শুক্রবার, ৬ জানুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

কৃষিপণ্যের মূল্য নির্ধারক এখন কৃষকই

বিশেষ সাক্ষাৎকারে গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব শাইখ সিরাজ

কৃষিপণ্যের মূল্য নির্ধারক এখন কৃষকই

একুশে পদক ও স্বাধীনতা পুরস্কার জয়ী কৃষি উন্নয়ন এবং গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব শাইখ সিরাজ বলেছেন, ধান, পাট, ভুট্টার মতো ফুলও এখন অর্থকরী ফসল। দেশে বর্তমানে দেড় থেকে ২ হাজার কোটি টাকার ফুলের বাজার গড়ে উঠেছে। স্বাধীনতার পর শুরু হওয়া কৃষি আন্দোলন এবং আধুনিক কৃষিব্যবস্থা গড়ে তোলার আন্দোলনের ফসল হিসেবে কৃষি খাতের বাণিজ্যিকীকরণ সম্ভব হয়েছে। আমার একটা টার্গেট ছিল কৃষিপণ্যের মূল্য নির্ধারণ করবে কৃষক। কৃষক পাইকারের কাছে যাবে না। বরং পাইকাররা যাবে কৃষকের মাঠে। এখন কিন্তু সেটাই হয়েছে। গত সোমবার চ্যানেল আইয়ের কার্যালয়ে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব শাইখ সিরাজ এসব কথা বলেন। সাক্ষাৎকারটির চুম্বক অংশ তুলে ধরেছেন মানিক মুনতাসিরসাইফ ইমন

 

বাংলাদেশ প্রতিদিন : দেশের কৃষি ও কৃষকের উন্নয়নে আপনার ভূমিকা অনেক। সবার জন্য কৃষি- এ ধারণা কীভাবে জনমানুষের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করেছেন?

একসময় গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষই ছিল কৃষক। আমার দেশ, কাজের কথা, হৃদয়ে মাটি ও মানুষ, ফিরে চলো মাটির টানে, কৃষকের ঈদ আনন্দ- সব অনুষ্ঠানই হয়েছে কৃষি ও কৃষক ঘিরে। এর মাধ্যমে মানুষকে বার্তা দেওয়া হয়েছে। কৃষিকাজ সবার জন্য। অশিক্ষিত, শিক্ষিত, সাধারণ, অসাধারণ, ধনী-গরিব সবাই হতে পারেন সফল কৃষক। কৃষির বাণিজ্যিকীকরণ, আধুনিকীকরণসহ বহুমুখীকরণের আন্দোলন সফল হয়েছে বলেই আজ আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। আমরা আজ একটা খাদ্য নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যে রয়েছি। মেট্রোরেলের মতো মেগা প্রকল্পগুলোর বিষয়েও এটি সত্যি। একজন কৃষকেরও সাধ থাকতে পারে মেট্রোরেলে চড়ার এবং সরকারকেও এ নিয়ে ভাবতে হবে। আমার ভিশন ছিল শিক্ষিত মানুষের হাতে পড়তে হবে কৃষি খাতটা। তাহলে এটা সফল হবে। এখন সেটাই হয়েছে এবং হচ্ছে। এরপর ধীরে ধীরে মানুষকে ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে মোটিভেট করানো হতো। মাছ চাষ, মুরগি পালন, মুরগির খামার। পরে ছাদকৃষি, মাছ চাষ, বায়োফ্লকসহ নানা রকমের দেশি-বিদেশি ফল ও সবজির বাণিজ্যিক চাষ শুরু করা হয়; যার ফলস্বরূপ আজকে আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। এখন তো শিক্ষিত তরুণরাও কৃষিকাজ করছে।

 

বাংলাদেশ প্রতিদিন : কৃষিব্যবস্থার আধুনিকায়ন, বহুমুখীকরণ ও বাণিজ্যিকীকরণ প্রসঙ্গে জানতে চাচ্ছি।

সত্যি সত্যি বাংলাদেশের কৃষিটা স্বাধীনতার আগে ছিল সনাতনী। তখন সেটা ছিল গ্রাম বাংলার মানুষের দিন অতিবাহিত করা। সে সময় বাণিজ্যিকায়ন ছিল না। সেখানে প্রযুক্তির কোনো প্রভাব পড়েনি। কৃষির বিকল্প কোনো পেশা কৃষক ভাবেনি তখন। গ্রামের পরিধিও তখন ছিল বেশি। সারা পৃথিবীই তখন ছিল গ্রামনির্ভর। বাংলাদেশ এখনো গ্রামনির্ভর দেশ। তবে শহরায়নের আওতা বাড়ছে। সে সময়ের কৃষিটা জীবনযাপন করা বা জীবনটাকে কোনোভাবে পার করে দেওয়া। এ রকমই ছিল। ষাটের দশকের শেষ দিকে এসে আধুনিক ধানের চাষাবাদ শুরু হয়। সে সময় ধান আর পাটই ছিল প্রধান ফসল। বছরের বাকি সময় জমিগুলো খালি পড়ে থাকত। ওই সময় আবাদি জমি ছিল ৮০ লাখ হেক্টর। মানুষ ছিল সাড়ে ৬ বা ৭ কোটি। সে সময় আমরা খাদ্য আমদানি করতাম। এখন আমাদের জনসংখ্যা ১৭ কোটি। আমরা এখন খাদ্য রপ্তানি না করলেও সুগন্ধি চাল রপ্তানি করি। শাকসবজিও রপ্তানি হয়। এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ব্যাপকভাবে যে পরিবর্তন এলো। কীভাবে এলো। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুর একটা ভিশন ছিল, সেটা ছিল আধুনিক চাষবাস শুরু হবে এবং দেশের মানুষ খেয়ে-পরে বেঁচে থাকবে। তিনি চেয়েছিলেন আধুনিক চাষব্যবস্থার প্রবর্তন করতে। বলেছিলেন, মানুষ খেয়ে-পরে বেঁচে থাকবে দুই বেলা। এটা সবাই জানে।

 

বাংলাদেশ প্রতিদিন : আধুনিক ধান আবাদের পাশাপাশি বাংলাদেশকে বাম্পার কৃষির পথে নিয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে বলুন।

একটা সময় ছিল ধান এবং পাটনির্ভর কৃষি। আর আউশ এবং আমনের জন্য বর্ষার অপেক্ষায় থাকতে হতো। বৃষ্টির ওপর নির্ভর করতে হতো। ষাটের দশকের শেষ দিকে যখন উচ্চফলনশীল ধানের চাষ শুরু হয় তার নাম ছিল জাপানিকা ধান। তখন বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমির (বার্ড) কুমিল্লা প্রতিষ্ঠাতা মহাপরিচালক ছিলেন আখতর হামিদ খান। সেখানকার ভবন তৈরির জন্য ইট আনা হয়, তখন মানুষ দল বেঁধে ইট দেখতে আসে। গ্রামের মানুষের কৌতূহল ছিল যে ইট দেখতে কেমন। কুমিল্লার নোয়া বা আশপাশে কোনো এক গ্রামে প্রথম গভীর নলকূপ স্থাপন করা হয়। আমি সেই বাংলাদেশের কথা বলছি। শুকনো মৌসুমেও উচ্চফলনশীল ধানের চাষ শুরু হলো। মাটির নিচে গর্ত করে টিউবয়েল বসিয়ে সেই কৃত্রিম সেচব্যবস্থায় ধান চাষ হবে- এ ধারণাই গ্রামের মানুষের জন্য নতুন ছিল। এভাবেই মূলত ধীরে ধীরে বাংলাদেশকে বাম্পার কৃষির পথে নিয়ে গেছে। সারা বাংলাদেশে আমাদের ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট নানা মৌসুমের উপযোগী ধান উদ্ভাবন করল। ১ বিঘা জমিতে যে ধান উৎপাদন হতো ৫ মণ, সেটা এক লাফে উন্নীত হলো ১৫ থেকে ২০ মণে। যার ফল আমরা এখন ভোগ করছি। এটাই বাংলাদেশকে খাদ্য নিরাপত্তার একটা বলয়ের মধ্যে আনল। এটা শুধু বাংলাদেশে নয়, সারা বিশ্বেই এভাবেই বেড়েছে। গোটা পৃথিবীতেই জনসংখ্যা এবং খাদ্য উৎপাদনের বৃদ্ধির হার সমান ছিল না। যে হারে জনসংখ্যা বাড়ে সে হারে খাদ্য উৎপাদন বাড়ে না। এমন চলতে থাকলে দুর্ভিক্ষে কোটি কোটি মানুষ মারা যেত পৃথিবীতে। এ সময় শুরু হয় উচ্চফলনশীল জাতের উদ্ভাবন। একই সঙ্গে কৃষির আধুনিকীকরণ ও বহুমুখীকরণ শুরু হয়। এর ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশেও শুরু হয়। এখানেও কৃষককে পরামর্শ দেওয়া হলো খেয়ে-পরে বাঁচতে হলে শুধু ধান আর পাট করলে হবে না। ফলমূল, শাকসবজি, ভুট্টা, অন্যান্য বীজসহ বিভিন্ন রকম ফসল করতে হবে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এ কাজগুলো যখন শুরু হলো তখন কৃষকও সরকারের কাছ থেকে ভর্তুকি পেতে শুরু করল। এখন প্রতিজন কৃষক ভর্তুকি পাচ্ছে। এজন্যই কিন্তু কৃষক ধান আবাদে লেগে আছে। একইভাবে নিজের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রযুক্তির ছোঁয়ায় কৃষক ধান আবাদে লেগে আছে। যে বীজ থেকে উৎপাদন বেশি হয় সেটা একটা প্রযুক্তি। এর সঙ্গে সেচব্যবস্থা একটা প্রযুক্তি, লাঙল প্রযুক্তি, হারভেস্টরও প্রযুক্তি। এসব প্রযুক্তির ব্যবহারের পাশাপাশি কৃষিব্যবস্থায় বহুমুখী দিক উন্মোচন হলো। শুধু ধান-পাট নয়, শাকসবজি, ফলমূল, পোলট্রি, ফিশারি, ডেইরি সব দিকেই কৃষির প্রসার ঘটে।

 

বাংলাদেশ প্রতিদিন : গণমাধ্যমে যুক্ত হওয়া এবং ‘মাটি ও মানুষ’-এর পথচলা সফলতা সম্পর্কে জানতে চাই।

আমি প্রথম ১৯৮২ সালে বিটিভির সঙ্গে জড়িত হই। ‘মাটি ও মানুষ’ নামের অনুষ্ঠানটি একসময় ছিল ‘আমার দেশ’ নামে। তখন সেখানে ‘কাজের কথা’ নামে একটি অনুষ্ঠান হতো। পরে যেটাকে আমি পরিবর্তন করি ‘আমার দেশ’ নামে। সে সময় এটা বিনোদন বা কালারফুল কোনো অনুষ্ঠান ছিল না। মানুষ খুব একটা দেখতও না। তার আগে ১৯৭৫ থেকে ’৮২ সাল পর্যন্ত বিটিভিতে আমি নানা ধরনের অনুষ্ঠান করি। ১৯৮৬ সালে এসে আমি অনুষ্ঠানটির নাম দিলাম ‘মাটি ও মানুষ’। অনুষ্ঠানের শুরু থেকেই আমার ইচ্ছা ছিল স্মার্টরূপে মানুষের কাছে কৃষিকে তুলে ধরব। আমি চেয়েছিলাম কৃষির সংজ্ঞাটা পাল্টাতে। ততদিনে টেলিভিশনের প্রতি মানুষের আগ্রহটা কোন দিকে তা বুঝতে শুরু করেছি। এ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আমার ভিশন ছিল দুটি। একটি ছিল কৃষকের ও কৃষির সংজ্ঞা পাল্টাতে হবে এবং সেটাই হয়েছে। একসময় শুধু ধান আর পাটের ওপর নির্ভর করার ফলেই কৃষকের অভাব কাটছিল না। আর্থিক সংগতি ছিল না। পুষ্টি নেই, কারণ সে শাকসবজি উৎপাদন করে না। শহরে তরুণও কৃষক হতে পারে। একজন গৃহিণীও কৃষক হতে পারে। এমনকি একজন চাকরিজীবীও কৃষক হতে পারে। এ রকম দুটি ভিশন থেকে মাটি ও মানুষ অনুষ্ঠানটি শুরু করেছিলাম। আমি বুঝতে পেরেছিলাম শিক্ষিত মানুষের হাতে কৃষি খাত পড়লে এর গতিপ্রকৃতি পাল্টে যাবে।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : কৃষির বাজারকাঠামো নিয়ে আপনি অনেক কাজ করেছেন।

এ বিষয়ে যখন কাজ করতে গেলাম তখন দেখলাম একজন কৃষক ভ্যানে করে পণ্য নিয়ে এলো। তাকেও দিতে হচ্ছে ৩০ টাকা আবার যে ট্রাক নিয়ে এলো সে-ও ৩০ টাকাই দিচ্ছে। কোনো মার্কেটে ঢোকার আগেই দালালের লোকেরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে। দেখা যায় কৃষককে বাজার পর্যন্ত আসতেও দেওয়া হয় না। প্রতিবারই দেখা যায় পণ্যে মূল্য নির্ধারণ করছে দালালচক্র। সেখান থেকেই আমার চেতনায় এলো মূল্য নির্ধারণ করবে কৃষক। সেই সঙ্গে কৃষক কোনো সময় বাজারে পণ্য নিয়ে আসবে না। পাইকাররা যাবে কৃষকের কাছে তার মাঠে পণ্য কিনতে। তাহলে কৃষক সঠিক মূল্য পাবে। এভাবেই কৃষকের চিন্তার প্রতিফলনস্বরূপ ফুলও এখন অর্থকরী ফসল হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিপুলসংখ্যক কৃষক ফুল চাষে আগ্রহী হচ্ছে। আমার অনুষ্ঠানের প্রথম দিকের বার্তা ছিল বাজার ব্যবস্থাপনা বিষয়ে। কৃষককে সচেতন করতাম বাজার ব্যবস্থাপনা নিয়ে। আমিই শুরু করি ‘কৃষকের বাজেট কৃষি বাজেট’ অনুষ্ঠান। কৃষক জানতই না যে বাজেটে তার জন্য বরাদ্দ আছে। আমি তাদের সচেতন করেছি এসব বিষয়ে। আমার কাছে মনে হয় প্রতিটি সকালই নতুন। আর প্রতিটি দিনেই নতুন কিছু করতে হবে। আমার জীবনে না পাওয়ার কোনো আফসোস, খেদ বা ক্লেদ নেই। আমি পরিপূর্ণ।

 

সর্বশেষ খবর