শিরোনাম
বুধবার, ২৫ মে, ২০২২ ০০:০০ টা

বিবেকের কবি নজরুল

অধ্যাপক ডা. মো. শহীদুল্লাহ সিকদার

বিবেকের কবি নজরুল

কোনো বৃত্ত যাকে বাঁধতে পারেনি, বাধা যাকে আটকাতে পারেনি, অদম্য প্রাণশক্তি, অতুলনীয় মেধা যাকে ভুবনজয়ী কবি বানিয়েছে তিনি কাজী নজরুল ইসলাম। নজরুল পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন ১১ জ্যৈষ্ঠ, ইংরেজি ১৮৯৯ সালের ২৪ মে। তিনি নয় বছর বয়সে বাবাকে হারান। কাজেই নজরুলকে দারিদ্র্যের সঙ্গে সংগ্রাম করে নিজেকে তৈরি করতে হয়। তিনি দশম শ্রেণিতে অধ্যয়নকালে প্রি-টেস্ট পরীক্ষার আগে বাঙালি পল্টনে যোগদানের মাধ্যমে চাকরি শুরু করেন। নজরুল প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া বেশিদূর করতে পারেননি। কিন্তু তিনি নিজের পাঠশালায় বাংলার পাশাপাশি সংস্কৃত, হিন্দি, ফারসি, আরবি, উর্দু ও ইংরেজি ভাষায় পান্ডিত্য অর্জন করেন। কবি নজরুলকে বিদ্রোহের কবি, সাম্যের কবি, প্রেমের কবি বলা হয়। এমন একজন অসামান্য প্রতিভাধর মানুষকে একটি নির্দিষ্ট বিশেষণের মাধ্যমে প্রকাশ করা অসম্ভব। এমনকি তাঁকে শুধু কবি বলে আখ্যায়িত করলেও সঠিকভাবে প্রকাশ করা যায় না। তাঁর বহুমাত্রিক প্রতিভার ছোঁয়ায় বাংলা সাহিত্যের কবিতা, গান, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, ছোটগল্পসহ সব শাখায় অভূতপূর্ব সমৃদ্ধি লাভ করে। বাংলা সাহিত্যে নজরুল সর্বাধিক প্রায় ৫ হাজার গান রচনা করেন। তাঁর গানের মধ্যে পালাগান, পল্লীগীতি, লোকসংগীত, বাউল, দেশের গান, গজল, হামদ-নাত, শ্যামাসংগীত, ভজন, কীর্তনসহ বহুমাত্রিক গানের সমাহার সমভাবে দেখতে পাওয়া যায়। তিনি গান রচনা করেছন, স্বরলিপি দিয়েছেন, সুরারোপ করেছেন, নিজে গান গেয়েছেন এবং গানের সঙ্গে অভিনয়ও করেছেন। তাঁর গানে-কবিতায় আমরা বিভিন্ন ভাষা ও বাণীর যে গভীরতা দেখতে পাই তা নজরুলের মেধা, শ্রম এবং সাধনার অসাধারণ এক সৃষ্টি। যা শুধু বাংলা সাহিত্যে নয়, বিশ্ব সাহিত্য অঙ্গনেও খুঁজে পাওয়া কঠিন। তার কারণ তিনি নিষ্ঠার সঙ্গে বিভিন্ন ভাষা, পুরাণ মিথ, ধর্মশাস্ত্র ও শিল্পচর্চায় নিবেদিত ছিলেন নিজের জাগতিক কাজের মধ্যেও। সংগীতের অতুলনীয় এ স্রষ্টাকে গানের বুলবুল বলা হয়। তিনি কবিতা ও সংগীতচর্চার পাশাপাশি সমাজ ও দেশের জন্য সচেতনভাবে কাজ করেছেন। সমাজ ও দেশের কল্যাণে তাঁর রাজনৈতিক দর্শন এবং নিবেদিতপ্রাণ কর্মকান্ডে তৎকালীন বাংলা-ভারতের মানুষ উজ্জীবিত হয়, যা এ ভূখন্ডের মানুষের মুক্তির ও অধিকারের আন্দোলনের সংগ্রামে নিরন্তর প্রেরণা জুগিয়ে যাচ্ছে। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে নজরুলের গান-কবিতা আন্দোলন-সংগ্রামের অসামান্য প্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৭২ সালে কবিকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। ১৯৭৬ সলে কবি যখন শারীরিকভাবে খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন তখন তাঁকে তৎকালীন পিজি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সে সময় কবিকে দেখতে ১১৭ নম্বর কেবিনে গিয়েছিলাম। নজরুলের বিদ্রোহ ছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অত্যাচারের বিরুদ্ধে, নিপীড়নের বিরুদ্ধে, শোষণের বিরুদ্ধে, বঞ্চনার বিরুদ্ধে, অবহেলার বিরুদ্ধে, নিগ্রহের বিরুদ্ধে- কল্যাণের জন্য, মানবতার জন্য, ন্যায়ের জন্য, সত্যের জন্য, সুন্দরের জন্য, মানুষের মুক্তির জন্য। এ মুক্তির বাণী, এ বিদ্রোহের ফসল শুধু বাংলাদেশ বা তৎকালীন ব্রিটিশ-ভারতের পরাধীন মানুষের জন্য নয়, সেটি সর্বকালের, সব জাতির, সব মানুষের কল্যাণে নিবেদিত। পরবর্তীতে তাঁর সব কর্মে তা আমরা দেখতে পাই। তিনি কোনো দিন কোনো কারণেই মানুষের মুক্তির কথা, সত্যের কথা, ন্যায়ের কথা- না ভয়ে, না লোভে, না কিছু প্রাপ্তির মোহে উচ্চারণ করতে পিছপা হননি। তাঁর যত কর্ম, যত বিদ্রোহ, যত লেখা সবই মানুষের কল্যাণে উৎসর্গকৃত। আমরা তাঁকে পাই রাজনীতিতে নিপীড়িতের পক্ষে, গরিবের পক্ষে, একজন নিবেদিতপ্রাণ দার্শনিকের ভূমিকায়। নজরুল ১৯২০ সালে জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু তিনি পরাজিত হন। নজরুলের মতো এমন একজন বিশাল হৃদয়ের মানবতাবাদী মহান ব্যক্তি, দেশপ্রেমিক, আদর্শবান, মানবকল্যাণে নিবেদিত, উদার হৃদয়ের মানুষ নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে জয়লাভ করতে পারেননি। কংগ্রেসসহ কোনো প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল তাঁকে সমর্থন দেয়নি। প্রচলিত দলবাজির রাজনীতি মানুষের কল্যাণে অবদান রাখতে কতটুকু সমর্থ হয় সে প্রশ্নটি নজরুলের নির্বাচনে পরাজয়ের মাধ্যমে খুব বড় হয়ে সামনে চলে আসে। রাজনীতির ইতিহাসে দীনতা অতীতে যেমন ছিল বর্তমানেও তা অনেক ক্ষেত্রেই দৃশ্যমান। ১৯১৭ সালে রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ধারায় সারা বিশ্ব যখন অনুপ্রাণিত হয়, ভারতবাসীকেও তখন সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির ঢেউ আন্দোলিত করে। ১৯২১ সালে বাংলাদেশের সন্দ্বীপের সন্তান কমরেড মুজফ্ফর আহমদ কলকাতার ৩২ নম্বর তালতলা লেনে নজরুলের সঙ্গে মিলে উপমহাদেশের প্রথম সমাজতান্ত্রিক দল গঠন করেন যেখানে এম এন রায়সহ আরও অনেকেই সংশ্লিষ্ট ছিলেন।

