রবিবার, ৮ জানুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

দক্ষিণ এশিয়ার পুলিশব্যবস্থা

আবুল কালাম আজাদ

মানবসভ্যতা আর পুলিশের ইতিহাস অভিন্ন বললেও বাড়িয়ে বলা হবে না। সভ্যতার অনুষঙ্গ হিসেবে পুলিশ-ব্যবস্থার শুরু। আমাদের এ ভূখণ্ডে আজ থেকে ৫ হাজার বছর আগেও যে সমাজবদ্ধ মানুষের অস্তিত্ব ছিল তা একটি প্রমাণিত সত্য। এ দেশের সঙ্গে ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের ব্যবসা-বাণিজ্য ছিল দুই-আড়াই হাজার বছর আগেও। এমনকি গ্রিক ও রোমানদের কাছে সে সময় পদ্মা মেঘনা যমুনা পাড়ের মানুষের পরিচিতি ছিল সমৃদ্ধ এক বীর জাতি হিসেবে। আমাদের এ ভূখণ্ডে সেই প্রাচীনকালেই মানবসভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল বলেই গড়ে উঠেছিল রাষ্ট্রব্যবস্থা। গ্রিকবীর আলেকজান্ডারের সহযাত্রীদের লেখায় তৎকালীন গঙ্গারিড অর্থাৎ আজকের বাঙালি জাতির কথা রয়েছে। রোমান কবি ভার্জিলও বীর জাতি হিসেবে পদ্মা মেঘনা যমুনা পাড়ের মানুষের প্রশংসা করে কবিতা লিখেছেন। সেই প্রাচীনকালেও সভ্যতার অনুষঙ্গ হিসেবে আমাদের এ উপমহাদেশে পুলিশব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল এটি অনুমান করা গেলেও আড়াই হাজার বছর আগের কোনো তথ্য-উপাত্ত আমাদের হাতে নেই। এ বিষয়ে আমাদের হাতে যে সুনির্দিষ্ট দলিল রয়েছে তা মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের আমলের।

আমাদের এ উপমহাদেশে অন্তত আড়াই হাজার বছর আগেও যে পুলিশব্যবস্থার অস্তিত্ব ছিল তার প্রমাণ কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র। বিষ্ণু গুপ্ত বা চাণক্য পাণ্ডিত্যের এই গ্রন্থে সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের সময়কার পুলিশব্যবস্থার কথা রয়েছে। চাণক্য পণ্ডিত মাগধের মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের (৩২২-২১৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) প্রধানমন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। প্রজাদের সুশাসন নিশ্চিত করা ও সম্রাট এবং সাম্রাজ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য পুলিশব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেন তিনি তাঁর বিশ্বখ্যাত গ্রন্থে।

মৌর্য সাম্রাজ্যের আমলে যেহেতু পুলিশব্যবস্থার অস্তিত্ব ছিল সেহেতু অনুমান করা যায় আজকের বাংলাদেশ এলাকায়ও পুলিশব্যবস্থা চালু ছিল। কারণ বাংলাদেশে যে মৌর্য শাসন চালু ছিল তার প্রমাণ হলো মৌর্য সম্রাট অশোকের আমলের একটি স্তম্ভ রয়েছে গাজীপুরের জয়দেবপুরে। এর পরের এক-দেড় হাজার বছরের ইতিহাস খুব বেশি স্পষ্ট নয়। তবে অনুমান করা যায় মৌর্য আমলের ধারাবাহিকতায় সুলতানি আমলের আগ পর্যন্তও রাষ্ট্রব্যবস্থায় পুলিশের অস্তিত্ব ছিল। সুলতানি আমলে আমাদের এ উপমহাদেশে তথা বাংলাদেশেও পুলিশব্যবস্থা চালু ছিল তার সুস্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে পুলিশব্যবস্থায় প্রাধান্য পেয়েছে গুপ্তচরেরা। যারা শাসন কর্তৃপক্ষের কাছে কোথায় কী ঘটছে সে তথ্য তুলে ধরতেন। সুলতানি আমলের পুলিশব্যবস্থায় শুধু গুপ্তচর নয়, আইন প্রয়োগেরও কর্তৃপক্ষ ছিল। মোগল শাসনামলে পুলিশব্যবস্থা নতুন কাঠামো লাভ করে। গুণগত দিক থেকে এটি ছিল অনেক বেশি উন্নত। আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে শৃঙ্খলাবদ্ধ কাঠামো থাকলেও তখন পর্যন্ত পেশাদার পুলিশ বাহিনী গড়ে ওঠেনি।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনামলে ভারতীয় উপমহাদেশে পুলিশ প্রশাসন ছিল মোগল শাসনামলের মতোই। কারণ ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহ পর্যন্ত খাতাকলমে ভারতীয় উপমহাদেশে মোগল শাসনই জারি ছিল। শেষ দিকের মোগল সম্রাটরা ছিলেন ইংরেজ বা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বৃত্তিভোগী। অথচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতীয় উপমহাদেশ শাসন করত দিল্লির মোগল সম্রাটের প্রদত্ত ক্ষমতাবলে।

কোম্পানি আমলে অবশ্য পুলিশব্যবস্থার প্রশাসনিক রূপরেখা প্রণয়ন শুরু হয়। ওই সময়ে পুলিশ প্রশাসনে পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফল ছিল ১৭৮২ সালের পুলিশ সংস্কার। মূলত ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের সময় থানাদারি ব্যবস্থার অসারতা প্রমাণিত হওয়ায় ১৮৬১ সালে গঠিত পুলিশ কমিশন ১৮৬০ সালের পুলিশ রিপোর্টের ভিত্তিতে পুলিশব্যবস্থাকে ঢেলে সাজিয়ে সারা দেশে নিখুঁত ও অভিন্ন বাহিনী গড়ার উদ্যোগ নেয়। এর ফলে বাংলাসহ ভারতের কয়েকটি প্রদেশে আইরিশ কনস্টেবল পদ্ধতির পুলিশব্যবস্থা প্রচলিত হয়।

বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর রয়েছে সোনালি ইতিহাস। মহান মুক্তিযুদ্ধে অনন্য ভূমিকা পালন করেছেন পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনী যে গণহত্যা শুরু করে তার প্রধান টার্গেটে পরিণত হয় রাজারবাগ পুলিশ লাইনস। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা প্রথম যাদের কাছে পৌঁছায় তাদের মধ্যে রাজারবাগের পুলিশ লাইনস অন্যতম। সঙ্গে সঙ্গে স্বাধীনতার সঙ্গে একাত্ম হন রাজারবাগের পুলিশ সদস্যরা। মুক্তিযুদ্ধে বিপুলসংখ্যক পুলিশ সদস্য অংশ নেন। দেশের মুক্তিসংগ্রামে শহীদ পুলিশ সদস্যের সংখ্যাও বিপুল।

স্বীকার করতেই হবে, পুলিশ বাহিনীর বিপুলসংখ্যক সদস্য একাত্তরে পাকিস্তানি প্রশাসনের অধীনে কাজ করেছেন। তবে তার সিংহভাগই আত্মিকভাবে ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। যে কারণে মুক্তিযুদ্ধে পুলিশ বাহিনীর গুটিকয় অবাঙালি সদস্য ছাড়া বাঙালি সদস্যরা কোথাও দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর শিখণ্ডী হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছেন এমন নজির নেই বললেই চলে।

স্বাধীনতার পর দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ বাহিনী কষ্টকর ভূমিকা রেখেছে। স্বাধীনতার পর পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকাররা তাদের অস্ত্রশস্ত্র যেখানে সেখানে ফেলে যায়। সেই অস্ত্রের একাংশ যায় পেশাদার অপরাধীদের হাতে। লুটপাট, ডাকাতি, চাঁদাবাজি ইত্যাদি কর্মকাণ্ডকে রাজনৈতিকভাবে আড়াল করার জন্য সংঘবদ্ধ অপরাধীরা ওইসব নিষিদ্ধ পার্টির সদস্য হিসেবে নিজেদের পরিচয় দিত। পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা এসব সন্ত্রাসী দমনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছেন। ২০২০ সালে করোনাভাইরাস মহামারি ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। সে সময় পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা মানবতার কল্যাণে যে ভূমিকা রেখেছেন তা এক কথায় অতুলনীয়। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত বাবা-মাকে সন্তানরা রাস্তায় কিংবা জঙ্গলে ফেলে রেখে গেলেও পুলিশ সদস্যরা তাদের পৌঁছে দিয়েছেন হাসপাতালে। মৃতদের সৎকারে তারা বহু ক্ষেত্রে একক ভূমিকা পালন করেছেন। শুধু দেশে নয়, বিদেশেও শান্তিশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীর সঙ্গে কর্মরত পুলিশ সদস্যরা অনন্য ভূমিকা পালন করেছেন।

লেখক : প্রাবন্ধিক

সর্বশেষ খবর