে। শেখ হাসিনার সাহসী, বলিষ্ঠ নেতৃত্ব, কর্মদক্ষতাই সরকারকে নতুন মাত্রা দিয়েছে। অর্থনীতি করেছে চাঙা। বাংলাদেশ প্রশংসিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। বাংলাদেশের এ পথচলাই হয়তো অনেকের ভালো লাগছে না। এ কারণে সরকারবিরোধী সবচেয়ে বেশি প্রচারণা চলছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। সরকারকে বিব্রত করতে মার্কিন প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কর্মকর্তাদের নামে। সে জটিলতা শেষ না হতেই জাতিসংঘে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর চিঠি আরেক ধরনের শঙ্কা তৈরি করেছে। এ পরিস্থিতি কীভাবে সামাল দেবে জানি না। তবে আগামী নির্বাচন পর্যন্ত এ ধরনের তৎপরতা অব্যাহত থাকবে। যা সরকারকে সামাল দিয়ে যেতে হবে। মোকাবিলা করতে হবে অনেক জটিল পরিস্থিতি।

একটা জটিল সময় পার করছি আমরা। রাজনীতি এখন আর আগের মতো রাজনীতিবিদদের হাতে নেই। সমাজের স্তরে স্তরে নানামুখী সংকট। স্বার্থের জন্য মানুষ মুহূর্তে বদলে যায়। নীতি-আদর্শের চিন্তা করে না। ভেবেছিলাম করোনা মানুষের মধ্যে স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনবে। এখন দেখছি সব বিপরীত দিকেই হাঁটছে। মানুষের মানবিক মূল্যবোধ হারিয়ে যাচ্ছে। মানবিকতা হারিয়ে যাচ্ছে। নষ্ট, ভ-, নোংরাদের যুগ চলছে। মিথ্যাচার ও কুৎসার মধ্যে এরা আনন্দ খুঁজে পায়। বিকৃতির মধ্যে করে উল্লাস। বোঝে না নোংরামি সাময়িক চলে। দীর্ঘ সময় নয়। মানুষ দীর্ঘস্থায়ী হয় তার কাজের মধ্যে। আদর্শের সঠিক ও সুস্থ ধারায় ছিলেন বলেই হাজার হাজার বছর পরও টিকে আছেন সক্রেটিস। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছিল যুবসমাজকে বিপথগামী করার। যুগে যুগে প্রমাণিত হয়েছে তিনিই ছিলেন যুবসমাজের আলোকবর্তিকা। সমালোচকরা রবীন্দ্রনাথ-নজরুলকে ছাড় দেননি। ভুলে গেলে চলবে না যিশুখ্রিস্টকে ক্রুশবিদ্ধ করেছিল একদল মানুষ। আমাদের মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ওপর বারবার আঘাত হেনেছিল মানুষরূপী দানবরা। ইসলামের চার খলিফার তিনজনকে হত্যা করা হয়। মহানবীর প্রিয় দুই নাতিও রেহাই পাননি। বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধুকে পরিবারসহ হত্যা করে দেশ স্বাধীনের সাড়ে তিন বছরের মাথায়। এ নিষ্ঠুর হত্যার পর বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধে কুৎসা রটানো হয়েছিল। মহাত্মা গান্ধী খুন হন ভারতকে স্বাধীন করার অল্প কিছুদিন পরই। তাঁর বিরুদ্ধেও কুৎসা রটানো হয়েছিল।

এই যুগে এই সময়ে মানুষ দাবি করছে তারা সভ্য হয়েছে। বাস্তবতা তা বলে না। ভালো কোনো কিছু আমরা নিতে পারি না। করোনাকাল মানুষকে বদলাতে পারেনি। মানুষের মধ্যে আনতে পারেনি পরিবর্তন। বরং মানুষকে করেছে আরও হিংসাত্মক। কমপক্ষে ১০ জন নোবেলজয়ী নিজের দেশে ন্যূনতম সম্মানটুকু পাননি। যুগে যুগে সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য অবদান রাখা মানুষকে ক্ষত নিয়েই কাটাতে হয়েছিল। সেই সময় আমরা অতিক্রম করতে পারিনি বলেই বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণা থামেনি। ২৪ ঘণ্টা সরকারকে বিব্রত করতে একদল মানুষ সক্রিয়। কিন্তু কুৎসার বিপরীতে শেখ হাসিনা নিজের বলিষ্ঠতা নিয়েই এগিয়ে চলেছেন। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ দিয়েছেন। শেখ হাসিনা বদলে দিচ্ছেন এ দেশকে।

                লেখক : সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।

সর্বশেষ খবর