রবিবার, ৮ মে, ২০২২ ০০:০০ টা

রবীন্দ্রনাথের শ্বশুরবাড়ি দক্ষিণডিহি নিয়ে কিছু কথা

বিধান দাশগুপ্ত

রবীন্দ্রনাথের শ্বশুরবাড়ি দক্ষিণডিহি নিয়ে কিছু কথা

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পূর্বপুরুষের নিবাস এবং তাঁর শ্বশুরবাড়ি খুলনার ফুলতলার দক্ষিণডিহিতে রবীন্দ্র কমপ্লেক্স তৈরির পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সৃষ্টি হয়েছে নানা জটিলতা। রবীন্দ্রনাথ আমাদের সেতু। এ সেতু দিয়ে দক্ষিণডিহি ছুঁয়ে নো-ম্যান্স-ল্যান্ড পার হয়ে আমি পৃথিবীর তাবৎ মানুষকে শান্তির বাণী শোনাতে পারি। বন্ধু কথাসাহিত্যিক অমর মিত্র কথাটি বলেছেন এভাবে : ‘... রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুল, জীবনানন্দ আমাদের সেতু। সেই সেতু দিয়ে ইছামতি পার হয়ে আমি সাতক্ষীরা চলে যেতে পারি। সেই সেতু আমাকে নিয়ে যেতে পারে ধুলিহর গ্রামে। আমি যদি কোনো দিন ধুলো মেখে ফিরি সেইখানে সন্ধ্যার অন্ধকারে কলকল করে উঠবেন তারা, কে এলো দ্যাখ, ওরে তোর মনে আছে আমাদের...।’ (ব্রাত্যজনের কবি : অমর মিত্র/ডাক দিয়ে যাই : দক্ষিণডিহি রবীন্দ্র কমপ্লেক্স প্রকাশনা প্রকাশকাল : ২৫ বৈশাখ ১৪০৭)। সেই কবে, সম্ভবত আশির দশকের গোড়ায় ইতিহাসবিদ সতীশচন্দ্র মিত্রের ‘যশোর-খুলনার ইতিহাস’ পড়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের পূর্বপুরুষের নিবাস, শ্বশুরবাড়ি ও মামাবাড়ির ইতিহাস খুঁজতে অনুসন্ধানী হয়ে উঠেছিলাম। তথ্যসমৃদ্ধ এ বইটি আমি প্রথম পড়ি সত্তর দশকের মাঝামাঝি। স্নেহভাজন অণীশ মন্ডল (ড. অণীশ মন্ডল এখন বরিশালের কোনো এক নামি কলেজের ইংরেজি সাহিত্যের বিভাগীয় প্রধান)-এর সঙ্গে প্রায় সারা রাত আলোচনা করেছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের তুখোড় ছাত্র অণীশ মন্ডল তখন আমার সারা দিন-রাতের সঙ্গী। সাহিত্য, সংগীত, চিত্রকলা, চলচ্চিত্র, কৃষি, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, রাজনীতি-অর্থনীতি-সমাজনীতি-ঘরোয়া নীতি- প্রায় সবকিছু আমাদের আলোচনার বিষয়। নিত্যনতুন বিষয়ের প্রতি আমাদের আগ্রহ। হাতের কাছে যা পাই তা-ই গোগ্রাসে গিলছি। শেখাটাকে একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ মনে করছি। ভিতরে সততা আর সাহস। পড়ছি একাধারে মার্কস, লেনিন, মাও সে তুং, বঙ্গবন্ধু, ব্রেশট, পিকাসো, কাফকা, কাম্যু, এলিয়ট, জীবনানন্দ, অ্যাপল সার্ত, ব্যুভোয়া, বিভূতি, তারাশঙ্কর, মানিক, জ্যোতিরিন্দ্র, কমলকুমার, মহাশ্বেতা, ইলিয়াস, হাসান সব স-অ-ব। ঠিক এ সময়ে পাঠকপ্রিয় সাপ্তাহিক ‘এখনই সময়’-এর হয়ে প্রতিবেদন করতে নিজবাসভূমে ফিরে আসা। বিশিষ্ট টিভি ব্যক্তিত্ব আইন ভাষ্যকার ‘আইন আদালত’ খ্যাত রেজাউর রহমান সব ব্যবস্থা করে দিলেন। যশোর ও খুলনার জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারকে জানিয়ে দিলেন আমার ওপর নজর রাখতে। বিপদ ঘটতে পারে এমন আশঙ্কা করেছিলেন তাঁরা। পুরো এক মাস তথ্যানুসন্ধানে ঘুরে বেড়িয়েছি। স্থানীয় সাংবাদিক মহাতাবউদ্দিন (বন্ধু মহাতাবউদ্দিন তখন দৈনিক আজাদের নিজস্ব প্রতিনিধি), সাংবাদিক মুস্তাফিজুর রহমান, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবদুর রউফ চৌধুরী আমাকে প্রত্যক্ষ সহযোগিতা করেছেন। শ্রুতির ওপর নির্ভর করতে হয়েছে বেশির ভাগ। অনেক অজানা তথ্য দিয়েছেন প্রয়াত প্রখ্যাত চিকিৎসক ডা. সুনীলকুমার কুন্ডু। ডা. সুনীলের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের শ্যালকপুত্রদের হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। এসব অজানা তথ্য দিয়ে এখনই সময় ২ ডিসেম্বর ১৯৮৭, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৩৯৪ ‘রবীন্দ্রনাথের শ্বশুরবাড়ি বেদখল’ শিরোনামে প্রচ্ছদ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে অনেক পত্রিকা পাঠক বিস্ময়ের ঘোর নিয়ে তাঁদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। লেখেন ‘...আমি কোনো আরব্য রজনীর গল্প শোনাচ্ছি কি না!’ যশোরের অভয়নগর থেকে মযহার জীবন লেখেন, ‘প্রতিবেদনটিতে... আমাদের সাহিত্য সংস্কৃতির এমন অধ্যায় তুলে ধরেছেন যা নিঃসন্দেহে সুধী পাঠককে চমকে দিয়েছে।’ (পাঠককণ্ঠ; এখনই সময় ২৯ মে ১৯৮৮, ১৫ জ্যৈষ্ঠ ১৩৯৫)। ওই নিবন্ধ সম্পর্কে এখনই সময়ের বর্ষপূর্তি সংখ্যায় বিশিষ্ট কবি, শিশুসাহিত্যিক, সাংবাদিক আবু কায়সারের (এখন প্রয়াত) মূল্যায়ন : ‘রবীন্দ্রনাথের শ্বশুরবাড়ি বেদখল’ এ সময়ের একটি মূল্যবান প্রতিবেদন’। (আমাদের এক বছর/এখনই সময় : ২২ নভেম্বর ১৯৮৮, ৬ অগ্রহায়ণ ১৩৯৫)। সাপ্তাহিক এখনই সময় থেকে দৈনিক জনকণ্ঠ- সুদীর্ঘ আট বছর রাজনীতি, সমাজনীতি, পঠনপাঠন, লেখালেখি আর জীবনের জটিল সম্পাদ্য কষতে কষতে সময় কেটেছে আমার। সে সময় সৃষ্টির মধ্য দিয়ে বেঁচে থাকার একটা প্রচ- আকুতি শুরু হয়। কিন্তু সাধারণ নিম্নবিত্তের সংসারে একজন মানুষের অনেক কিছুই হয় না। তাকে শুধু আকাশভরা স্বপ্ন দেখতে হয়। আমি কি তখন একজন স্বপ্নবাজ মানুষ? কিংবা স্বপ্নের ফেরিওয়ালা? বাস্তবিক তা-ই। কোটি কোটি স্বপ্ন নিয়ে যাত্রা হয়। পলিবিধৌত বিলডাকাতিয়ার গ্রাম থেকে আলোকোজ্জ্বল স্বপ্নপুরী। সে স্বপ্নের ঘুড়ি একসময় দখল করে নেয় সমগ্র পৃথিবীর আকাশ। কিছু পূর্ণ হয়, বেশির ভাগ অধরা। পুঁতিগন্ধময় ডাস্টবিনে মুখ থুবড়ে পড়ে স্বপ্নগুলো যন্ত্রণায় কাতরাতে থাকে। ‘...এ কথা আমি আগেও বলেছি, আবারও বলছি। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বাংলাদেশে এবং পশ্চিমবঙ্গে এমনকি পাশ্চাত্যে অসংখ্য বই প্রকাশিত হয়েছে। রবীন্দ্রজীবন নিয়েও লেখালেখির পরিমাণ কম নয়। কিন্তু বিস্ময়কর হলেও সত্য, রবীন্দ্রনাথের আদিপুরুষদের বাড়ি, শ্বশুরবাড়ি এবং মামাবাড়ি প্রসঙ্গে লেখালেখি বরাবর উপেক্ষিত থেকেছে। কবিগুরুর খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে রবীন্দ্র গবেষকদের আগ্রহের অভাব না থাকলেও কেন যে তাঁরা এদিকে নজর দেননি তা অবাক করার মতোই।’ (দক্ষিণডিহি রবীন্দ্র কমপ্লেক্স ও রবীন্দ্রনাথের শ্বশুরবাড়ি উপাখ্যান; সুমন পালিত/দৈনিক যুগান্তর : ২৬ নভেম্বর ২০০৪, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪১১)। এমনকি রবীন্দ্র বিষয়ে উৎসাহী অনেক পাঠক গবেষককে এ নিয়ে আমি সে সময় অজ্ঞতা প্রকাশ করতে দেখেছি। মহৎ মানুষের যাপিত জীবন এবং জীবনস্মৃতি যে কোনো জাতির জন্য অনুসরণীয়। তা শুধু ইতিহাসের অংশ নয়, আত্মনির্মাণের ক্ষেত্রেও অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। এ বোধে প্রাণিত হয়ে এখনই সময়ের পর দৈনিক জনকণ্ঠে ‘কালের অতলে হারিয়ে যাচ্ছে ইতিহাস : বিশ্বকবির স্মৃতিবিজড়িত শ্বশুরবাড়ি বেদখল’ শীর্ষক সংবাদ প্রতিবেদন প্রকাশ করি। ১৯৯৩ সালের ১৯ এপ্রিল সংবাদটি ছবিসহ প্রকাশিত হয়। একই সময়ে দৈনিক আজকের কাগজেও সংবাদটি পরিবেশন করি। এরপর ১৯৯৪ সালের ৮ মে বিশ্বকবির জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে দৈনিক জনকণ্ঠের শেষ পৃষ্ঠায় অর্ধপৃষ্ঠা জুড়ে ‘খুলনার ফুলতলায় রবীন্দ্রনাথের শ্বশুরবাড়ি : এক অজানা কাহিনী, অন্য ইতিহাস’ শীর্ষক দীর্ঘ প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে তা সুধীমহলে ব্যাপক সাড়া জাগায়। প্রশাসনের সম্বিৎ ফিরে পেতে এ লেখাটি বিশেষ ভূমিকা রাখে। ১৯৯৩ সালের ১৩ ডিসেম্বর মিসেস শামীমা সুলতানা নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্ব নিয়ে ফুলতলা উপজেলায় যোগদান করেন। ফুলতলার সঙ্গে তখন আমার যোগাযোগ নিতান্তই কম। জীবিকাসূত্রে বেশির ভাগ ঢাকায় অবস্থান করি। ফুলতলায় বন্ধু বলতে কথাসাহিত্যিক অচিন্ত্যকুমার ভৌমিক, সংগঠক সংস্কৃতিকর্মী দেবরঞ্জন সেন, শেখ লুৎফর রহমান ও বরুণকুমার মিত্র ওরফে নান্টুদা। সে সময় টেলিযোগাযোগ অত সহজলভ্য হয়নি। অচিন্ত্যদার সঙ্গে চিঠিপত্রের মাধ্যমে সবার খোঁজখবর পাই। আমার মনে আছে, ১৯৯৪ সালের মাঝামাঝি অর্থাৎ মে বা জুনে প্রথম আমি নির্বাহী কর্মকর্তা শামীমা সুলতানার মুখোমুখি হই। নিজের পরিচয় জানিয়ে দৈনিক জনকণ্ঠে প্রকাশিত প্রতিবেদনের পেপার কার্টিং তাঁর হাতে তুলে দিয়ে রবীন্দ্রনাথের শ্বশুরবাড়ির জমি ও বাড়ি উদ্ধার করতে এগিয়ে আসার আহ্বান জানাই। এর ঠিক এক বছর পর প্রশাসন বাড়ি ও জমি উদ্ধারে এগিয়ে আসে। এ সংবাদটিও আমি দৈনিক জনকণ্ঠে প্রথম প্রকাশের জন্য পরিবেশন করি। এখানে আমি বিনীতভাবে রবীন্দ্রনাথের শ্বশুরবাড়ি ও জমি উদ্ধারের যাবতীয় কৃতিত্ব শামীমা সুলতানাকে দিতে চাই। তাঁকে সহযোগিতা করেন সহকারী কমিশনার (ভূমি) অমিতাভ সরকার এবং