১৯২১ সালে নজরুল সমগ্র ভারতের হরতালের পক্ষে পথে নেমে আসেন, অসহযোগ মিছিলের সঙ্গে কুমিল্লা শহর প্রদক্ষিণ করেন এবং গান করে সবাইকে অনুপ্রাণিত করেন ‘ভিক্ষা দাও, ভিক্ষা দাও, ফিরে চাও হে পুরবাসী।’ নজরুলের ওই সময়কার কবিতা, গান ও প্রবন্ধের মধ্যে বিদ্রোহের ভাব সবচেয়ে বেশি স্পষ্ট হয়ে ফুটে ওঠে। সবচেয়ে বড় উদাহরণ ‘বিদ্রোহী’ নামক কবিতাটি। কুমিল্লা থেকে কলকাতায় ফেরার পথে তিনি এ কবিতাটি রচনা করেন। আজ থেকে শতবর্ষ আগে প্রকাশিত (১৯২২) তাঁর ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি এখনো সমভাবে সবাইকে উদ্দীপ্ত করে। কবিতায় নজরুল নিজেকে তুলে ধরেন-

‘মহা-বিদ্রোহী রণক্লান্ত

আমি সেই দিন হব শান্ত।

যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে-বাতাসে ধ্বনিবে না,

অত্যাচারীর খড়্গ কৃপাণ ভীম রণ, ভূমে রণিবে না-

বিদ্রোহী রণক্লান্ত

আমি সেই দিন হব শান্ত।’

নজরুল গরিবের পক্ষে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে, ন্যায়ের পক্ষে, কায়েমি স্বার্থবাদীদের বিরুদ্ধে, অত্যাচার, লুটতরাজ, শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে- ন্যায়ের পক্ষে, শোষণমুক্তির পক্ষে, মানবতার পক্ষে সর্বদাই অবিচল ছিলেন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ নজরুলের কবি-প্রতিভা এবং রাজনৈতিক আদর্শের প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। তাই তিনি নজরুলকে আশীর্বাদ করে লিখেছিলেন- ‘আয় চলে আয় ধূমকেতু, আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু...।’

জন্মদিনে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের প্রতি শ্রদ্ধা।

লেখক : সাবেক উপউপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর