বৃহস্পতিবার, ১৩ অক্টোবর, ২০২২ ০০:০০ টা

আত্মহত্যা প্রতিরোধে সবাইকে সচেতন করতে হবে

প্রিন্সিপাল এম এইচ খান মঞ্জু

আত্মহত্যা প্রতিরোধে সবাইকে সচেতন করতে হবে

দেশে ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত আট মাসে ৩৬৪ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। যার মধ্যে ১৯৪ জনই ছিল স্কুলপড়ুয়া, কলেজপড়ুয়া ৭৬ জন ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫০ জন। এ ছাড়া ৪৪ জন মাদরাসা পড়ুয়াও আত্মহত্যা করেছে। সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশনের জরিপে এসব তথ্য উঠে এসেছে। জরিপের তথ্যানুসারে, গত আট মাসে মোট আত্মহত্যা করা শিক্ষার্থীর মধ্যে ৫০ জন ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র, যার মধ্যে ছেলে শিক্ষার্থী ৬০ ও মেয়ে শিক্ষার্থী ৪০ শতাংশ। কলেজপড়ুয়ার মধ্যে ৭৬ জন এ পথ বেছে নেন, যার মধ্যে ৪৬.০৫ শতাংশ ছেলে ও ৫৩.৯৫ শতাংশ মেয়ে। সবচেয়ে বেশি অর্থাৎ ১৯৪ জন স্কুলগামী শিক্ষার্থী গত আট মাসে আত্মহত্যার দিকে ধাবিত হয়েছে। তার মধ্যে ৩২.৯৯ শতাংশ ছেলে ও ৬৭.০১ শতাংশ মেয়ে শিক্ষার্থী। মাদরাসাপড়ুয়া ৪৪ শিক্ষার্থী আত্মহত্যার মাধ্যমে জীবনাবসানের পথ বেছে নিয়েছে। তার মধ্যে ৩৯.২৯ শতাংশ ছেলে ও ৬০.৭১ শতাংশ মেয়ে। হঠাৎই বেড়েছে আত্মহত্যা। শুধু বয়স্ক নারী-পুরুষ নয়, অল্পবয়সী এমনকি কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে আশঙ্কাজনক হারে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়েছে। মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানুষ অতিমাত্রায় হতাশাগ্রস্ত ও সংবেদনশীল হয়ে পড়ায় আত্মহত্যার দিকে ঝুঁকে পড়ছে। সব বয়সী মানুষের মধ্যেই বেড়েছে এর প্রবণতা। সামাজিক বৈষম্য, পারিবারিক কলহ, মাদক, ইন্টারনেটের অপব্যবহার, সন্তানের প্রতি অভিভাবকদের উদাসীনতা, পারিবারিক বন্ধন ফিকে হয়ে আসার মতো কারণগুলো প্রকট আকার ধারণ করায় মানুষের মধ্যে আত্মহত্যার মতো জঘন্য অপরাধের প্রবণতা বাড়ছে। এ ছাড়া নৈতিক স্খলন, তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহার, ব্যাকমেলিং অনেককে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। ২০১৪ সালে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সমীক্ষায় বলা হয়েছে, দেশে প্রতিদিন গড়ে ২৮ জন আত্মহত্যা করে। এর বেশির ভাগ ২১ থেকে ৩০ বছরের নারী।

আত্মহত্যার ঘটনা নির্মূলে সরকারি-বেসরকারি নানা উদ্যোগ ও প্রয়াস থাকলেও এ প্রবণতা ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে। তবে প্রচেষ্টাগুলো আরও বেশি মনোযোগ পাওয়ার দাবি রাখে। পাশাপাশি অবকাশ রাখে নতুন ভাবনা ভাবার। শিল্পায়নের সঙ্গে নগরায়ণ, একই সঙ্গে প্রযুক্তিনির্ভরতা বেড়ে যাওয়ায় পাল্লা দিয়ে সমাজ নানা জটিল বাঁক নিচ্ছে। আমাদের পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও নৈতিক মূল্যবোধগুলো দিন দিন হালকা হয়ে যাচ্ছে। সঠিক সামাজিকীকরণ, শক্তিশালী ও কার্যকর সামাজিক এবং পারিবারিক মূল্যবোধগুলো ধারণ ও লালন, সাম্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ব্যক্তির সঙ্গে সমাজের সংহতি স্থাপন করা সম্ভব হলে তা হবে আত্মহত্যা নিরসনের মূল হাতিয়ার। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটকে আরও বেশি শক্তিশালী করা এবং বাংলাদেশের তৃণমূল পর্যন্ত মানসিক স্বাস্থ্যসেবা সঠিকভাবে পৌঁছে দেওয়া বিশেষভাবে প্রয়োজন। শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানগুলোয়ও জরুরি মানসিক স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে হবে। মেয়েদের জন্য তৈরি করতে হবে সামাজিক সুরক্ষার বলয়। পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় মেয়েরা শুধু মেয়ে হওয়ার কারণেই নানা সংকটের সম্মুখীন হয়, যা তাদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতার আবহ তৈরি করে। সেই সঙ্গে নারীবান্ধব নীতি প্রণয়ন ও এর যথাযথ বাস্তবায়নের মাধ্যমে লিঙ্গসাম্য প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হতে হবে। কেউ কোনো সমস্যায় আক্রান্ত হলে তার সঠিক চিকিৎসা না হলে বিষণ্নতা ও হতাশায় নিমজ্জিত হয়। ভুগতে থাকে মানসিক রোগে। আর এর শেষ পরিণতি গিয়ে ঠেকে আত্মহত্যায়। আত্মহত্যা মহাপাপ। আইন অনুযায়ী একটি অপরাধ। জগতের সব ধর্ম এবং নীতিশাস্ত্রে আত্মহত্যার সমর্থনে কোনো যুক্তি খুঁজে পাওয়া যায় না। তাহলে কেন মানুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়? আত্মহত্যা নিরসনে সরকারি-বেসরকারি নানাবিধ উদ্যোগ ও প্রয়াস রয়েছে, তথাপি আত্মহত্যা ঘটছেই। আত্মহত্যার পেছনের গল্প যদি তালাশ করি তাহলে স্বভাবতই যে চিত্রটি মানসপটে ভেসে আসে তা হলো- যৌতুক, বেকারত্ব, পারিবারিক কলহ, প্ররোচনা, চাপ, হতাশা, প্রেমে ব্যর্থতা, চাহিদা এবং আকাক্সক্ষার মধ্যে ফারাক, নেতিবাচক চিন্তা, জীবনের উদ্দেশ্যহীনতায় হীনমন্যতা, আস্থাহীনতাসহ নানা উপাদান অনুঘটক হিসেবে রসদ জোগায়।

এ থেকে পরিত্রাণের পথ কী? মানসিক চিকিৎসা, ইতিবাচক মনোভাব, সহমর্মিতা, বন্ধুত্বের হাত বাড়ানো, বক্তব্য শেয়ার করার পরিবেশ তৈরি, আত্মসমালোচনা। আত্মহত্যার প্রবণতা কমাতে সমাজের নীতিনির্ধারকদের সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে। সচেতনতা বাড়াতে হবে। আর ছেলেমেয়েদের ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত করতে হবে। একই সঙ্গে সিনেমা-নাটক, প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় জীবন সম্পর্কে সচেতন হওয়া ও আত্মহত্যার কুফল সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করে তুলতে পারলে তবেই আত্মহত্যার প্রবণতা অনেকটা কমে আসবে। মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আত্মহত্যার পেছনে যেসব কারণ দায়ী তা চিহ্নিত করে ব্যবস্থা না নিলে এর প্রবণতা বাড়তেই থাকবে। তাই আত্মহত্যা প্রতিরোধে সবাইকে সজাগ, সতর্ক ও সচেতন থাকতে হবে, সবাইকে সচেতন করতে হবে।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য ও প্রিন্সিপাল এম এইচ খান ডিগ্রি কলেজ, গোপালগঞ্জ

সর্বশেষ খবর