এ প্রক্রিয়ায় উল্লেখযোগ্য নিয়মতান্ত্রিক প্রশাসনিক ভূমিকা পালন করেন জেলা প্রশাসক কাজী রিয়াজুল হক। রবীন্দ্র কমপ্লেক্সের ইতিহাসে তাঁদের অবদান অম্লান হয়ে থাকবে। ১৯৯৫ সালের ১৪ নভেম্বর দক্ষিণডিহি রবীন্দ্র কমপ্লেক্স প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর যাবতীয় কাজকর্মে ভাটা পড়ে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পরপর প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা ঢাকায় বদলি হন। আর তাই প্রথম রবীন্দ্রজয়ন্তী ও লোকমেলা উদ্যাপন করতে কোনো উৎসাহী মুখ খুঁজে পাওয়া যায় না। স্বয়ং জেলা প্রশাসক মজিবুর রহমান এ বিষয়ে নিরুৎসাহ করেন। তিনি বলেন, ‘নিজের শ্বশুরবাড়ি যাবারই সময় নেই আর কোথায় রবীন্দ্রনাথের শ্বশুরবাড়ি!’ রবীন্দ্র কমপ্লেক্সের আরেক উদ্যোক্তা সংগঠক বিশিষ্ট সংস্কৃতিকর্মী দেবরঞ্জন সেন ‘দক্ষিণডিহি রবীন্দ্র কমপ্লেক্সে প্রথম রবীন্দ্রজয়ন্তী ও মেলা’ প্রবন্ধে লেখেন, ‘...পদাধিকারবলে কমিটির আহ্বায়ক জেলা প্রশাসক মজিবুর রহমানের কোনো উৎসাহ বা উদ্যোগ বা উচ্চবাচ্য নেই। ...২৫ বৈশাখ সমাগত। ...দুজনে একমত হয়ে গেলাম ফুলতলা ইউপি চেয়ারম্যান আবদুর রাজ্জাক রাজার কাছে। একটি বড় সভা হলো। শুরু হলো পাঁচ দিনব্যাপী রবীন্দ্রজয়ন্তী ও মেলা।’ (আমি তোমাদেরই লোক; দেবরঞ্জন সেন/প্রকাশকাল : মে ১৯৯৭, বৈশাখ ১৪০৪, দক্ষিণডিহি রবীন্দ্র কমপ্লেক্স প্রকাশনা)। এভাবে শুরু হয় বাঙালি সংস্কৃতির সর্বোজ্জ্বল ইতিহাসের এক নতুন অধ্যায়। ১৪০৩ সালের ২৫ বৈশাখ রবীন্দ্রজয়ন্তী ও লোকমেলায় হাজারো মানুষের ঢল নামে। নতুন প্রণোদনা নিয়ে এগিয়ে আসেন বিশিষ্ট শিল্পপতি ও সমাজ সংগঠক কাজী খেলাফাত হোসেন। নেপথ্যচারী, শিল্পরসিক এই মানুষটির পয়মন্ত হাত দক্ষিণডিহির উন্নয়নের সরকারি- বেসরকারি সব কাজকর্ম ত্বরান্বিত করে। আমরা পেয়ে যাই সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান আবদুর রাজ্জাক রাজা, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, সংগঠক প্রফেসর মু. কায়কোবাদ, অধ্যাপক মুকতি মজুমদার, বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক, কথাসাহিত্যিক অচিন্ত্যকুমার ভৌমিক, সংস্কৃতিকর্মী, সংগঠক শেখ লুৎফর রহমান, বরুণকুমার মিত্র, মানিকলাল কুন্ড, প্রফেসর সাধনরঞ্জন ঘোষ, অধ্যাপক শফিউল্লাহ সরদার, প্রফেসর ডা. গাজী আবদুল হক, প্রফেসর ডা. কাজী শহিদুল আলম, সংগীতশিল্পী নওরোজ আলী ফারাজি, সংস্কৃতিকর্মী গৌরহরি দাসসহ সব পেশার সর্বস্তরের মানুষকে। ফুলতলার স্থানীয় সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব শিক্ষক আনোয়ারুজ্জামান মোল্লা, কাওসার আলী জমাদ্দার, আনসার আলী মোল্লা দক্ষিণডিহির গর্বকে ধারণ করে সব কাজেই শরিক হন। ১৯৯৬ সালের ২৪ এপ্রিল দক্ষিণডিহি রবীন্দ্র কমপ্লেক্সকে জাতীয় পর্যায়ে অন্তর্ভুক্তির জন্য পদক্ষেপ নেওয়া হয়। এ কাজে সহযোগিতা করেন সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব কাজী শামসুল আলম, সাবেক সচিব প্রকৌশলী কামরুল ইসলাম সিদ্দিক, সাবেক সংস্কৃতি সচিব সৈয়দ আবদুর রব, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির সংগীত ও নৃত্যকলা বিভাগের সাবেক পরিচালক, শব্দসৈনিক প্রয়াত শহিদুল ইসলাম, বিশিষ্ট রবীন্দ্রগবেষক, রবীন্দ্রচর্চা কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা আহমদ রফিক, বিশিষ্ট কবি বেলাল চৌধুরী, কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা, সাবেক অতিরিক্ত সচিব বি সি দেবনাথ, সাবেক অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক খুলনার মহিউদ্দিন আহমেদ, ফেরদৌস মোল্লা প্রমুখ। কলকাতার বিশিষ্ট সংস্কৃতিকর্মী সুশীল সাহা প্রকাশনার কাজে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেন। ১৯৯৯ সালের ১৮ নভেম্বর, ৪ অগ্রহায়ণ ১৪০৫ বৃহস্পতিবার এক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত বিভিন্ন পোস্টার, ব্যানার, ফেস্টুন, স্মারক ও প্রচারপত্রে দক্ষিণডিহির নাম সংযুক্ত হয়। প্রকৃতপক্ষে এ সময় থেকে দক্ষিণডিহি রবীন্দ্র কমপ্লেক্স বাংলাদেশ সরকারের স্বীকৃতি অর্জন করে।

দুই. দুঃখের পুনরাগমন কেউ কামনা করে না। তবু এ হতভাগ্য দেশে ‘দুঃখের বারো মাস’ যেন নিয়মে দাঁড়িয়ে গেছে। ১৯৯৫ থেকে ২০২১- কতটুকু এগিয়েছে দক্ষিণডিহি রবীন্দ্র কমপ্লেক্স? ৮ মে ১৯৯৬, ২৫ বৈশাখ ১৪০৩ রবীন্দ্রজয়ন্তী ও লোকমেলায় ঢাকা থেকে বিশিষ্ট রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী অজিত রায়, রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, তপন মাহমুদ, সাদী মোহাম্মদ ও বিশিষ্ট নৃত্যশিল্পী শিবলী মোহাম্মদ ও শামীম আরা নীপা দক্ষিণডিহিতে আসেন। ছয় বছর পর ৮ মে ২০০২, ২৫ বৈশাখ ১৪০৯ বন্যা দ্বিতীয়বার দক্ষিণডিহিতে মৃণালিনী মঞ্চে গান শুরুর আগে ক্ষোভ নিয়ে বলেন, ‘... আমি দেখতে পাচ্ছি দক্ষিণডিহি এই পাঁচ বছরে এক কদমও এগোয়নি। যেখানে ছিল, যে অবস্থায় ছিল সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে...।’ বন্যার কথা কি একেবারে মিথ্যা? তাঁর কথা অস্বীকার করার উপায় কী? কী বলবেন রবীন্দ্র কমপ্লেক্সের কর্তাব্যক্তিরা? জবাবে এ লেখার সত্য উচ্চারণ করে আমি কিছুটা দায়মুক্ত হতে চাই। রবীন্দ্রনাথ আজও এই বাংলাদেশে এক সাম্প্রদায়িক মানুষ ও কবি হিসেবে বিবেচিত। বলা দরকার, সাম্প্রদায়িকবাদী রাষ্ট্র পাকিস্তান জন্মের পর থেকে কবিকে সাম্প্রদায়িক হিসেবে চিহ্নিত করে এই রবীন্দ্রবিরোধিতা শুরু হয়েছে। এ বিরোধিতার সঙ্গে এসে মিশেছে বিদ্বেষ। এখনকার বাংলাদেশে তার মাত্রা আরও বেড়েছে বলে মনে হয়। পূর্ব পাকিস্তানের এবং বাংলাদেশের রবীন্দ্রবিরোধিতার স্বরূপ ঠিক এক জাতীয় নয়, বাংলাদেশের এ বিরোধিতা একটি ভিন্নমাত্রা ধারণ করেছে।’ (বঙ্গভঙ্গ রবীন্দ্রনাথ বাংলাদেশ : প্রসঙ্গ : ড. হাবিব রহমান/কালসমুদ্রে আলোর যাত্রী; দক্ষিণডিহি রবীন্দ্র কমপ্লেক্স প্রকাশনা)। এখানে অভাব আছে যেমন মিসেস শামীমা সুলতানার মতো দেশপ্রেমিক ও সৎ প্রশাসকের, তেমনি অভাব নেই মজিবুর রহমানের মতো উন্নাসিক, স্বার্থপর ও সাম্প্রদায়িক লোকদের। সংস্কৃতি, রাজনীতি ও প্রশাসনিক এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে যুক্তিহীনতা, বলপ্রয়োগের প্রবণতা ও কর্তৃত্ববাদী মনোভাব। রাষ্ট্রীয় পর্যায় আছে চোরাস্রোতের মতো সাম্প্রদায়িকতার লালনপালন। দেশের সংবিধান এখনো সাম্প্রদায়িকতামুক্ত নয় এবং তার বিকাশ যখন অসম্পূর্ণ, তখন রবীন্দ্রবিদ্বেষ বাড়তে থাকবে এতে বিস্মিত হওয়ার কী আছে? এখন কাটমোল্লারা শিল্প-সংস্কৃতির অভিভাবকত্ব দাবি করছে। কিন্তু কে তাকে দায়িত্ব দিয়েছে অভিভাবকত্ব করার?

তিন. বেশ ক’বছর আগে ঢাকার প্রথম শ্রেণির দৈনিকে ‘রবীন্দ্রশয্যায় কালো কুকুর’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলাম। ওই প্রবন্ধে দক্ষিণডিহি প্রসঙ্গে রবীন্দ্রবিদ্বেষের উল্লেখ ছিল। পাকিস্তান আমলে একসময় নিষিদ্ধ ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। একশ্রেণির বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, পত্রিকা সম্পাদক এ স্বৈরাচারের সঙ্গে কোরাস গেয়েছেন। ১৯৯৫ সালের ১৪ নভেম্বর দক্ষিণডিহি রবীন্দ্র কমপ্লেক্স প্রতিষ্ঠিত হলেও অদ্যাবধি পরিকল্পিত কাজের কোনো বাস্তবায়ন হয়নি। শুধু বাড়ি সংস্কার ও জমির সীমানা নির্ধারণের জন্য প্রাচীর তোলা হয়েছে। সাবেক জেলা প্রশাসক কাজী রিয়াজুল হক কর্তৃক তড়িঘড়ি করে রবীন্দ্রনাথ ও মৃণালিনীর আবক্ষ মূর্তি স্থাপন করা হয়েছে বটে, কিন্তু বলে না দিলে সাদা চোখে তাদের চেনার উপায় নেই। দক্ষিণডিহি কমপ্লেক্স প্রতিষ্ঠার পরও এ ফুলতলায় এমনকি খুলনায়ও কোনো সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড নেই। দক্ষিণডিহিতে কোনো আয়োজন হয় না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী শিক্ষাবিদ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘সংস্কৃতি সভ্যতার চেয়ে মূল্যবান। সংস্কৃতিচর্চা না করলে দেশ ও মানুষ এগোতে পারে না। তাই আমাদের সুস্থ ও সমাজ পরিবর্তনমুখী সংস্কৃতিচর্চায় যুক্ত হতে হবে।’ আমাদের ভাগ্য ভালো, এখন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা নিজেই একজন সংস্কৃতিমান মানুষ। তিনি রবীন্দ্রনাথকে ভালোবাসেন, রবীন্দ্রসংগীত ভালোবাসেন। আর তাই এই রবীন্দ্রচিন্তা, রবীন্দ্রভাবনা সমস্ত বিপন্নতা থেকে আমাদের মুক্তি দিতে পারে।

                লেখক : দক্ষিণডিহি রবীন্দ্র কমপ্লেক্সের উদ্যোক্তা, সাংবাদিক ও গবেষক।

সর্বশেষ খবর