শনিবার, ১ অক্টোবর, ২০২২ ০০:০০ টা

প্রবাসে দুর্গাপূজা

তপন কুমার ঘোষ

প্রবাসে দুর্গাপূজা

শুরু হয়ে গেছে শারদোৎসবের কাউন্টডাউন। জোরকদমে চলছে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি। শাস্ত্রমতে, মা দুর্গা আসছেন মর্ত্য,ে পিতৃগৃহে। পাঁচ দিন পর ফিরে যাবেন কৈলাসে। এ বছর দুর্গাপূজা শুরু ১ অক্টোবর। ষষ্ঠীতে দেবীর বোধনের মধ্য দিয়ে শুরু হচ্ছে। ৫ অক্টোবর বিজয়া দশমীতে দেবী বিসর্জনের মধ্য দিয়ে শেষ হবে পাঁচ দিনব্যাপী শারদীয় দুর্গোৎসব।

করোনা এখন বিদায়ের পথে। তাই এবার পূজা আয়োজনে বিশেষ জাঁকজমক থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। প্রসঙ্গত, আবহমান সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে বাংলার দুর্গাপূজা। ইউনেস্কো এ স্বীকৃতি দিয়েছে।

বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে দুর্গাপূজার আয়োজন করা হয়। দুর্গাপূজা বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব। দুই বাংলার বাঙালি কমিউনিটি প্রবাসে দুর্গাপূজার আয়োজন করে। প্রতি বছর কলকাতার কুমোরটুলি থেকে দুর্গামূর্তি বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে যায়। মাটির প্রতিমা নয়, ফাইবারের তৈরি প্রতিমা। বিশ্বের যে প্রান্তেই থাকেন না কেন, পূজা এলে অন্তত একবার দুর্গতিনাশিনীর মুখ দর্শনের জন্য মুখিয়ে থাকেন না এমন বাঙালি হিন্দু বিরল। প্রবাসে পূজা উপলক্ষে কোনো সরকারি ছুটি নেই। তাই নির্দিষ্ট দিনক্ষণ মেনে পূজা আয়োজন করা সম্ভব হয় না। কার্যদিবসে ছুটি পাওয়া যাবে কি না তা নিয়ে থাকে অনিশ্চয়তা। তাই পূজা আয়োজন করা হয় সপ্তাহান্তে শনি অথবা রবিবার। কোথাও কোথাও শনি-রবি দুই দিনই পূজার আয়োজন করা হয়। পাঁচ দিন ধরেও পূজা হয়। তবে সংখ্যায় কম। পূজা এলে সাজগোজের একটা উপলক্ষ পাওয়া যায়। শাড়ি আর পাঞ্জাবিতে আদ্যোপান্ত বাঙালি সাজে সেজে ঘুরতে বেরিয়ে পড়েন প্রবাসী বাঙালিরা। সারা বছরের একঘেয়ে পোশাক থেকে মুক্তি। জমজমাট আড্ডা, বাঙালি খাবারে ভূরিভোজ আর সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক পরিবেশনায় মেতে ওঠেন দর্শনার্থীরা। সেলফি তুলে ফেসবুকে পোস্ট দেন। প্রবাসে পূজা মানে বাঙালির মিলনমেলা।

অস্ট্রেলিয়ার সিডনি শহরে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন নারায়ণগঞ্জের গৌতম দাস। কয়েক বন্ধু মিলে প্রতি বছর ‘নবরূপ সিডনি’ ব্যানারে পূজা আয়োজন করে আসছেন। এবার একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের হলরুম ভাড়া করেছেন। অস্থায়ী মন্ডপ গড়ে সেখানে পূজা হবে। পূজাকর্তা গৌতম বললেন, ‘সিডনিতে এবার ১৪টি পূজা হবে। সিডনির বাইরে থেকেও ভক্তরা আসেন পূজা দেখতে। পূজার আচার-অনুষ্ঠান ছাপিয়ে মূলত আনন্দ-উৎসবে মেতে ওঠেন প্রবাসীরা। একে বলা যায় পূজাকেন্দ্রিক সামাজিক মিলনমেলা।’

সিলেটের মেয়ে অদিতি পুরকায়স্থ। বৈবাহিকসূত্রে এখন কানাডার হ্যালিফ্যাক্সে। তিন বছরের প্রবাস-জীবন। সমমনা সাত-আটটি পরিবার মিলে এবার দুর্গাপূজার আয়োজন করেছেন ‘আনন্দময়ী শারদোৎসব’ ব্যানারে। অদিতি জানান, অনলাইনে নিবন্ধন করার অনুরোধে ভালো সাড়া পাওয়া গেছে। পূজা উপলক্ষে সোশ্যাল সেন্টার ভাড়া নেওয়া হয়েছে। কথা প্রসঙ্গে অদিতি বললেন, ‘প্রবাসজীবন একেবারেই অন্যরকম। সবই করতে হয় নিজ হাতে। ছুটির দিনেও ছুটি নেই। ঘরকন্না নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয় সারা দিন। এখন বাড়তি ব্যস্ততা পূজামন্ডপের সাজসজ্জা নিয়ে।’ হ্যালিফ্যাক্সের পূজার অন্যতম উদ্যোক্তা স্বাগত ঘোষ বলেন, ‘কলকাতা থেকে জাহাজে দুর্গামূর্তি আনা হয়েছে। পূজার পর প্রতিমা বিসর্জন না দিয়ে বাক্সবন্দি করে সযতনে রেখে দেওয়া হবে। আসছে বছর ওই মূর্তি সেট করে আবার পূজা করা হবে। প্রবাসে সর্বত্রই এটা করা হয়।’ কথায় বলে না, ‘প্রবাসে নিয়ম নাস্তি’, যোগ করেন স্বাগত।

যুক্তরাজ্যপ্রবাসী ড. সুব্রত বোস একটি বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানিতে কর্মরত। আজও শেকড়ের টান অনুভব করেন। মাসখানেক আগে নিজ শহর নড়াইল ঘুরে গেছেন। সুব্রত বললেন, ‘এবার লন্ডনে অর্ধশতাধিক পূজা হবে। পূজার সংখ্যা ফিবছর বাড়ছে। কে কাকে টেক্কা দিতে পারে তা নিয়ে চলে সুস্থ প্রতিযোগিতা।’  যুক্তরাষ্ট্রের মিসিসিপি স্টেট ইউনিভার্সিটিতে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে শিক্ষকতা করেন ড. তন্ময় ভৌমিক। মিসিসিপির স্টার্কভিলে থিতু হয়েছেন। সস্ত্রীক পূজা দেখতে যান জর্জিয়া অঙ্গরাজ্যের রাজধানী আটলান্টায়। স্ত্রী সুপ্রীতি ভৌমিক বললেন, ‘পূজার বড় আয়োজন হয় আটলান্টা শহরে। আশপাশের অন্যান্য স্টেট থেকে দর্শনার্থীরা আটলান্টায় আসেন পূজা দেখতে। স্টার্কভিল থেকে আটলান্টা পাঁচ ঘণ্টার ড্রাইভ। আটলান্টায় রাতযাপন করে পরদিন আমরা ফিরে আসি।’ সুপ্রীতি আরও বললেন, ‘মিসিসিপির রাজধানী জ্যাকসনেও পূজা হয়। তবে ছোট পরিসরে। স্টার্কভিল থেকে জ্যাকসন আড়াই ঘণ্টার ড্রাইভ। পূজা দেখে ওই দিনই ফিরে আসা যায়। তবে এবার কর্মব্যস্ততার কারণে কোথাও যাওয়া হচ্ছে না।’

কানাডাপ্রবাসী সোমা নন্দী। শেকড়ের টানে ছেলেমেয়ে নিয়ে সম্প্রতি বাংলাদেশে এসেছিলেন। বাঙালি কালচারে সন্তানদের আগ্রহী করে তুলতে হিমশিম খাচ্ছেন বরুণ-সোমা দম্পতি। সোমা বললেন, ‘প্রবাসীদের জন্য এটা বড় চ্যালেঞ্জ। কানাডায় সব ধর্মের মানুষ পরস্পরের ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। ধর্মাচরণে কোনো বাধা নেই।’ প্রতি বছরের মতো এবারও পূজায় স্বামী-সন্তান নিয়ে ক্যালগেরির মন্ডপে মন্ডপে ঘুরে ভগবতীর মুখ দর্শন করবেন সোমা। পূজার কটা দিন উৎসব-আনন্দে কাটিয়ে আবার জীবনযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়বেন প্রবাসী বাঙালিরা।

লেখক : পরিচালক, পরিচালনা পর্ষদ, বাংলাদেশ হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশন

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর