বুধবার, ২৮ ডিসেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

চীন-ভারত সম্পর্ক কোন পথে

সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

চীন-ভারত সম্পর্ক কোন পথে

চীন-ভারত তিক্ত সম্পর্ক নিয়ে ভারতের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো নানা প্রশ্ন তুলেছে। তারা বলছে, যে কোনো মুহূর্তে চীন ভারত আক্রমণ করতে পারে। সিকিম, তিব্বত সীমান্ত থেকে শুরু করে কাশ্মীর সীমান্তের প্রায় সাড়ে তিন হাজার মাইল জায়গা শুধু দখল করেই নেয়নি, তারা যে দখল করেছে তার তথ্য প্রমাণ ভারত ও আমেরিকার স্যাটেলাইটে প্রতিদিন ধরা পড়ছে। একমাত্র গালওয়ান সীমান্তেই ৭০ হাজার চীনা সেনা মোতায়েন করা হয়েছে। রাস্তাঘাট, বাড়িঘর সবই সেখানে দীর্ঘদিন ধরে তৈরি করা হয়েছে। আনা হয়েছে প্রচুর ট্যাঙ্ক ও মারণাস্ত্র। সবকিছু মিলিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যখন বলছেন, এগুলো কিছু নয়, সবই রাহুল গান্ধীর প্রচার। কিন্তু ভারতের প্রাক্তন ও বর্তমান জেনারেলরা প্রতিদিন টিভিতে সাক্ষাৎকার দিয়ে রাহুল গান্ধী যে কথা বলছেন তার সঙ্গে সহমত পোষণ করেছেন।

যেহেতু মোদি বলেছেন যে, চীনারা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে না, সঙ্গে সঙ্গে তার বিজেপি-আরএসএস বলতে শুরু করেছে, জওহরলাল নেহরু চীনের কাছে নাকি দেশের জমি বিক্রি করে গেছেন। তাদের এ উক্তি শুনে ইতিহাসবিদরা বলছেন, ওদের এ বক্তব্যগুলোয় ঢাকার কুট্টিদের কথাই মনে আসে। কইয়েন না কর্তা, ঘুড়াও হাসব। পৃথিবীর কোনো লোক কি এ কথা বিশ্বাস করতে পারে! ইতিহাস বলে যে চীনারা বরাবরই বিশ্বাসঘাতক। আমার মনে আছে যে ১৯৬০ সালে আমরা তখন ছাত্র। চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই নেহরুর আমন্ত্রণে ভারত সফরে এসেছিলেন। নেহরু তাকে নিয়ে কলকাতা সফরে আসেন। আমরাও সে সময় ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে বিরাট জনসভায় চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাইকে দেখতে গিয়েছিলাম।

চৌ এন লাই সেই জনসভায় নেহরুর হাত ধরে বলেছিলেন, হিন্দি-চীনি ভাই ভাই। তার দুই বছর পরেই ১৯৬২ সালের সেপ্টেম্বর মাসের তৃতীয় সপ্তাহে চীন ভারত আক্রমণ করে। বন্ধু চৌ এন লাই যে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে তা জওহরলাল নেহরু স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি। তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। ভুবনেশ্বরে কংগ্রেস অধিবেশনে তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হন। ’৬৪ সালে হৃদরোগে আক্রান্ত অবস্থায় তিনি মারা যান। নেহরুর উদ্যোগে তৈরি হয়েছিল পঞ্চশীল। নেহরু চৌ এন লাইকে পঞ্চশীলের সদস্য করেছিলেন। এই পঞ্চশীলের অন্য সদস্যরা ছিলেন মিসরের প্রেসিডেন্ট জামাল নাসের। ঘানার প্রেসিডেন্ট নকরুমা, যুগোস্লাভ প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটো এবং ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট সুকর্ণ। পঞ্চশীল ভারত আক্রমণের পর ভেঙে যায়। কারণ বাকি সদস্যরা এ আক্রমণের তীব্র নিন্দা করেছিল।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী রাহুল গান্ধীকে চিঠি লিখে তার ভারতজুড়ে যাত্রা বন্ধ করতে বলেছেন। কারণ এই যাত্রা কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী ১০৫ দিন হয়ে গেছে। প্রায় ১৫০০ মাইল হাঁটা হয়ে গেছে। তাতে কংগ্রেস বিপুল সাড়া পেয়েছে। তাতে বিজেপি আরএসএস এবং তৃণমূল ভয় পেয়ে গেছে

কলকাতার জনসভায় চৌ এন লাইয়ের নেহরু প্রশান্তি শুনে সেদিন ভারতবর্ষে হিন্দি-চীনি ভাই ভাই চালু হয়ে গেল। আর ’৬০ সালে তার যে ভাষণটি ছিল চীনা ভাষায় লেখা সেটি অনুবাদ করিয়ে ব্রিগেডে পড়েছিলেন তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায়। তিনি বলেছিলেন, পথের কুকুর পথেই ঘেউ ঘেউ করবে। আর জওহরলালের নেতৃত্বে ভারত এগিয়ে চলবে। জনগণের হর্ষধ্বনির মধ্যে নেহরুর হাত ধরে তিনি বলেছিলেন, চীন-ভারত ভাই ভাই সম্পর্ক থাকবে চিরদিন।

কমিউনিস্টদের মজার ব্যাপার হলো এই, ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতার এক বছর পর নেহরু ভারতের প্রেসিডেন্ট সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণকে মস্কোয় পাঠিয়েছিলেন। তখন থেকেই ভারতের সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়নের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ১৯৬২ সালের যুদ্ধের সময় নেহরু ক্রেমলিনের কাছে সাহায্য চান। তখন ক্রুশ্চেভ নেহরুকে বলে দেন, চীন আমাদের ভাই। তোমরা আমাদের বন্ধু। আমরা তোমাদের কোনো সাহায্য করব না। খবর পেয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি নেহরুকে ফোন করে সাহায্য করতে চান। নেহরু তাদের সাহায্য প্রত্যাখ্যান করে বলে দেন, আমার দেশ নির্জোট আন্দোলনে বিশ্বাসী। এটাই হলো চীন-ভারত যুদ্ধের একটি ঐতিহাসিক তথ্য। ওই যুদ্ধে ভারত হেরে যায়। তখন ভারতের সংসদের উভয়পক্ষে যুদ্ধের পরিস্থিতি নিয়ে নেহরু বিবৃতি দিতেন। এমনকি কংগ্রেস দলের নেতাদের দাবি মেনে নিয়ে নেহরু বন্ধু প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ভি কে কৃষ্ণমেননকে মন্ত্রিসভা থেকে সরিয়ে দেন। পরিস্থিতি তখন এতই খারাপ, ভারত হেরে যাওয়ার পর ভারতের লোকসভায় কংগ্রেস ও বিরোধী দলের ১৬৫ জন সংসদ সদস্য বক্তৃতা করেছিলেন। তারা কেউ নেহরুর পদত্যাগ চাননি। তারা চেয়েছিলেন প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর পদত্যাগ, যা তিনি আগেই করে দিয়েছিলেন। পুরনো সংসদ সদস্যদের মুখে শুনেছি, তিনি লোকসভা সদস্যদের বক্তব্য মন দিয়ে শুনে নোট নিয়েছিলেন। আর চীন যে আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে, সে ব্যাপারে বর্তমান সংসদে ১৫ দিন ধরে কংগ্রেস ও অন্য বিরোধীরা আলোচনা চায়। সংসদ সদস্যরা কক্ষ থেকে বারবার বেরিয়ে যান। আর আরএসএস বিজেপি তো উদ্ভট মস্তিষ্ক। অমিত শাহ (ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী) সংসদে বলে বসেছেন, জওহরলাল নেহরু ভারতের জমি চীনকে বিক্রি করে দিয়েছেন।

কংগ্রেসের প্রধান মুখপাত্র জয়রাম রমেশ বলেছেন, ওদের একটু পড়াশোনা করা দরকার। মাও সে তুং তার বইতে বলেছেন, ৪০/৫০ বছর পর ভারতকে আক্রমণ করতে হবে। সে জন্য চীনা সেনারা যেন সব সময় প্রস্তুত থাকে। কূটনৈতিক মহলে প্রশ্ন উঠেছে- ১০ বছর গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময় ২০ বার চীন সফরে গিয়েছিলেন মোদি। বর্তমানে চীনা রাষ্ট্রপ্রধান শি জিন পিংয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। তাদের ওই সাক্ষাৎকারে কী আলোচনা হয়েছে তা কেউ জানে না। মোদি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর জিন পিং প্রথম ভারত সফর করেন গুজরাটে। সেখানে তিনি নরেন্দ্র মোদির কাছে একটি অর্ডার পান। প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে চীন থেকে সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেলের মূর্তি বসানো হয় গুজরাটের আহমেদাবাদে। বিরোধী দলের বিশ্বাস চীনের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে মোদির একটা গোপন সমঝোতা আছে। তারা সে কথা বারবার সংসদের অধিবেশনে বলছেনও। কিন্তু মোদি মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছেন। উদ্দেশ্যটা কী?

মোদির পররাষ্ট্রমন্ত্রী এম জয়শঙ্কর মোদির হয়ে সাফাই দিতে গিয়ে কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধীকে একহাত দেখিয়েছেন। কূটনীতিক মহলের খবর, জয়শঙ্করের বাবা ’৬২ সালের যুদ্ধের সময় চীনে ভারতের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। ২০১০ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত জয়শঙ্কর নিজে চীনে ভারতের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। চীন সম্পর্কে জ্ঞানগাম্যি জয়শঙ্করের থাকারই কথা। কিন্তু সেসব ভুলে গিয়ে তিনি এখন আরএসএসকে সমর্থন করে চলেছেন। নরেন্দ্র মোদির চীন নীতির একমাত্র সমর্থক হলো তৃণমূল কংগ্রেস এবং যার নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

চীন প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে হঠাৎ মোদির স্বাস্থ্যমন্ত্রী রাহুল গান্ধীকে চিঠি লিখে তার ভারতজুড়ে যাত্রা বন্ধ করতে বলেছেন। কারণ এই যাত্রা কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী ১০৫ দিন হয়ে গেছে। প্রায় ১৫০০ মাইল হাঁটা হয়ে গেছে। তাতে কংগ্রেস বিপুল সাড়া পেয়েছে। তাতে বিজেপি আরএসএস এবং তৃণমূল ভয় পেয়ে গেছে।

আসলে কী হচ্ছে? তাইওয়ানে এ হামলা চালিয়ে ভারতের পাশাপাশি দালাইলামাকেও বার্তা দিতে চাইছে চীন। সে সঙ্গে তাইওয়ানকে অস্থির করে চীন সামগ্রিকভাবে সীমান্ত আলোচনা শুরু করানোর জন্য ভারতের ওপর চাপ তৈরি করতে চাইছে।

দিল্লির কূটনৈতিক মহলের বক্তব্য, সীমান্তের পশ্চিম সেক্টরে চীনা সেনাদের ভারতীয় জমি দখলকে নতুন স্থিতাবস্থা বা নিউ নর্মাল হিসেবে তুলে ধরতে চাইছে বেইজিং। তাদের কিশলয়, এ অবস্থাতেই যদি ভারতের সঙ্গে আগের মতো সীমান্ত আলোচনা শুরু করে দেওয়া যায়। তাদের কব্জা করে রাখা ভারতের হাজার দুয়েক কিলোমিটার এলাকায় তারা ক্রমশ বৈধতা পেয়ে যাবে। ঘরোয়াভাবে এমন আশঙ্কাই প্রকাশ করেছে দিল্লি।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বেইজিংয়ের ফাঁদে পা দিতে নারাজ সাউথ ব্লক। সদ্য প্রাক্তন চীনা রাষ্ট্রদূত সুং উইদং অক্টোবর মাসে তার বিদায়ী ভাষণে গোগরা হট স্প্রিং এলাকা থেকে সেনার পিছু হটাকে বড় করে দেখিয়ে বলেছিলেন, জরুরি পরিস্থিতি থেকে ভারত-চীন সীমান্ত এখন স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে ফিরেছে। দৌলতবেগসহ আরও অনেক এলাকায় যে চীনা সেনা ঘাঁটি গেড়ে রয়েছে তা সুকৌশলে এড়িয়ে গিয়েছিলেন উইদং।

এদিকে রাহুল গান্ধী এবার সরাসরি অভিযোগ তুলেছেন, করোনার অজুহাত তুলে তার ভারতজুড়ে যাত্রা বন্ধ করার চেষ্টা হচ্ছে। সম্প্রতি স্বাস্থ্যমন্ত্রী রাহুলকে যাত্রা বন্ধ করার জন্য চিঠি দিয়েছিলেন। রাহুল বলেন, স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন, ‘কভিড আসছে, যাত্রা বন্ধ করুন।’ যাত্রা আটকাতে নতুন ফন্দিফিকির খোঁজা হচ্ছে। আসলে ওরা ভারতের শক্তি, ভারতের অস্ত্রকে ভয় পেয়েছেন। তাই কংগ্রেসের যাত্রা বন্ধ করতে উঠেপড়ে লেগেছে। উল্লেখ্য, ’৭১ সালের যুদ্ধের সময় বাঙালি নিধনের জন্য চীন পাকিস্তানের কাছে প্রচুর অস্ত্র বিক্রি করেছিল। যে অস্ত্র তারা বিক্রি করেছিল, সেই অস্ত্রই তারা বাঙালিদের ওপর ব্যবহার করেছিল। এতদিন পরেও সে কথা সবার স্মরণে আছে।

লেখক : ভারতীয় প্রবীণ সাংবাদিক

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর