বৃহস্পতিবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

যেভাবে বিএনপির প্রতিষ্ঠা

খায়রুল কবীর খোকন

যেভাবে বিএনপির প্রতিষ্ঠা

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল- বিএনপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আজ। ১ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৮ সালের এই দিনে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান নতুন এ দলটিকে সংগঠিত করে এর রূপকার হয়েছিলেন। তিনি ’৭৫-এর আগস্ট-পরবর্তী সংকটময় দশা থেকে দেশের রাজনীতি, সমাজ, অন্যতম প্রতিষ্ঠান সামরিক বাহিনীকে সুশৃঙ্খল করা এবং সরকার ও রাষ্ট্র প্রশাসনকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনায় ফিরিয়ে নেওয়া এবং নিজ মাতৃভূমি বাংলাদেশকে একটা সুস্থ অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের যথার্থ উন্নয়নের ধারায় সুস্থিতি দেওয়ার লক্ষ্যে একটা অসাধারণ উদ্ভাবনমূলক ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ’-এর আদর্শ সুপ্রতিষ্ঠার টেকসই ভিত্তিভূমি তৈরি করতে তাঁর জীবনের শেষ দিনটি অবধি প্রচ- লড়াই চালিয়ে গেছেন। তাঁর সেই ভূমিকাই বিএনপিকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে অন্যতম সেরা রাজনৈতিক দলের মর্যাদা দান করেছে।

১৯৭২-১৯৭৪ সময়ের আওয়ামী লীগ সরকার ও ১৯৭৫-এর জানুয়ারি থেকে একদলীয় বাকশাল সরকারের আমলে দেশবাসীর অর্থনৈতিক দুর্দশা চরমে পৌঁছে। ’৭৫-এর আগস্টে সেনাবাহিনীর একটা ক্ষুদ্র অংশের সমর্থনে বাকশাল সরকারের কয়েকজন নেতার চক্রান্তে যে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে সেসব ‘ব্যর্থ-রাষ্ট্র’সুলভ পরিস্থিতি সামাল দিয়ে বাংলাদেশকে একটা গণতান্ত্রিক, অর্থনৈতিক উন্নয়ন তৎপরতার ব্যাপক সম্প্রসারণের মাধ্যমে সমৃদ্ধ রাষ্ট্রে পরিণত করার সংগ্রামে অবদান রেখেছেন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। সেই রাষ্ট্রিক ক্রিয়াকর্মের সাফল্য অর্জনের লক্ষ্যে তিনি এই বিএনপি সংগঠিত ও সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। ’৭১-এর সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের এই বীর মুক্তিযোদ্ধা ’৭৫-এর মধ্যভাগে জাতির চরম দুর্দশার দিনে রাষ্ট্রটিকে সঠিক শৃঙ্খলার পথে পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আবার হাল ধরেছিলেন দেশবাসীর সমর্থনে। সেই মুক্তিযুদ্ধ প্রারম্ভকালে ২৫ মার্চ মধ্যরাতে দখলদার বর্বর পাক বাহিনীর বাঙালি জাতি ও বাংলাদেশ ধ্বংসের লক্ষ্যে পরিচালিত বর্বর আক্রমণের বিরুদ্ধে মেজর জিয়া তাঁর অধীন প্রায় ৩০০ বাঙালি সেনার কমান্ডার-রূপে বিদ্রোহ করে দেশের মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। সেই সামরিক অফিসার জিয়াউর রহমান কালক্রমে বাংলাদেশের সেনাবাহিনী-প্রধান, প্রেসিডেন্ট এবং রাজনৈতিক দল বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা হয়েছিলেন, একজন সফল রাষ্ট্রনায়কে পরিণত করতে পেরেছিলেন নিজেকে। বাংলাদেশের আজকের যে উন্নয়ন সাফল্য দৃশ্যমান তার আসল রূপকার সত্তর দশকের মধ্যভাগ থেকে শেষ ভাগ এবং আশির প্রথম ভাগের রাষ্ট্রনেতা প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান।

এ দেশের রাজনীতির ওয়াকিবহাল মানুষমাত্রই উপলব্ধি করে থাকবেন এবং করবেন, যত মহৎ উদ্দেশ্য নিয়েই ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) প্রতিষ্ঠা করা হয়ে থাক না কেন, দেশের সব রাজনৈতিক দলকে বিলুপ্ত করে এবং সব সংবাদপত্র অবলুপ্ত করে চারটি মাত্র শতভাগ-সরকারি মালিকানাধীন দৈনিক পত্রিকা চালু রেখে যে ব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল তা এ দেশে ও বহির্বিশ্বে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়। সুযোগের-অপেক্ষায় থাকা বাকশাল সরকারের ক্ষমতালোভী ও চক্রান্তকারী অংশ খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে এবং সামরিক বাহিনীর একটা বিভ্রান্ত-অংশ (ছয় মেজর ও ১১ জুনিয়র অফিসারের যৌথ নেতৃত্বে সংঘটিত সামরিক অভ্যুত্থানের সহায়তা-লাভের মাধ্যমে)-কে ব্যবহার করে এ অঞ্চলের একটি কুখ্যাত সামরিক গোয়েন্দা বাহিনী এ ষড়যন্ত্রের পেছনে মূল মদদদাতা হিসেবে কাজ করে। তাদের পেছনে ‘বিশ্বমোড়ল’-খ্যাত একটি সাম্রাজ্যবাদী শক্তির কুখ্যাত গোয়েন্দা সংস্থার সমর্থন ছিল বলে যৌক্তিক তথ্য-উপাত্ত-সংবলিত অভিযোগ পাওয়া যায়।

’৭৫-এর মধ্য-আগস্ট থেকে নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহ অবধি নানা ঘটনা-দুর্ঘটনার মধ্য দিয়ে অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থানের একপর্যায়ে ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর ভোরে সিপাহি-জনতার অভ্যুত্থানে সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান গৃহবন্দি দশা থেকে মুক্ত হন এবং নতুন রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমের অধীনে উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক নিযুক্ত হন। বস্তুত সেনাপ্রধান ও এক নম্বর উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসকরূপে দ্বিতীয় প্রধান ব্যক্তি হন। জেনারেল জিয়া তখন থেকেই কার্যত রাষ্ট্রের প্রধান নীতিনির্ধারকে পরিণত হয়েছিলেন। বস্তুত সামরিক বাহিনীর ভিতরে এবং জনগণের মধ্যে জিয়াউর রহমানের সবচেয়ে বড় নেতা হওয়ার আস্থা সৃষ্টি হয়েছিল Ñ’৭১ সাল থেকে সেই সময় অবধি তাঁর দেশপ্রেমমূলক কর্মকান্ডের বহিঃপ্রকাশ দেশ-জনতা প্রত্যক্ষ করেছিল। তারপর অচিরেই তখনকার বাস্তবতায় বিকল্পহীন পরিস্থিতিতে জিয়াউর রহমান প্রেসিডেন্ট হন এবং তিনি বাংলাদেশের রাজনীতিতে পুরো সামরিক শাসনের অবসান ঘটানোর লক্ষ্যে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের প্রক্রিয়া শুরু করেন। সে প্রক্রিয়ার সময় জিয়াউর রহমান প্রথম দিকে একবার রাজনীতি না করে পুরনো রাজনৈতিক দলগুলোর সংগঠিত শক্তির কাছে ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে পুরোপুরি সেনাছাউনিতে ফিরে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি তখন দেখলেন, দেশের সামরিক বাহিনীর ক্যান্টনমেন্টগুলোয় তখনো ‘তথাকথিত বিপ্লবের নামে’ নৈরাজ্য সৃষ্টির আশঙ্কা ছাড়াও রাজনৈতিক পরিম-লে শক্তিশালী কোনো রাজনৈতিক দল নেই বা যারা আছে তারা দেশবাসীর আস্থা অর্জনে সক্ষম নয়।

তখন জিয়াউর রহমান বাধ্য হয়েই বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের আদর্শের রাজনীতি প্রবর্তন করেন। এর আগে ১৯৭৬ ও ১৯৭৭ সালে জিয়াউর রহমান সুদীর্ঘ সময়ে দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের কর্মকান্ডে প্রকৃত গতিশীলতা আনার লক্ষ্যে দেশব্যাপী একটা কর্মমুখী রাজনীতি চালুর তৎপরতার প্রক্রিয়ায় ব্যাপক আলোচনা বৈঠক চালান। সেসব বৈঠকে দেশের মূল সমস্যাগুলোর অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করা হয়। তাঁর সঙ্গে তখনকার ন্যাপ (ভাসানী), বাংলাদেশ জাতীয় লীগ, ইউনাইটেড পিপলস পার্টি, বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল, জাতীয় দল, জাতীয় গণমুক্তি ইউনিয়ন, জাতীয় জনতা পার্টি (কোরেশী গ্রুপ), গণআজাদী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা এবং বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদী ভাবাদর্শের বুদ্ধিজীবীরা অবিরাম বৈঠক করেছেন, চমৎকার মুক্ত আলোচনার সেসব সভায় দেশের নতুন রাজনীতির একটা সংগঠিত রূপদানের পক্ষে বক্তব্য প্রাধান্য পেয়েছে।

জিয়াউর রহমান ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর ১৯ দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বিএনপির প্রতিষ্ঠাকালীন ঘোষণাপত্রে দেশের গণমানুষের ইস্পাতকঠিন গণঐক্যের ওপরে গুরুত্বারোপ করে বলা হয়েছিল‘সুদৃঢ় এবং অভেদ্য জাতীয় ঐক্যবোধ এবং জাতীয় অর্থনৈতিক স্বয়ংসম্পূর্ণতা না থাকলে সাম্রাজ্যবাদ, সম্প্রসারণবাদ ও নয়া-উপনিবেশবাদের গ্রাস থেকে জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতা রক্ষা করা দুঃসাধ্য।’ এ ঘোষণাপত্রের মধ্যে ৩১টি দফায় রয়েছে‘ঐক্যবদ্ধ অগ্রগতির অমোঘ দাবি : উৎপাদনের রাজনীতি এবং জনগণের গণতন্ত্র’, ‘জাতীয়তাবাদভিত্তিক ইস্পাতকঠিন গণঐক্য’, ‘সার্বভৌমত্ব, সামাজিক ন্যায়বিচার ও দ্রুত উন্নয়নের মাধ্যম : স্থিতিশীল গণতন্ত্র’, ‘বিলুপ্ত মানবিক মূল্যবোধের পুনরুজ্জীবন’, ‘স্থিতিশীল গণতন্ত্রের রূপরেখা, প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির সরকার, নির্বাচিত ও সার্বভৌম আইন পরিষদের মাধ্যমে সজীব ও সক্রিয় গণঅংশীদারি কায়েম’, ‘স্থানীয় এলাকা সরকার ও বিকেন্দ্রীভূত রাজনৈতিক ক্ষমতা’, ‘সামাজিক ন্যায়বিচারের অর্থনীতি’, ‘জাতিগঠন, সমাজসেবা ও উপার্জনমুখী কার্যক্রমে যুবশক্তির সদ্ব্যবহার’, ‘জাতীয় পররাষ্ট্রনীতির উপাদান ও লক্ষ্য : স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, সমৃদ্ধ এবং আন্তর্জাতিক প্রীতি ও সখ্য’ ইত্যাদি। এ ঘোষণাপত্রের মধ্যে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সার্বিক বিষয়াবলি স্থান পেয়েছে। বিএনপিকে প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান একটি শক্তিশালী জাতীয় রাজনৈতিক দল হিসেবে প্রতিষ্ঠা দিয়ে গেছেন তার শুরুতেই। তাই তো এত আঘাতের পর আঘাতেও বিএনপি টিকে আছে দেশের নেতৃস্থানীয় রাজনৈতিক দল হিসেবে। ভবিষ্যতেও দেশ ও দেশবাসীর সার্বিক মুক্তির লড়াইয়ে, গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার সংগ্রামে এই দল, রাষ্ট্রনায়ক জিয়ার দল প্রচ- শক্তিতে থাকবে রাজপথে। এবং গণতান্ত্রিক ও সমৃদ্ধ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জনযুদ্ধের ময়দানে, আবার সরকার পরিচালনার জনপ্রতিনিধিত্ব করার জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণের লক্ষ্যেএকটা নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে একটা সুষ্ঠু, জনগণের প্রকৃত ভোটের নির্বাচন কায়েমের লড়াইয়ে।

 

লেখক : বিএনপির যুগ্মমহাসচিব, সাবেক সংসদ সদস্য ও ডাকসু সাধারণ সম্পাদক

 

সর্বশেষ খবর