মঙ্গলবার, ২৪ জানুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

বঙ্গবন্ধুর পদতলে কাদেরিয়া বাহিনীর অস্ত্র জমাদান

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম

বঙ্গবন্ধুর পদতলে কাদেরিয়া বাহিনীর অস্ত্র জমাদান

মুক্তিযুদ্ধ শেষে ২৪ জানুয়ারি ১৯৭২ টাঙ্গাইল বিন্দুবাসিনী স্কুল মাঠে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর পায়ের কাছে কাদেরিয়া বাহিনীর অস্ত্র বিছিয়ে দিয়েছিলাম। যে অস্ত্র যুদ্ধ করে পাকিস্তানি হানাদারদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিলাম সেই অস্ত্র। দেশ হানাদারমুক্ত হয়েছিল ১৬ ডিসেম্বর ’৭১, অস্ত্র জমা দিয়েছিলাম ২৪ জানুয়ারি ’৭২। স্বাধীনতার মাত্র ৩৯ দিন পর।  ১৬ ডিসেম্বর দেশ হানাদারমুক্ত হলেও আমাদের তেমন শান্তি ও স্বস্তি ছিল না। পিতার অভাবে বুকে ছিল অব্যক্ত যন্ত্রণা। যাঁর নির্দেশে যাঁর আহ্বানে মুক্তিযুদ্ধ করেছি তিনিই নেই। কোথায় কীভাবে আছেন কেউ জানি না। ১৮ ডিসেম্বর পল্টন ময়দানে কাদেরিয়া বাহিনীর পক্ষ থেকে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম জনসভা। সেখানে বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছার অনুমতিক্রমে জামালকে নিয়ে গিয়েছিলাম। সেই সভায় চারজন নারী হরণকারী লুটেরাকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়েছিল। সে নিয়ে কত ষড়যন্ত্র কত ঘাটের পানি ঘোলা হয়েছিল আজ যা ভাবতেও অবাক লাগে। আমরা বলেছিলাম, ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে পিতাকে মুক্তি না দিলে আমরা পাকিস্তান আক্রমণ করব। এরপর রাতদিন ছটফট করেছি। যেখানে সামান্য খবর পাওয়ার সম্ভাবনা সেখানেই ছুটেছি। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে আনোয়ারুল আলম শহীদ, ড. নুরুন্নবী আরও কয়েকজনকে রাতদিন বসিয়ে রেখেছি। ইস্টার্ন কমান্ডারের হেডকোয়ার্টার কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামের সঙ্গে নিরন্তর যোগাযোগ রেখেছি কখন খবর আসে। একবার উড়ো খবরে সারা টাঙ্গাইল কেঁপে উঠেছিল। তাই সব মুক্তিযোদ্ধা শিবিরে কড়া নির্দেশ কোনোমতেই যেন গুলি ফোটানো না হয়। দিন যাচ্ছিল বড় ঢিমেতালে। কোনো কোনো সময় কখন কোথা দিয়ে দিন চলে গেছে বুঝতেই পারিনি। কিন্তু ১৬ ডিসেম্বর ’৭১ থেকে ৮ জানুয়ারি ’৭২ কেন যেন দিনগুলো ফুরোতে চাচ্ছিল না। ৮ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে যখন বঙ্গবন্ধু ইংল্যান্ডের উদ্দেশ্যে পিআইএর বিমানে ওঠেন তখন কোটি কোটি বাঙালি স্বস্তির শ্বাস ফেলে। সারা দেশ উদ্বেলিত হয়ে পড়ে। সবকিছু পাওয়ার আনন্দে জাতি উদ্বেল। মনে হয় স্কুলের ছাত্র, নৌকার মাঝি, গাড়ির চালক, সাধারণ মানুষ, ছাত্র-শিক্ষক সবাই আনন্দে উদ্বেল। সেরকম সব পাওয়ার আনন্দ আর কোনো দিন আমরা পাব কি না জোর দিয়ে বলা যায় না। ১০ জানুয়ারি ’৭২ ব্রিটিশ রাজকীয় বিমান জাতির পিতাকে নিয়ে তেজগাঁও বিমানবন্দরে অবতরণ করেছিল। বিমানবন্দর থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নেতাকে যেতে অনেক সময় লেগেছিল। আমরা বিমানবন্দরে আসতে পারিনি। পরদিন সকালে পিতার কাছে আসার চিন্তা করছিলাম। রাত ১১টা-সাড়ে ১১টার দিকে ফোন পাই যা কখনো মনের ভুলেও আশা করিনি। ফোন পেয়ে আমরা যারপরনাই সম্মানিত বোধ করছিলাম। সম্মানিত বোধ করা বলাটা বোধহয় ঠিক হলো না। আমাদের প্রচ- ভালো লেগেছিল। আমরা অপরিসীম আনন্দিত হয়েছিলাম। ১১ জানুয়ারি সাড়ে ৮-৯টায় ১৯ নম্বর ধানমন্ডির বাড়িতে এসেছিলাম। গাড়ি থেকে নেমে ছুটে গিয়ে পিতাকে সালাম করতেই তিনি কোলে তুলে নিয়েছিলেন। বঙ্গমাতাকে বলছিলেন, ‘দেখো দেখো কাকে নিয়ে এসেছি।’ বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা তাঁর মতো করে বলেছিলেন, ‘অনেক আগেই ওকে আমি দেখেছি। ও কয়েকবার এসে দেখা করে গেছে। এমনকি পল্টনের জনসভায় জামালকে নিয়ে গিয়েছিল।’ সেদিনের সে স্মৃতি আজও আমার দেহমনে উত্তাপ ছড়ায়। মুক্তিযুদ্ধের সময় পিতা ছিলেন মুজিবনগর সরকারের রাষ্ট্রপতি। সেদিনই রাষ্ট্রপতির পদ ত্যাগ করে হয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী এবং আমাদের অতি প্রিয় আমার গ্রামের মানুষ আবু সাঈদ চৌধুরীকে করেছিলেন রাষ্ট্রপতি। এর দুই বা তিন দিন পর পিতা আমায় সুগন্ধায় ডেকেছিলেন। যেটা এক সময় পাকিস্তান আমলে ইংল্যান্ডের রানি এলিজাবেথের জন্য তৈরি করা হয়েছিল। পিতার কাছে গেলে এটা ওটা জিজ্ঞেস করে বলছিলেন, ‘কাদের, শুনলাম তোর কাছে অনেক অস্ত্র। তোর অস্ত্র দিলে তবে অন্যদের বলতে পারি। যেখানে সেখানে এদিক ওদিক অস্ত্র পড়ে থাকলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা খুবই কঠিন হয়ে পড়বে। তুই প্রথম দে।’ বলেছিলাম, অস্ত্র দিতে অসুবিধা কী? তবে কার কাছে দেব? ‘কেন প্রশাসনের যারা আছে তাদের হাতে দিয়ে দে। অথবা আমি যদি কাউকে পাঠাই তাকে দে।’ কেন যেন বলেছিলাম, তা হয় কী করে? যুদ্ধ করেছি আপনার নির্দেশে অস্ত্র আবার কার হাতে দেব? সেদিন কথা আর এগোয়নি। অস্ত্র জমা দেওয়ার প্রথম আলোচনা সেখানেই শেষ। টাঙ্গাইল ফিরে কমান্ডারদের ডেকে বঙ্গবন্ধুর ইচ্ছার কথা বলেছিলাম। কারও কোনো দ্বিধা ছিল না। আমি যা করব তাতেই সবাই রাজি। দুই বা তিন দিন পর আবার ডাক পড়েছিল। প্রথমেই বলেছিলেন, ‘কাদের কী ভাবলি?’ না, তেমন কিছু ভাবিনি। আপনি যা বলবেন তা-ই হবে। পিতা, নেতা এক-দুবার আমতা আমতা করে বলেছিলেন, ‘আমি না গেলে হবে না?’ বলেছিলাম, না, কোনোমতেই না। কয়েক মিনিট কথাবার্তার মাঝে এক সময় বেশ উচ্চৈঃস্বরে বলে উঠেছিলেন, ‘বেশ, তোর যা ইচ্ছে সেভাবেই হবে। তোরা যুদ্ধ করে জীবন দিয়ে দেশ স্বাধীন করেছিস। তোদের কথা না শুনলে চলে?’ আমার মনে হয় এটা ছিল ১৬-১৭ তারিখ। ঠিক হলো ২৪ জানুয়ারি পিতা টাঙ্গাইল যাবেন আমাদের হাত থেকে অস্ত্র নিতে। এক বা দুই দিন মাইকে প্রচার হয়েছিল, কাদেরিয়া বাহিনীর অস্ত্র জমাদান উপলক্ষে শিবনাথ স্কুল মাঠে গার্ড অব অনার, বিন্দুবাসিনী স্কুল মাঠে অস্ত্র জমাদান অনুষ্ঠান, বিকালে টাঙ্গাইলের বিশাল পার্ক ময়দানে জনসভা। ২০ বা ২১ তারিখ আবার আমায় ডেকেছিলেন। বলেছিলেন, ‘কাদের, স্বাধীনতার পর রাজধানীর বাইরে প্রথম যাচ্ছি। তাই টাঙ্গাইলে আওয়ামী লীগের জনসভা না হয়ে অন্য কারও হলে দলীয় নেতা-কর্মীরা কীভাবে মুখ দেখাবে। এক কাজ কর, জনসভা আওয়ামী লীগের উদ্যোগে করার ব্যবস্থা কর।’ বলেছিলাম, বেশ তো আওয়ামী লীগ জনসভা করুক। তারা মাইক মারুক, মঞ্চ সাজাক আমাদের আপত্তি কী? তবে তিন-চার দিন মুক্তিবাহিনীর উদ্যোগে জনসভা প্রচারের পর আওয়ামী লীগের জনসভা এটা কেমন শোনাবে? পিতা বলেছিলেন, ‘যেমনই শুনাক, আওয়ামী লীগের জনসভা করতে হবে।’ রাতে টাঙ্গাইল ফিরলে এক মহাবিপর্যয়। আওয়ামী লীগের জনসভায় কারও মত নেই। কিন্তু আমার কোনো উপায় ছিল না। নেতাকে কথা দিয়ে এসেছি। সে কথা বদলাব কী করে? সবই আগের মতো রয়ে গেল সেই প্রচারক দল, যারা মঞ্চের আয়োজন করছিলেন সেই মঞ্চ তারাই করছেন শুধু বদলে গেল কাদেরিয়া বাহিনীর পরিবর্তে আওয়ামী লীগের জনসভা। চলতে থাকল প্রচার। অস্ত্র জমা দেওয়ার খুঁটিনাটি বিন্দুবাসিনীতে, শিবনাথ স্কুলে গার্ড অব অনার, বিন্দুবাসিনী মাঠে সাজানো অস্ত্র, পার্ক ময়দানে সভার মঞ্চ এবং দুই- আড়াই শ মাইকের হর্ন বাঁধার ব্যবস্থা। কেবল স্বাধীন দেশে মানুষের তখন আন্তরিকতা উৎসাহ ছিল দেখার মতো। আর টাঙ্গাইলে কাদেরিয়া বাহিনীতে ফাঁকিজুকির কোনো চল ছিল না। দেখতে দেখতে নববধূর সাজে টাঙ্গাইল সেজে উঠল। গোড়াই থেকে টাঙ্গাইল পর্যন্ত অসংখ্য তোরণ নির্মাণ করা হলো। গোড়াই মিলগেট, দেউহাটা, মির্জাপুর, শুভুল্যা, ধল্লা, জামুর্কী, পাকুল্লা, নাটিয়াপাড়া, বাওইখোলা, করটিয়া, ভাতকুড়া, সেখান থেকে শিবনাথ স্কুল মাঠ। তারপর বিন্দুবাসিনী স্কুল। ঢাকা থেকে টাঙ্গাইলের পথে প্রায় ২২-২৩টি সেতু ও কালভার্ট ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। তাই রাস্তা ছিল মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। সেই রাস্তাতেই বঙ্গবন্ধু অস্ত্র নিতে এসেছিলেন। শিবনাথ স্কুলের মাঠে ঢুকতে বেরোতে দুই পাশে দুটো করে চারটা সিক্স পাউন্ডার রাখা ছিল। পিতাকে গার্ড অব অনার দিতে মঞ্চে নিয়ে গেলে প্রায় ৯০০ বীর মুক্তিযোদ্ধা পিতাকে গার্ড অব অনার দিচ্ছিল। গার্ড পরিদর্শন করে মঞ্চে ফিরে পিতা জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘কাদের এরা কারা? এরা কি সেনাবাহিনীর?’ বলেছিলাম, না, মোটেই না। এতে ১৫-২০ জন সেনাবাহিনীর লোক থাকলেও থাকতে পারে, বাকি সবাই কৃষক শ্রমিক ছাত্র, গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষ। অবাক হয়ে পিতা বলেছিলেন, ‘কি বলিস?’ বলেছিলাম, ‘হ্যাঁ এটাই সত্য। অবাক হয়েছিলেন তিনি। মাইক সামনে দিলে কিছুটা জড়তা নিয়ে ‘আপনি আপনি’ করে বক্তৃতা করেছিলেন। বক্তৃতার ভাষা ও বিষয়বস্তু ঠিক থাকলেও মুক্তিযুদ্ধের নেতা আমাদের রাজনৈতিক পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মতো মনে হচ্ছিল না। সেখান থেকে নেতাকে নিয়ে গিয়েছিলাম বিন্দুবাসিনী স্কুল মাঠে। যে মাঠে ’৬০-’৬২ সাল থেকে অসংখ্য মিটিং করেছি। ৩০-৪০ হাজার লোক ধরার ক্ষমতা ছিল সেই মাঠের। উত্তর পাশে মঞ্চ করা হয়েছিল। মাঠের পশ্চিমে কয়েক হাজার অস্ত্র রাখা ছিল। তার পাশে ৩ হাজার যোদ্ধা হাতে অস্ত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। কমান্ডার আবদুল হাকিম বীরপ্রতীক ছিল অস্ত্র জমাদানকারী যোদ্ধাদের কমান্ডার। তার কয়েক গজ সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন কাদেরিয়া বাহিনীর অ্যাডমিনিস্ট্রেটর আবু মোহাম্মদ এনায়েত করিম। তার থেকে ২৫-৩০ গজ সামনে বঙ্গবন্ধুর পাশে প্যারেডের দিকে মুখ করে পিতা পুত্র এবং আনোয়ারুল আলম শহীদ। কমান্ডার আবদুল হাকিম বীরপ্রতীক প্যারেডকে সতর্ক করে যুদ্ধের শুরুতে আমার ব্যবহার করা পুলিশের ব্যাটাগান এনায়েত করিমের হাতে দেন। এনায়েত করিম এতক্ষণ প্যারেডের দিকে মুখ করা ছিলেন। কিন্তু হাতে অস্ত্র পেয়ে পেছন ফিরে মঞ্চের দিকে এগিয়ে আসেন। দুই-আড়াই ফুট উঁচু মঞ্চে সটান উঠে এসে আমার হাতে অস্ত্র দিয়ে তিনি তার আগের জায়গায় ফিরে যান। এনায়েত করিম তার আগের স্থানে ফিরে গেলে আমি এক পা এগিয়ে দুই পা বামে সরে হাঁটু গেড়ে পিতার পায়ের সামনে মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের অস্ত্র বিছিয়ে দিই। আমি উঠে আগের মতো পিতার পাশে দাঁড়ালে তিনি নিচু হয়ে অস্ত্রটি তুলে নেন এবং একটু নেড়েচেড়ে তাঁর ডানপাশে দাঁড়িয়ে থাকা আনোয়ারুল আলম শহীদের হাতে তুলে দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরেন। কেন জানি না আমার চোখে তখন বন্যা বইছিল। সেটা কষ্টের না আনন্দের বলতে পারব না। পিতাও অনেক কেঁদেছিলেন। তারপর তাঁর সামনে যখন মাইক্রোফোন দেওয়া হয় তিনি বলেন, ‘কাদের তুই বল।’ আমি তখনো কিছু বলার অবস্থায় ছিলাম না। পিতার কথা নেতার আদেশ মানতেই হয়। তাই মাইক্রোফোন নিয়ে বলেছিলাম, ‘আজ আমরা গর্বিত। যে নেতার আহ্বানে অস্ত্র ধরেছিলাম, দেশ স্বাধীন করে সেই মহান নেতার হাতেই আমরা আমাদের অস্ত্র দিলাম। আমরা আশা করব, দুষ্টের দমন শিষ্টের পালনে আমাদের এই অস্ত্র, এই পবিত্র আমানত কাজে লাগবে। দেশের মানুষ নয় মাস আধ পেটা খেয়ে কোনো কোনো সময়-না খেয়ে আমাদের খাইয়েছে। আমরা আমাদের জীবন দিয়ে সাধারণ মানুষকে নিরাপদে রাখার চেষ্টা করেছি। দেশের মানুষ যদি পেটপুরে খেতে না পারে, রাতে নিরাপদে ঘুমুতে না পারে, নির্বিঘ্নে চলতে না পারে, তাহলে স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যাবে। গত নয় মাসে হানাদারদের হাত থেকে মা, বাবা, ভাইবোন আত্মীয়স্বজন আমাদের রক্ষা করতে পারেননি। এই অস্ত্র দ্বারাই-আমাদের রক্ষা পেতে হয়েছে, এই অস্ত্র দ্বারাই দখলদারদের তাড়াতে হয়েছে। সেই অস্ত্রই আজ আমরা আপনার হাতে তুলে দিলাম। আমাদের কামনা, এর যেন অপপ্রয়োগ না হয়। আমরা মনে করি, সেনাপতির উপস্থিতিতে যোদ্ধাদের সেনাপতির ন্যায়সংগত আদেশ পালনই একমাত্র কর্তব্য। আমরা তা-ই করছি।

মুক্তিযোদ্ধা ভাইয়েরা, ‘বিগত নয় মাস যুদ্ধের ময়দানে আমি তোমাদের সামনে ঠেলে দিয়ে পেছনে থাকিনি। প্রতিটি যুদ্ধে তোমাদের আগে থেকেছি, আগে থাকার চেষ্টা করেছি। আবার যদি বাঙালিরা অত্যাচারিত হয়, আবার যদি আঘাত আসে, আমি কথা দিচ্ছি, তোমাদের আগে দিয়ে পেছনে থাকব না। আবার জাতীয় প্রয়োজন দেখা দিলে আমরা অবশ্যই অস্ত্র হাতে তুলে নেব।’

আমার বক্তৃতার সময় বঙ্গবন্ধু অঝোরে কাঁদছিলেন। তিনি বারবার রুমালে চোখ মুছছিলেন। সমবেত হাজার হাজার জনতা এবং মুক্তিযোদ্ধারা আনন্দ ও বেদনায় বারবার অশ্রুসিক্ত হচ্ছিল। আমার বক্তৃতা শেষে বঙ্গবন্ধু মাইক্রোফোনে এলে তাঁর তখন ভিন্ন চেহারা, চোখে অশ্রু, কণ্ঠে আবেগ, দেহমনে আবেশ। যিনি ঘণ্টাখানেক আগে শিবনাথ স্কুল মাঠে সমবেত মুক্তিযোদ্ধাদের ‘আপনি’ সম্বোধন করে বক্তৃতা করেছেন; তিনি এখানে নেতা, পিতা ও ভাইয়ের মতো মুক্তিযোদ্ধাদের ‘তুমি’ সম্বোধন করে কান্নাজড়িত দরদভরা কণ্ঠে এক অবিস্মরণীয় বক্তব্য রাখলেন, “আমি তোমাদের সালাম জানাই। ত্রিশ লক্ষ, মা, ভাই-বোন শহীদ হয়েছে। আমি তাদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করি। আমি তোমাদের হাতে অস্ত্র দিয়ে যেতে পারিনি। শুধু হুকুম দিয়ে গিয়েছিলাম। তোমরা হানাদারদের হাত থেকে অস্ত্র কেড়ে নিয়ে যুদ্ধ করে বিজয় সূর্য ছিনিয়ে এনেছ। তোমাদের তুলনা হয় না। বিশ্বে খুব কম এমন গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস আছে। তোমাদের সঙ্গে আমার আত্মার সম্পর্ক, রক্তের বন্ধন। তোমাদের নেতা কাদেরকে আমি মায়ের পেট থেকে পড়তে দেখেছি। লতিফকে হতে দেখেছি। তোমাদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। তোমরাই সত্যিকারের দেশ গঠনের উপযুক্ত কারিগর। তোমরাই দেশ গঠন করবে। সরকারি কর্মচারী, পুলিশের কথা আমি শুনব না। তোমরা যে খবর দিবা, তোমরা যে রিপোর্ট পাঠাবা, তা সত্য বলে ধরা হবে। কোনো সরকারি কর্মচারী ঘুষ খেলে তাকে ছাড়া হবে না। তোমরা আমাকে রিপোর্ট করবা। আমি তোমাদের রিপোর্ট বিশ্বাস করব এবং সরকারি কর্মচারীটিকে সোজা জানিয়ে দেবো, ‘ইউর সার্ভিস ইজ নো লংগার রিকোয়ার্ড।’ আমি সব মুক্তিযোদ্ধাদের যথাযথ মর্যাদা দেবো। তোমরা যারা স্কুল-কলেজে পড়তে চাও, তারা স্কুল-কলেজে যাবে। সরকার তাদের সম্পূর্ণ খরচ বহন করবে। যারা চাকুরি করতে চাও, তাদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। যারা কৃষিকাজ ও অন্যান্য পেশায় যেতে চাও, সরকার তাদের সব রকম সাহায্য করবে। কোনো জাতি তার বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান না দিয়ে বড় হতে পারে না। আমি তোমাদের মাঝে আবার আসব। জয় বাংলা, জয় কাদেরিয়া বাহিনী।”

অস্ত্র জমাদান অনুষ্ঠানে আমি যখন বঙ্গবন্ধুর পায়ের কাছে অস্ত্র দিচ্ছিলাম তখন মাঠে ৩ হাজার যোদ্ধা তাদের অস্ত্র ডানপাশে রেখে এক পা বামে সরে গিয়েছিল। আমরা যখন বক্তৃতা করি, পিতা যখন বক্তৃতা করেন তখন অস্ত্রগুলো মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে পড়েছিল। অমনভাবে অস্ত্র পড়ে থাকতে ওর আগে দেখিনি। সত্যিই অন্য রকম লাগছিল। সেদিন অনেক আশা নিয়ে পিতার পায়ের কাছে অস্ত্র বিছিয়ে দিয়েছিলাম। তাঁর হাতেও দিতে পারতাম। কিন্তু অস্ত্র যে কোনো শক্তি না শুধু এটা বোঝাতেই আমি পায়ের কাছে অস্ত্র দিয়েছিলাম। আমার সেদিনের সে চিন্তা সে চেতনা জাতির জন্য কোনো কাজে লেগেছে কি না বলতে পারব না। ‘নিজের ধন পরকে দিয়ে দৈবগ্য মরে কেথা বয়ে’- এ প্রবাদ অনেক আগেই শুনেছিলাম। সেটার কিছুটা ভাগীদার আমি নিজেও। বঙ্গবন্ধু যদি ভালো না বাসতেন, সম্মান না করতেন, গুরুত্ব না দিতেন তাহলে অস্ত্র জমা দেওয়ার বছরখানেকের মধ্যে আমরা অনেকেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতাম। কিন্তু বঙ্গবন্ধু আমাদের ভোলেননি, অমর্যাদা করেননি তাই টিকে ছিলাম, বেঁচে ছিলাম। কাদেরিয়া বাহিনীর অস্ত্র জমাদান অনুষ্ঠানটিও নির্বিঘ্নে হতে পারেনি। নানা রকমের গুজব, টাঙ্গাইল গেলে বঙ্গবন্ধুকে আটকে আমরা সব ক্ষমতা নিয়ে নেব। যে কারণে সেই অস্ত্র জমাদান অনুষ্ঠানে তেমন কেউ আসেননি। প্রধান সেনাপতি আসেননি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসেননি, পুলিশের আইজি আসেননি। সত্য বলতে কি জনাব তোফায়েল আহমেদ, শেখ শহীদ, শেখ জামাল, শেখ রাসেল ছাড়া অন্য কেউ আসেননি। বাংলাদেশ বেতারের লোকজন, টিভির লোকজন অসংখ্য সাংবাদিক তার মধ্যে এক সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা মাহবুবুল আলম ছাড়া আর তেমন কেউ আসেননি। বিন্দুবাসিনী স্কুল মাঠের আনুষ্ঠানিকতা শেষে টাঙ্গাইল পুলিশ প্যারেড ময়দানে শহীদ মিনারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলাম। ওপরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, নিচে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী। তখনো আমি বীরউত্তম হইনি। কারণ বীরউত্তমে ভূষিত হয়েছিলাম ’৭৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর। আর সেটা ছিল ’৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি। যদিও তখন কীভাবে যেন বঙ্গবীর হয়ে গিয়েছিলাম। বঙ্গবীর নিয়ে নানা জটিল সমীকরণ মুক্তিযুদ্ধের সময়ই আমাকে বিরক্ত করেছিল। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বীর মুক্তিযোদ্ধা মকবুল হোসেন খোকা হতেয়া স্কুল মাঠে হঠাৎই বঙ্গবীর বলে চিৎকার করছিল। তার চিৎকার চেঁচামেচি শুনে বিরক্ত হয়ে তাকে তিরস্কার করেছিলাম। মুক্তিযুদ্ধের সময় কাদেরিয়া বাহিনীতে কোনো রাগারাগি ফালাফালির স্থান ছিল না। যুদ্ধের সময় খেতে দিয়ে একদিন মা বলেছিলেন, ‘ক্ষমতাহীনদের আল্লাহর কাছে তেমন জবাব দিতে হবে না। কিন্তু যখনই আল্লাহ কারও হাতে শক্তি বা ক্ষমতা দেন তখনই তাকে কঠিন জবাবদিহির মধ্যে থাকতে হয়। জোরে কথা বলো না, কাউকে ধমক দিও না। কারও প্রতি মনে খেদ থাকলে তার বিচার আচারে জড়িও না।’ মা ছিলেন আমার প্রাণ আমার আত্মা। জ্ঞানত তাঁর কোনো কথার অবাধ্য হইনি। তাই মকবুল হোসেন খোকার ‘বঙ্গবীর বঙ্গবীর’ চিৎকার আমার কাছে ভালো না লাগলেও অন্যরা এই চিৎকার চেঁচামেচিতে কখনো পিছিয়ে পড়েননি। টাঙ্গাইল বিন্দুবাসিনী মাঠে অস্ত্র জমা নিয়ে বঙ্গবন্ধু এসেছিলেন পুলিশ প্যারেড ময়দানে শহীদ মিনারের প্রস্তরফলক উন্মুক্ত করতে। ওপরে পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, নিচে ছেলে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী। ’৭৫ পর্যন্ত একইভাবে ছিল। শহীদ মিনার তৈরি না হলেও শহীদ মিনারের স্থান প্রস্তুত ছিল। ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু নিহত হলে সেই প্রস্তরফলক খুলে পৌর ভবনে রেখে দেওয়া হয়, যেটা এখনো গোডাউনে পড়ে আছে। বিএনপির আমলে বঙ্গবন্ধুর নামের কারণে প্রস্তরফলক আর শহীদ মিনারে লাগেনি, আওয়ামী লীগের আমলে আমার নামের কারণে লাগেনি। শহীদ মিনারের প্রস্তরফলক উন্মোচন করে বঙ্গবন্ধু প্রায় ৩-৪ হাজার ভবিষ্যৎ বাহিনীর সামনে হাজির হয়েছিলেন। তারা বাঁশ, কাঠ ও নানা কিছু দিয়ে নানা রকম অস্ত্র বানিয়ে পিতার সামনে উপস্থিত হয়েছিল। ছেলেমেয়েদের ‘জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু’ সেøাগানের মাঝে পিতা বলেছিলেন, ‘তোমরা ভবিষ্যৎ বাহিনী হয়েছ আমি খুশি হয়েছি। আবার যদি বাংলার ওপর আঘাত আসে তোমরা যুদ্ধ করবা। করবা না?’ সব বাচ্চা চিৎকার করে উঠেছিল ‘করবো করবো করবো।’ বঙ্গবন্ধু আবার বলেন, ‘তোমরা প্রত্যেকেই কাদেরের মতো যোদ্ধা হবা। দেশকে রক্ষা করবা। সবাই ভালো থাকো, সুন্দর থাকো জয় বাংলা।’ মাঠভর্তি ছোট ছোট বাচ্চারা এতেই খুশি। এরপর পিতাকে নিয়ে গিয়েছিলাম ওয়াপদা ডাকবাংলোয়। পাকিস্তানি হানাদাররা আমাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিলে স্বাধীনতার পর বাবা-মা ভাইবোন টিনের ছাপড়া বানিয়ে আমাদের আকুরটাকুর পাড়ার বাড়িতে থাকত। পাশেই ওয়াপদা ভবনে আমি থাকতাম। সেই ভবনে গিয়েছিলেন পিতা। ধুলাবালিতে তাঁর সব শরীর ধূলিময় হয়ে গিয়েছিল। তাঁর কালো কোট ধূসর হয়েছিল। ব্রাশ করার সময় মারাত্মক অসুবিধা হয়েছিল। যে ব্রাশ করছিল হাতে নিয়ে কোনো কোট ভালোভাবে ব্রাশ করা যায় না। কারও গায়ে জড়াতে পারলে যতটা ভালো হয় হাতে নিয়ে ততটা ভালো বা সুন্দর হয় না। তাই একজনের গায়ে চড়ানোর প্রয়োজন ছিল। কিন্তু কার গায়ে চড়াবে। কে বঙ্গবন্ধুর কোট গায়ে তুলবে। এ রকম অবস্থায় কোট ব্রাশ করা বন্ধুটি যখন মারাত্মক বিব্রত তখন আমি সেখানে হাজির হয়েছিলাম। অবস্থা দেখে ড. নুরুন্নবীর গায়ে কোটটি চড়িয়ে ছিলাম। ড. নুরুন্নবীকে জুলাই-আগস্টে পেয়েছিলাম। তখন থেকে কোনো দিনই তাকে অত ছোট মনে হয়নি। বঙ্গবন্ধুর কোট গায়ে এত ছোট লাগছিল যা বলার মতো না। যে বন্ধুটি কোট ব্রাশ করছিল তার খুব সুবিধা হয়েছিল। পিতা সুন্দরভাবে গোসল করে জামাকাপড় পরে সার্কিট হাউসের পথে বেরুনোর মুহূর্তে এক দারুণ সুখবর পাওয়া যায়। নেতা গাড়িতে উঠতে যাবেন ঠিক সেই সময় রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত আন্দ্রে ফোমিন সেখানে হাজির হন মহান রাশিয়ার স্বীকৃতি নিয়ে। তার পর আমরা যাই সার্কিট হাউসে। আন্দ্রে ফোমিনও আমাদের সঙ্গে খাবার টেবিলে শরিক হন। খাওয়া শেষে সেই টাঙ্গাইল পার্ক ময়দান যেখানে টাঙ্গাইলের ইতিহাসে সব থেকে বড় জনসভা হয়েছিল। তখন দেশে লোক ছিল সাড়ে ৭ কোটি, এখন ১৭-১৮ কোটি। চ্যালেঞ্জ করে বলতে পারি, কারও পক্ষে এখন আর অত লোক একত্র করা সম্ভব না, সেটা যেভাবেই হোক। আর সেই টাঙ্গাইল পার্কও এখন আর আগের মতো নেই। স্টেডিয়াম, ঈদগা ময়দান, মওলানা ভাসানী অডিটোরিয়াম এসব নানা কিছুর কারণে ৩-৪ ভাগ হয়ে গেছে। তাই সেই মাঠ নেই। মনে হয় মাঠের দরকারও নেই। কারণ আমরা কেউ খুব একটা জনগণের ইচ্ছার মর্যাদা দিই না। বঙ্গবন্ধু সড়কপথে টাঙ্গাইলে এলেও সন্ধ্যার দিকে হেলিকপ্টারে ঢাকা ফিরেছিলেন। কী অবাক বিস্ময়ের ব্যাপার! মনে হয় দেখতে দেখতে সেই অস্ত্র জমা দেওয়ার সুবর্ণজয়ন্তী, ৫০ বছর পেরিয়ে গেল। আমরা সে সময় মানুষকে যে কথা দিয়েছিলাম তার অনেক কিছুই পূরণ করতে পারিনি। আর কবে যে পারব তাও জানি না। বড় ভালো লেগেছিল জামাল, রাসেল সেই রাতে আমার পাশের ঘরে কাটিয়ে ছিল। আমার সঙ্গে রাত এবং সকালের খাবার খেয়েছিল। কীভাবে দেখতে দেখতে ৫০ বছর কেটে গেল। সেই অস্ত্র জমাদানের সময়ের তোফায়েল আহমেদ আর সেদিন দেখে এলাম তোফায়েল আহমেদ কত পার্থক্য। নিজের শক্তিতে এখন তিনি উঠেও দাঁড়াতে পারেন না। কিন্তু ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের এই মহানায়ক তোফায়েল আহমেদকে ওই সময় না পেলে আগরতলা মামলা থেকে বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করতে না পারলে ‘জেলের তালা ভাঙবো শেখ মুজিবকে আনবো’ কখনো বাস্তবায়িত হতো না।  আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, আল্লাহ যেন আমাদের সুমতি দেন, দেশের জন্য কাজ করতে দেন, মানুষের কাজে লাগতে দেন- আমিন।

লেখক : রাজনীতিক

www.ksjleague.com

সর্বশেষ খবর