বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম স্মরণীয় ও মহাগৌরবের একটি দিন ২৫ জুন, ২০২২। প্রায় ১৭ কোটি মানুষের দীর্ঘ অপেক্ষার প্রহর শেষে অপার সম্ভাবনা নিয়ে প্রমত্তা পদ্মা পাড়ি দিচ্ছে নানা যানবাহন। ২৫ জুন অবিশ্বাস্য এক মহাকাব্য রচিত হলো পদ্মার বুকে, প্রমত্তা পদ্মার দুই কূল ছাপিয়ে যার উচ্ছ্বসিত ঢেউ লেগেছে গোটা বিশ্বে। মেগা প্রকল্পের উর্বরভূমি চীন-জাপান-যুক্তরাষ্ট্র-কানাডাসহ বিভিন্ন রাষ্ট্র থেকে আসছে শুভেচ্ছা বার্তা। বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ়প্রত্যয় ও দেশবাসীর অকুণ্ঠ সমর্থনে পৃথিবীর চ্যালেঞ্জিং প্রকৌশল নিদর্শন হিসেবে মুগ্ধতা ছড়াচ্ছে পদ্মা সেতু। গণমানুষের মোহ যেন কাটছেই না। তাই তো সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত হওয়ার আগেই বিধিনিষেধ উপেক্ষা করে ২৫ জুন দুপুরেই উঠে পড়ে নিজের টাকায় নির্মিত সেতুতে। ২৬ জুন প্রথম প্রহরেই পদ্মা সেতু সবার জন্য উন্মুক্ত হওয়ার কথা থাকলেও আগের দিন মধ্যরাত থেকেই দুই পাশে জড়ো হতে থাকে নানা ধরনের যান। কেউ এসেছে শুধু একনজর দেখতে, কেউবা যাবে আপন গন্তব্যে। দেশের এক-তৃতীয়াংশ জনগোষ্ঠীকে ঢাকার সঙ্গে সড়কপথে সংযোগ ঘটানো এ সেতুর বদৌলতে ভোরে পদ্মার ওপারের জমি থেকে তোলা ফসল সকালেই পৌঁছে গেছে রাজধানীর পাইকারি আড়তগুলোয়; যা অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে ওপারের মানুষের কাছে। এ অবিশ্বাস্য কাজটিই সম্ভব হলো দেশের অন্যতম বৃহৎ মেগা প্রকল্প পদ্মা সেতুর আশীর্বাদে। দেশে এরূপ ২০-এর অধিক মেগা প্রকল্পের বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া চলমান, যার মধ্যে ১০টি প্রকল্পকে সরকার ‘ফাস্ট-ট্র্যাক’ বা ‘অগ্রাধিকারমূলক প্রকল্প’ হিসেবে ঘোষণা করেছে।
নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগব্যবস্থা ও বিদ্যুতের সরবরাহ টেকসই উন্নয়নের প্রধান নিয়ামক। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে বিপুল পরিমাণ জনগোষ্ঠীকে কাজে লাগানোর জন্য সম্পদের পরিমাণ সীমিত। এ সীমিত সম্পদের উপযুক্ত ব্যবস্থাপনাই হতে পারে উন্নয়নের প্রধান হাতিয়ার। ২০০৭ সালে বাংলাদেশ প্রবেশ করেছে ‘জনমিতিক লভ্যাংশ’ বা ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড’-এর যুগে যা ২০৩৮ সাল পর্যন্ত স্থায়ী হবে। ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড কাজে লাগিয়ে জাপান, চীন, মালয়েশিয়া, আর্জেন্টিনার মতো দেশ তাদের উন্নয়নের ধারা করেছে শানিত। পঁচাত্তর-পরবর্তী বাংলাদেশের অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ তেমন বড় বিদেশি বিনিয়োগ দেশে আসতে দেয়নি। ১৯৯৬-এর পর থেকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নানামুখী পদক্ষেপে দেশে বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে গতি সঞ্চার হয়েছে যেগুলো ‘মেগা প্রকল্প’ নামে পরিচিত। ইতোমধ্যে মেগা প্রকল্পের সুফল পেতে শুরু করেছে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ব্যবহারকারীরা। প্রায় ২৫০ কিমি দীর্ঘ ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক তৈরির ফলে আগের চেয়ে অনেক কম সময়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম আসা-যাওয়া করা যায়। আর পদ্মা সেতুর উপযোগিতা প্রথম দিনই পরিলক্ষিত হয়েছে। বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের দেওয়া তথ্যানুসারে ২৬ জুন সকাল ৬টা থেকে ২৭ জুন সকাল ৬টা পর্যন্ত পদ্মা সেতু দিয়ে পারাপার হয়েছে ৫১ হাজার ৩১৬টি যানবাহন এবং টোল আদায় হয়েছে ২ কোটি ৯ লাখ ৪০ হাজার ৩০০ টাকা।
