সোমবার, ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

মোশাররফ : রাজনীতিতে যিনি ছিলেন অস্ত্রধারী এক সওদাগর

এম জে আকবর

মোশাররফ : রাজনীতিতে যিনি ছিলেন অস্ত্রধারী এক সওদাগর

ওলট-পালট জীবনযাপন করে গেছেন জেনারেল পারভেজ মোশাররফ (জন্ম : ১১ আগস্ট ১৯৪৩-মৃত্যু : ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩)। কাহিনি নির্মাতা তিনি; কাহিনির নৈতিক মান জনচিত্তজয়ী ছিল না। তিনি জন্মেছিলেন ভারতে; দিল্লি নগরীতে। কিন্তু শাসন করেছিলেন পাকিস্তানে। জন্মভূমিকে রিক্ত-নিঃস্ব-বিপন্ন করার বাসনা ছিল তাঁর। বাসনা চরিতার্থ করতে গিয়ে পরাজয় আলিঙ্গন করেছেন।

ধূর্ত সেনাকর্তা মোশাররফ সামরিক বাহিনীতে খুব নামজাদা স্তরের কেউ ছিলেন না। কিন্তু রাজনীতিকদের পটানোর কাজে নৈপুণ্য ছিল, যা তাঁকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সর্বোচ্চ পদে বসিয়ে দেয়। ১৯৯৮ সালে ওই পদায়নটি করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ। পরের বছর ১৯৯৯-এর অক্টোবরে মোশাররফ তাঁর মনিব নওয়াজ শরিফকে ক্ষমতাচ্যুত করেন। শুধু তাই-ই নয়, নিয়োগকর্তাকে ঢুকিয়ে দেন কারাগারে। চমকপ্রদ ব্যাপার!

মোশাররফের আগে চমকপ্রদ কাজ করেছিলেন ভারতের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ি। ১৯৯৯-এর ১৯ ফেব্রুয়ারি তিনি একটি বাসে করে লাহোর নগরীতে হাজির হন। কোলাকুলি করেন পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের সঙ্গে। তাঁরা দুজন ওয়াদা করেন- ‘আমরা দুই দেশের মধ্যে আরেকটা যুদ্ধ ঘটতে দেব না।’ তাঁরা জামায়াতে ইসলামীর তৎপরতাকে উপেক্ষা করেছিলেন। বাজপেয়ির বাস বহর একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যাচ্ছিল লাহোর দুর্গে। জামায়েতিরা ওই বাস বহরে ইটপাটকেল ছুড়ে ছিল। অন্যদিকে, সেনাপ্রধান মোশাররফ কাশ্মীরের পার্বত্য এলাকার ‘কারগিল’ নামক জায়গাটি দখল করতে ছদ্মবেশে অনুপ্রবেশের জন্য সৈন্যদের হুকুম দিলেন। ওরা বেসামরিক পোশাকে সীমান্তের নিয়ন্ত্রণ রেখা পার হয়ে গেল।

প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকে না জানিয়েই অনুপ্রবেশের হুকুম করেছিলেন মোশাররফ। সামরিক রীতিনীতির পরোয়া না করার জঘন্য নজির এই শৃঙ্খলা লঙ্ঘনপরায়ণতা। এরই পরিণতিতে কারগিলে বেধে যায় পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ এবং পাকিস্তানকে করতে হয় অপমানকর আত্মসমর্পণ। বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর জন্য গ্লানিকর। তিনি মোশাররফকে বরখাস্তের উদ্যোগ নিচ্ছিলেন। এ সময় শ্রীলঙ্কা সফরে থাকা মোশাররফ অভ্যুত্থান ঘটান। দখল করেন ক্ষমতা। প্রেসিডেন্ট পদ কবজা করার ফাঁকফোকর সংবিধানে খুঁজে না পেয়ে মোশাররফ প্রাইভেট সেক্টরের শীর্ষ পদের কায়দায় নিজেকে ‘চিফ এক্সিকিউটিভ’ ঘোষণা করলেন। তাঁর পদের নাম কী, তাতে কিছু যায় আসেনি। তিনি শাসন করেছেন বন্দুক উঁচিয়ে। পরবর্তীকালে ‘প্রেসিডেন্ট’ হয়ে রাজনৈতিক দল করলেও রাজনীতিতে আদতে তিনি অস্ত্রধারীর এক সওদাগর। সরকার থেকে প্রকাশিত তাঁর আনুষ্ঠানিক ফটোগ্রাফও এই পরিচয়ের প্রমাণ দিচ্ছিল। ফটোতে দেখা যায়, দুটি পোষা কুকুর তাঁর চারদিকে চক্কর দিচ্ছে আর তিনি উঁচিয়ে ধরে রেখেছেন একটি পিস্তল। ২০০১ সালের জুনে মোশাররফ নিজেকে প্রেসিডেন্ট পদে উন্নীত করলেন এবং তাঁর করণীয় বিষয়গুলোর শীর্ষে রাখলেন ‘আগ্রায় বাজপেয়ির সঙ্গে শীর্ষ বৈঠক।’

এ ধরনের শীর্ষ বৈঠক প্রসঙ্গে ক্রুসেড জমানার একটি ঘটনা স্মরণযোগ্য। ক্রমাগত শক্তি বৃদ্ধিতে সচেষ্ট ইউরোপ এবং শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ক্ষয়িষ্ণু হলেও দাপুটে শক্তি আরবের মধ্যকার যুদ্ধ ‘ক্রুসেড’। জেরুজালেম দখলের জন্য বিখ্যাত দুই শাসক- বয়োবৃদ্ধ ফিলিস্তিনি শাসক সালাদীন ও ইংল্যান্ডের তরুণ রাজা রিচার্ড যে যুদ্ধ করেন তাতে শেষাবধি আরবরাই বিজয় অর্জন করে। ইংল্যান্ড ফিরে যাওয়ার আগে রিচার্ড চাইলেন সালাদীনের সঙ্গে বৈঠক করতে। বৈঠকের প্রস্তাব নাকচ করে দিলেন সালাদীন। এতে অপমান বোধ করলেন রিচার্ড। তিনি ফের যুদ্ধ শুরুর হুমকি দিলেন। কিন্তু সালাদীন তাঁর সিদ্ধান্তে অটল। বললেন, ‘বিরোধের খুঁটিনাটি প্রতিটি দিক মিটিয়ে নেওয়ার পরই রাজায়-রাজায় বৈঠক হওয়া উচিত। কারণ, শান্তি বৈঠকে রাজারা ব্যর্থ হলে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকা ছাড়া আর কোথাও যাওয়ার জায়গা থাকে না।’

আগ্রা এক সময় ছিল ভারতের রাজধানী। তাজমহলের জন্য জগদ্বিখ্যাত এই শহরে হবে পাকিস্তান-ভারত শান্তি বৈঠক। এখানে বৈঠকে বসার আগে মোশাররফ ২০০১ সালের ১৪ জুলাই পৌঁছলেন দিল্লিতে। ২১ বার তোপধ্বনি করে তাঁকে স্বাগত করা হলো। নওয়াজ শরিফ কারাবন্দি রয়েছেন, তবুও স্বপ্নবাজ অটল বিহারি রাজপেয়ি আশাবাদী। কারগিল যুদ্ধ ঘটানোয় মোশাররফের ভূমিকা তিনি নিজের কাছে চেপে গেলেন, স্বাগতিক তোপ দাগানোর কাজে সুইডেনে নির্মিত বোফর্স কামান ব্যবহার করলেন না। সম্ভবত তাঁর চিন্তায় ছিল, ‘এই কামান দেখে মোশাররফ অন্তরে চোট পেতে পারেন। কেননা কারগিল যুদ্ধে ভারতের হয়ে সক্রিয় ভূমিকা এই কামানেরই।

অভ্যর্থনা অনুষ্ঠানে জেনারেল মোশাররফকে উৎফুল্ল দেখাচ্ছিল। আটপৌরে সাদা জামা গায়ে তিনি ছবি তোলার জন্য সহাস্যে পোজ দেন। নিজ জন্মভূমে আসতে পারায় হয় তো তিনি সত্যি সত্যি সুখবোধ করছিলেন।

আগ্রা বৈঠকে বসার আগে মোশাররফ ১৫ জুলাই (২০০১) সকালে তাঁর সঙ্গে নাস্তা করার জন্য বাছাই করা কয়েকজন সম্পাদককে দাওয়াত করেন। মেহমান সম্পাদকদের কাছে তিনি যা বললেন তাতে আমাদের মনে হলো স্বঘোষিত ‘নিয়তির মানুষ’দের মতোই মোশাররফ নিজের গলার আওয়াজ খুব ভালোবাসেন। ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে একই বাক্য উচ্চারণ করেন তিনি, তবে তাতে আভাস ছিল যে, তিনি কয়েকটি ম্যাজিক ফর্মুলা নিয়ে এসেছেন। এতে অধিকাংশ সম্পাদক আমোদিত অথবা আশান্বিত অথবা কৌতূহলী হন। এঁদের অনেকেই খেয়াল করেননি যে, মোশাররফের সফরসঙ্গী পাকিস্তানি আমলারা ওই সময়টায় তাদের চেহারায় অন্তর যন্ত্রণার ছাপ গোপন করার ব্যর্থ চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। ওঁরা ভিতরের কেচ্ছা জানতেন, আমরা জানতাম না।

আগ্রা বৈঠকে মোশাররফ চার দফা পরিকল্পনা পেশ করেন। এটা স্রেফ লিখে আনা বিষয়ের পাঠ ছিল। কোনো খসড়া ছিল না যে, দুই পক্ষ কথাবার্তা বলে আনুষ্ঠানিক স্বাক্ষরের জন্য চূড়ান্ত কিছু বানাবে। মোশাররফ নিজেকে বোঝাতে সমর্থ হন যে, চার দফা শুধু পড়ে শোনানো হবে, আর ভারত তাতে রাজি হয়ে সই করে দেবে। চার দফায় যেসব ছিল তার অন্যতম : ‘কাশ্মীর ও জম্মু থেকে পর্যায়ক্রমে দুই দেশের সেনা প্রত্যাহার, প্রদেশটির স্বায়ত্তশাসনের জন্য ভারত-পাকিস্তান-কাশ্মীরের যৌথ ব্যবস্থাপনা এবং যুদ্ধবিরতি রেখা সবসময় মান্য করা।’ প্রথমোক্ত প্রস্তাব দুটি কার্যকর হলে তো কাশ্মীরে ভারতের সার্বভৌমত্ব বলে কিছু থাকবে না। প্রস্তাবে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে কোনো কথা নেই। সন্ত্রাসীদের নিন্দা জানিয়ে কিছু বলা নেই। (ওটা করলে মোশাররফ দেশে ফিরলেই পাকিস্তানের উগ্রবাদীরা মোশাররফকে খাবলে খাবলে খাবে!)

মোশাররফের চাতুরী ধরা পড়ে গেল। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এল কে আদভানি, পররাষ্ট্রমন্ত্রী যশোবন্ত সিং ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী জর্জ ফার্নান্ডেজের পরামর্শক্রমে প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ি জানিয়ে দেন এ রকম ফর্মুলায় তিনি সই করতে পারেন না। সন্ধ্যায় শীর্ষ আলোচনার মুখপাত্র তথ্যমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের জানান, শীর্ষ বৈঠক ব্যর্থ।

দুই দশক পর এখনো বিস্ময় জাগে কেন্দ্রীয় সরকারের জাঁদরেল সব আমলারা কীভাবে প্রতারিত হতে পারলেন! শীর্ষ বৈঠকের তারিখ নির্ধারণের আলোচনায় বসার আগে তাদের উচিত ছিল হোমওয়ার্ক করা। সম্ভবত তাঁরা সবাই নিজেকে নিজেই সম্মোহিত করে ফেলেছিলেন। বাজপেয়ির নেতৃত্বাধীন প্রতিনিধি দলের সিনিয়র এক রাজনীতিক তো সই করার জন্য উত্থাপিত কাগজ পড়ে হতভম্ব-বিমূঢ় হয়ে গিয়েছিলেন।

আগ্রা শীর্ষ বৈঠকের ছয় মাস পর ২০০১ সালের ১৩ ডিসেম্বর আক্রান্ত হয় ভারতীয় সংসদ ভবন। আক্রমণ চালিয়েছিল ঘাতক সংগঠক জইশ-ই-মোহাম্মদের পাঁচ সন্ত্রাসী। এসব সন্ত্রাসীর পৃষ্ঠপোষক পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই। মোশাররফ তখনো সেনাপ্রধান। কী ঘটানো হবে ভারতের রাজধানীতে আঘাত হানার সেই পরিকল্পনায় সেনাপ্রধানের সম্মতি নেয়নি আইএসআই, এমন হওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।

লেখক : প্রখ্যাত সাংবাদিক, ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী। (তাঁর রচিত ‘ব্যানালিটি অব অ্যান অ্যাক্সিডেন্টাল ডিক্টেটরশিপ’-এর একাংশের ভাবানুবাদ)।

সর্বশেষ খবর