শিরোনাম
বুধবার, ১৮ জানুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

৫ কোটি মানুষের হত্যাকারী চেঙ্গিস খান

সুদীপ্ত সুজন

৫ কোটি মানুষের হত্যাকারী চেঙ্গিস খান

চেঙ্গিস খান ছিলেন দুনিয়ার সর্বকালের সবচেয়ে নৃশংস শাসক। ৪ থেকে ৫ কোটি মানুষের জীবনহানির জন্য দায়ী করা হয় এই মোঙ্গল শাসককে। তিনি তার সাম্রাজ্য মঙ্গোলিয়া থেকে এতটাই বিস্তার ঘটান যে তা প্রায় এশিয়া মহাদেশের সমান বড় হয়ে যায়।

রক্তপিপাসু শাসক হিসেবে চেঙ্গিস ইতিহাসে চিরকাল নিন্দিত হবেন। চেঙ্গিস খানের প্রতিশোধপরায়ণতার উদাহরণ দিতে গেলে বলতে হবে খাওয়ারিজমের শাসক মোহাম্মদ শাহের ওপর তার প্রতিশোধের কথা। চেঙ্গিস খানের একটি বাণিজ্য বহর খাওয়ারিজমের ওপর দিয়ে যাওয়ার সময় মোহাম্মদ শাহের সৈন্যরা বাণিজ্য বহরের লোকজনকে হত্যা করে। এ ঘটনার বদলা নিতে চেঙ্গিস খান ১০ হাজার সৈন্য নিয়ে খাওয়ারিজম আক্রমণ করেন। হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটিয়েও তিনি ক্ষান্ত হননি। মোহাম্মদ শাহকে আটক করে তার কান, নাক ও চোখের মধ্যে রুপা গলিয়ে সিল করে দেন। তাতেও তার রাগ পড়েনি। যে গ্রামে খাওয়ারিজমের শাসকের জন্ম সেই গ্রামের ওপর দিয়ে একটি নদীর পথ পরিবর্তন করে গ্রামটিকে চিরদিনের মতো মানচিত্র থেকে মুছে দেন। চেঙ্গিস খান তার শাসনামলে ৪ কোটিরও বেশি মানুষ হত্যা করেন। কখনো কোনো এলাকার কেউ যদি তার বিরুদ্ধে অবস্থান নিত, তিনি সেই জনপদের সব মানুষকে হত্যা করতেন।

চেঙ্গিস খান যখন রাশিয়া জয় করেন তখন সেই জয় অর্জিত হয় অনেক কষ্টের মাধ্যমে। তার পক্ষের ও বিপক্ষের অনেক সৈন্য মারা যায়। কষ্ট করে অর্জিত জয় উদযাপন করতে চেঙ্গিস খান অভিনব উপায় বেছে নেন। তিনি বেঁচে থাকা রাশিয়ান সৈন্যদের মাটিতে শুইয়ে দেন। তাদের ওপর বিজয় মঞ্চ তৈরি করেন। চেঙ্গিসের সৈন্যরা সেই মঞ্চের ওপর উল্লাসে নাচানাচি করে। যার চাপে রাশিয়ান সৈন্যরা পিষ্ট হয়ে মারা যায়। ইরানের ওপর চেঙ্গিস খানের সবচেয়ে ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হয়। চেঙ্গিস খান ইরান দখল করে পৈশাচিক হত্যাকান্ড চালান। এই গণহত্যায় ইরানের জনসংখ্যা এত কমে যায় যে, তা পূরণ হতে কয়েক শ বছর লাগে। চেঙ্গিস খান বাগদাদ আক্রমণ করে যে ধ্বংসযজ্ঞ চালান, তার কোনো তুলনা নেই। অনেক ঐতিহাসিক বলেন, চেঙ্গিসের ধ্বংসযজ্ঞে টাইগ্রিস নদীর জল কলমের কালি এবং বইয়ের কালিতে কালো হয়ে গিয়েছিল।

মোঙ্গলদের নিয়ম ছিল তারা কোনো অভিজাত বা রাজবংশীয় কারও রক্ত মাটিতে পড়তে দিত না। কিন্তু চেঙ্গিস খান যখন মনে করতেন কোনো অভিজাতকে হত্যা করা লাগবে তখন কোনো না কোনো একটা উপায় বের করতেন। তাদের মৃত্যুকে দুর্ঘটনা হিসেবে দেখানোর উপায় বের করতেন। চেঙ্গিস খান পৃথিবীর সর্বকালের সবচেয়ে ক্ষমতাবান ও শক্তিশালী শাসক ছিলেন। তার ছিল শক্তিশালী সেনাবাহিনী যারা ইচ্ছা করলে যে কোনো দেশ দখল করতে পারত। নিষ্ঠুরতা ও ধ্বংসযজ্ঞের জন্য চেঙ্গিস খান ও তার বাহিনী ইতিহাসে ঘৃণিত হয়ে থাকবে।

চেঙ্গিস খান প্রথমে তার শত্রুদের আত্মসমর্পণের সুযোগ দিয়ে তার সঙ্গে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব দিতেন। কেউ তা প্রত্যাখ্যান করলে তাদের ওপর ধ্বংস আর হত্যালীলা চালাত মোঙ্গল বাহিনী। চেঙ্গিস খান মনে করতেন এমনটা করলে শত্রুপক্ষ তাকে ভয় পাবে। ফলে তারা যুদ্ধ ছাড়াই আত্মসমর্পণ করবে। অনেক সময় তার এ কৌশল ফলপ্রসূ হয়েছে। তবে যদি কেউ তাকে কোনোভাবে অপমান করত, সেক্ষেত্রে অপমানকারীর দফারফা করেই তিনি ছাড়তেন।

ইরানের ইতিহাসবিদ রশিদ-আল-দীনের মতে, চেঙ্গিসের নেতৃত্বাধীন মোঙ্গল বাহিনী মার্ভে আনুমানিক ৭০ হাজার আর নিশাপুরে আনুমানিক ১০ লাখ লোককে হত্যা করেছিল। চীনের জনসংখ্যাও মারাত্মকভাবে প্রভাবিত হয়েছে মোঙ্গল অভিযানে। মোঙ্গলদের হামলায় লাখ লাখ মানুষ প্রাণ হারায়। চেঙ্গিসের চীন আক্রমণের সময় সে দেশের জনসংখ্যা ছিল ১০ কোটির মতো। ১২৭৯ সালের দিকে মোঙ্গলদের চীন অভিযান শেষ হয়। ১৩০০ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী তখন চীনের জনসংখ্যা ছিল বড়জোর ৬ কোটি! এই ৪ কোটির এক বড় অংশের প্রাণ গিয়েছিল চেঙ্গিস বাহিনীর হাতে। তবে সেই সংখ্যাটি ঠিক কত তা ইতিহাসবিদদের কাছে স্পষ্ট নয়।

সমরখন্দে যখন মোঙ্গল বাহিনী পৌঁছায়, তখন সেখানে তারা লক্ষাধিক সৈন্যের কাছ থেকে বেশ বড় রকমের প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। মনোবল না হারিয়ে মোঙ্গলরা অবরোধ আর আক্রমণ চালিয়ে যেতে থাকে। এক পর্যায়ে নগরীর পানি সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়। অধিবাসীরা পড়ে ভীষণ সংকটে। পতন ঘটে সমরখন্দের। এরপর শুরু হয় নারকীয় হত্যাযজ্ঞ। সে হত্যাযজ্ঞ এতটাই ভয়ংকর ছিল যে, মোঙ্গল সেনারা গর্ভবতী নারীদের পেট কেটে গর্ভের সন্তান বের করে উল্লাস করেছে! বিভিন্ন তথ্যমতে, সে সময় গণহত্যার শিকার হওয়া কিংবা পালিয়ে যাওয়া নগরবাসীর সংখ্যা ছিল প্রায় ৪ লাখ। চেঙ্গিসের রোষের আগুনে সবচেয়ে বেশি পুড়েছে মুসলিম ও ইহুদিরা। তাদের তিনি প্রকাশ্যে ‘ক্রীতদাস’ বলে সম্বোধন করতেন। চেঙ্গিসের রাজত্বে মুসলমান ও ইহুদিরা স্বাধীনভাবে ধর্মীয় বিধিবিধান পালনের সুযোগ পেত না। মুসলমান ও ইহুদিরা মোঙ্গলীয় রীতি অনুযায়ী খাবার-দাবার খেতে অস্বীকৃতি জানালে বেশ ক্ষেপে যান চেঙ্গিস। চেঙ্গিস মনে করতেন তার রাজ্যে করুণা করে যাদের থাকতে দিয়েছেন তাদের মোঙ্গলীয় রীতিতেই খাবার খেতে হবে। চেঙ্গিস মুসলিমদের ভেড়া জবাইয়ের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। ইহুদিদেরও খৎনা করানোর ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।

            লেখক : প্রাবন্ধিক

সর্বশেষ খবর