বাংলাদেশে গৃহীত মেগা প্রকল্পগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে : পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প, মেট্রোরেল (ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট), রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পদ্মা সেতু রেলসংযোগ, মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর ও কক্সবাজার-দোহাজারী-রামু-ঘুমধুম রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প। প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হলে দেশের প্রবৃদ্ধি ও মানুষের মাথাপিছু আয় বাড়বে, ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি সঞ্চার হবে, সুযোগ সৃষ্টি হবে কর্মসংস্থানের। ২০৩০ সালে ক্ষুধামুক্ত, ২০৩১ সালে উচ্চমধ্যম আয়, ২০৪১ সালে জ্ঞানভিত্তিক সুখী-সমৃদ্ধ দেশ, ২১০০ সালে নিরাপদ ও টেকসই বদ্বীপ গড়ার যে প্রত্যয় এবারের জাতীয় বাজেটে ব্যক্ত করা হয়েছে সেখানে অন্যতম প্রধান ভূমিকা রাখবে চলমান মেগা প্রকল্পগুলো। জাতিসংঘ ঘোষিত ২০৩০ সালের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) বাস্তবায়নে মেগা প্রকল্পগুলো অন্যতম নিয়ামক হিসেবে কাজ করবে। মেগা প্রকল্পগুলো এসডিজির আটটি লক্ষ্যের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত এবং এসব লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে প্রত্যক্ষ ও বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখবে। বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্বাচনী ইশতেহার-২০১৮-এ বিশেষ অঙ্গীকার হিসেবে মেগা প্রকল্প দ্রুত ও মানসম্মত বাস্তবায়ন, দারিদ্র্য নির্মূল, সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের মাধ্যমে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। পদ্মা সেতু, পদ্মা সেতু রেলসংযোগ, কক্সবাজার-দোহাজারী-রামু-ঘুমধুম রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়নের কথাও ইশতেহারে বলা হয়। দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ অপরিহার্য। বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ৫ হাজার মেগাওয়াট থেকে প্রায় ১৬ হাজার ৫০০ মেগাওয়াটে বৃদ্ধি বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার নেপথ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। বিদ্যুতের ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণ ও ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়ার যে অঙ্গীকার সরকার করেছে তা বাস্তবায়নে বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। সরকার ২০৩০ সাল থেকে দেশের মোট বিদ্যুৎ চাহিদার ১০ শতাংশ পারমাণবিক শক্তি থেকে উৎপাদনের পরিকল্পনা নিয়েছে এবং ২০৩০ সালে সর্বমোট বিদ্যুতের চাহিদা দাঁড়াবে ৪০ হাজার মেগাওয়াট। ২০৪১ সালের প্রত্যাশিত ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদা পূরণ করতে মেগা বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলোই বেশি অবদান রাখবে। বিদ্যুৎ উৎপাদনে দেশের একটি মেগা প্রকল্প হলো মৈত্রী সুপার থারমাল পাওয়ার প্রজেক্ট (রামপাল কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র)। বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ উদ্যোগে ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নির্মিত হচ্ছে। এ বছরের মার্চ পর্যন্ত প্রকল্পটির ভৌত অগ্রগতি হয়েছে ৭৯.৩০ শতাংশ এবং আর্থিক অগ্রগতি হয়েছে ৭৬.১ শতাংশ। এ ছাড়া ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ কেন্দ্র এরূপ আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ। এ আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি ২০২৩ সালের জুনের মধ্যে উৎপাদনে যাওয়ার কথা রয়েছে। কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেডের (সিপিজিসিবিএল) তথ্যানুযায়ী ফেব্রুয়ারি, ২০২১ পর্যন্ত এ প্রকল্পের ভৌত অগ্রগতি হয়েছে ৫৫.২০ শতাংশ এবং পোর্ট ও পাওয়ার প্লান্টের ভৌত অগ্রগতি ৬৫.৯৬ শতাংশ।
দেশের সর্ববৃহৎ মেগা প্রকল্প রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। টেকসই জ্বালানি ব্যবহার করে শক্তি উৎপাদনের লক্ষ্যে রাশিয়ান ফেডারেশনের সহযোগিতায় বাস্তবায়ন হচ্ছে বাংলাদেশে প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র যা ২০২৫ সালের ডিসেম্বরে পূর্ণ উৎপাদনে যাবে। এ বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ২০২৩ সালে ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট এবং ২০২৪ সালে আরও ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াটসহ সর্বমোট ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে যার সুফল ভোগ করবে দেশের প্রায় ৬ কোটি মানুষ। রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্প থেকে ৬০ বছর নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে, বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয়ও হবে কম। পারমাণবিক কেন্দ্রে দুর্ঘটনার ফলে তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়লে এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব থাকে বলে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়ে ভয় ও আতঙ্ক কাজ করে বিশ্বব্যাপী। তবে ফুকুশিমায় দুর্ঘটনার পর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে দুর্ঘটনার ঝুঁকি কমাতে নিরাপত্তাব্যবস্থা বাড়ানো হয়েছে। নির্মিতব্য এ ভিভিআর ১২০০ মডেলের বিদ্যুৎ কেন্দ্রে দুর্ঘটনা রোধে পাঁচটি স্তরে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ব্যবস্থা রয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুস্পষ্ট নির্দেশনা মোতাবেক নিরাপত্তাকেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে প্রকল্পটিতে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী এ বছরের ২২ জানুয়ারি পর্যন্ত প্রকল্পটির অর্থনৈতিক অগ্রগতি ছিল ৩৮.৪০ শতাংশ এবং ভৌত অগ্রগতি ৪৫.৪৯ শতাংশ।
শিল্প বিকাশের প্রধান অন্তরায় অপ্রতুল টেকসই যোগাযোগব্যবস্থা। পদ্মা সেতুর নিচের অংশে চীন-বাংলাদেশ সরকারের যৌথ অর্থায়নে ৩৯ হাজার ২৪৬ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হচ্ছে রেলপথ। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোয় যাতায়াত অধিকতর সহজ হবে এবং দেশি-বিদেশি ভ্রমণপিপাসু পর্যটকরা দক্ষিণাঞ্চলের পর্যটন কেন্দ্রগুলোয় যেতে আরও আগ্রহী হয়ে উঠবেন। এতে এ অঞ্চলের মানুষের কর্মসংস্থানের পাশাপাশি আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটবে। এ রেলপথ যে শুধু অর্থনীতিতেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে তা নয়, পাশাপাশি যুক্ত করবে আন্তর্জাতিক রেল-যোগাযোগকেও। পদ্মা সেতু নির্মাণের সাফল্য বিবেচনায় ইতোমধ্যে দ্বিতীয় পদ্মা সেতু নির্মাণকাজে অংশীদারির আগ্রহ প্রকাশ করেছে জাপান। যোগাযোগব্যবস্থার এ আমূল পরিবর্তন দেশের আর্থসামাজিক অবস্থার ব্যাপক উন্নয়ন ঘটাবে।
রাজধানী ঢাকার অন্যতম প্রধান সমস্যা তীব্র যানজট যার কারণে অর্থনৈতিকভাবে ব্যাপকহারে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাংলাদেশ। ২০১৭ সালের বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঢাকায় যানজটের কারণে প্রতিদিন ৩.৮ মিলিয়ন কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে এবং ২০১৮ সালে পরিচালিত বুয়েটের একটি সমীক্ষা অনুসারে, ঢাকা শহরের যানজটের জন্য বার্ষিক ৪.৪ বিলিয়ন ডলার খরচ হয় যা জাতীয় বাজেটের ১০ শতাংশের বেশি। নিত্যদিনের এ সমস্যা সমাধানে মেট্রোরেলের চাহিদা অনুধাবন করছিল রাজধানীবাসী। জনগণের যাতায়াত নির্বিঘ্ন করতে সরকার রাজধানীর উত্তরা দিয়াবাড়ী থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ২০.১ কিলোমিটার রুটে মেট্রোরেল চালুর সিদ্ধান্ত নেয় যা ইতোমধ্যে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে দৃশ্যমান। ম্যাস র্যাপিড ট্রান্সপোর্ট বা এমআরটি-৬ নামে পরিচিত মেট্রোরেল প্রকল্প সম্পন্ন হলে ঘণ্টায় ৬০ হাজার যাত্রী পরিবহন সম্ভব হবে। ২০১২ সালের জুলাইয়ে প্রকল্পটির কাজ শুরু হয়। বিদ্যুচ্চালিত ট্রেনটি পরিবেশের ক্ষতি ছাড়াই ধুঁকতে থাকা ঢাকা শহরে গতি সঞ্চার করে মাত্র ৩৮ মিনিটে উত্তরা থেকে মতিঝিল শাপলা চত্বর নিয়ে আসবে। চলতি বছরের ডিসেম্বরে উত্তরা থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত মেট্রোরেল চালু করতে বিরামহীন কাজ চলছে। দেশে প্রবৃদ্ধি বাড়াতে সরাসরি অবদান রাখবে মেট্রোরেল। জাতীয় দৈনিক দ্য ডেইলি স্টারের প্রতিবেদন অনুসারে, মেট্রোরেল প্রকল্পটি প্রতি বছর ২.৪ বিলিয়ন ডলার সাশ্রয় করবে যা জাতীয় জিডিপির ১.৫ শতাংশের সমান। তা ছাড়া মেট্রোরেল ঢাকার ১৫ মিলিয়নের বেশি মানুষের জন্য যাতায়াত সহজ করবে এবং দৈনন্দিন জীবনযাত্রা গতিশীল করবে। বিদ্যুৎ শক্তি দিয়ে চলার ফলে জ্বালানি খরচ কমবে, ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহারকারীরা মেট্রোরেলে যাতায়াত করতে উৎসাহিত হবে, ফলে নিজেদের ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহার হ্রাস পাবে এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করবে। একসময় ইউরোপ-আমেরিকা বা চীন-জাপানে নদীর তলদেশে স্থাপিত টানেল পরিচিত হলেও বাংলাদেশে তা ছিল স্বপে¦র মতো। বাংলাদেশ আজ এ স্বপ্ন ছোঁয়ার দ্বারপ্রান্তে। খরস্রোতা কর্ণফুলীর তলদেশ দিয়ে চীনের সাংহাইয়ের মতো ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ স্বপ্ন নিয়ে তৈরি হচ্ছে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল’। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে কক্সবাজার ও দক্ষিণ চট্টগ্রামগামী গাড়িগুলোকে আর বন্দরনগর চট্টগ্রামে ঢুকতে হবে না। চট্টগ্রামের সিটি আউটার রিং রোড হয়ে টানেলের মাধ্যমে দ্রুততম সময়ে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবে। টানেল ব্যবহারের ফলে একদিকে যেমন চট্টগ্রাম শহরের যানজট কমে আসবে অন্যদিকে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের পর্যটনশিল্পের আরও বিকাশ ঘটবে। বঙ্গবন্ধু টানেল উদ্বোধনের পর চট্টগ্রাম অঞ্চলের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে আসবে ব্যাপক পরিবর্তন। কর্ণফুলীর দক্ষিণাঞ্চলে ব্যাপক শিল্পায়ন ঘটবে। আনোয়ারায় কোরিয়ান ইপিজেডের কার্যক্রম এগিয়ে যাচ্ছে, চায়না অর্থনৈতিক জোনও শুরু হওয়ার পথে। চীনের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’-এর সঙ্গে সমন্বয়পূর্বক বঙ্গবন্ধু টানেল যুক্ত হবে আন্তর্জাতিক সড়ক যোগাযোগব্যবস্থার সঙ্গে। চট্টগ্রাম বন্দর ও নিউমার্কেট এলাকায় উন্নত অবকাঠামো গড়ে উঠলেও ওপারে আনোয়ারা উপজেলায় তেমন উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি, জীবনযাত্রার মানেও আসেনি পরিবর্তন। বঙ্গবন্ধু টানেল নির্মিত হলে আরও অনেক শিল্পকারখানা গড়ে উঠবে, যেখানে ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরির পাশাপাশি আবাসনসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে। এতে চট্টগ্রাম শহরের ওপর কিছুটা হলেও চাপ কমবে, আকার বৃদ্ধি পাবে অর্থনীতির, বাড়বে জিডিপি। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, বাংলাদেশ সরকার গৃহীত ‘বে অব বেঙ্গল ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রোথ ইনিশিয়েটিভ’ (বিগ-বি) প্রকল্পে অসামান্য অবদান রাখবে এ টানেল।
দেশের ক্রমবর্ধমান জিডিপি, প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স ও শিল্পকারখানাগুলোর অসামান্য অবদান এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় স্বপ্নের মেগা প্রকল্পগুলো মাথা তুলে দাঁড়াতে শুরু করেছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সোনার বাংলা বিনির্মাণে এ মেগা প্রজেক্টগুলোই হবে ভিত্তিস্বরূপ। ২০৪১ সালে বিশ্বের বুকে বাংলাদেশ পরিচিত হবে একটি সুখী-সমৃদ্ধ ও উন্নত দেশ হিসেবে। আগামীর বৃহৎ জনসংখ্যার প্রত্যাশিত গড় আয়ু ৮০ বছর ধরে রাখা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৯.৯ শতাংশে উন্নীত, শতভাগ শিক্ষার হার ও চরম দারিদ্র্যের হার শূন্যের কোঠায় নিয়ে আসতে মেগা প্রকল্পগুলোই হয়ে উঠবে আশীর্বাদ। কয়েক যুগ ধরে চীন, জাপান, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরের মতো এশিয়ান দেশগুলো মেগা প্রকল্পের ওপর ভিত্তি করেই তাদের টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করেছে। বাংলাদেশও পরিকল্পিত মেগা প্রকল্পের মাধ্যমে উন্নয়নের মহাসড়কে প্রবেশপূর্বক সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষমাত্রা (এমডিজি) ও টেকসই উন্নয়ন লক্ষমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে দৃপ্ত পদক্ষেপে এগিয়ে চলেছে।
লেখক : সামরিক বাহিনীতে কর্মরত।