শনিবার, ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

অ্যাভোকাডোর বাণিজ্যিক চাষের আগে প্রয়োজন সার্বিক গবেষণা

শাইখ সিরাজ

অ্যাভোকাডোর বাণিজ্যিক চাষের আগে প্রয়োজন সার্বিক গবেষণা

খাদ্য বিবেচনায় অ্যাভোকাডোকে ফল এবং সবজি দুই দলেই রাখা যায়, অনেকটা পেঁপের মতো। দারুণ পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ হওয়ায় ইউরোপ-আমেরিকায় স্বাস্থ্যসচেতন মানুষের কাছে অ্যাভোকাডোর দারুণ জনপ্রিয়তা। আমাদের দেশেও অ্যাভোকাডোর যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে। বিশেষ করে সুপারশপগুলোতে বিদেশ থেকে আমদানিকৃত এ ফল উচ্চমূল্যে বিক্রি হয়।  উচ্চমূল্যের ফলফসলের চাহিদার কথা মাথায় রেখে বাংলাদেশের অনেক কৃষকই উদ্যোগী হচ্ছেন নতুন নতুন ফলফসল উৎপাদনে। বিদেশি সবজির পাশাপাশি বিদেশি ফলের চাষও বাড়ছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিদেশি ফল ড্রাগন উৎপাদনের চিত্র বলে দিচ্ছে নতুন ফলফসল চাষে আমাদের দেশের কৃষকরা কতটা পারদর্শী। শুধু কৃষকই নয়, অন্য পেশার মানুষও আগ্রহী হচ্ছে এসব ফলফসল উৎপাদনে।

এমনই একজন ঝিনাইদহের কাগমারি গ্রামের হারুন অর রশীদ মুছা। তিনি স্কুলের শিক্ষকতার পাশাপাশি নতুন ফলফসল চাষে দারুণ সফল। মোট ২০ বিঘার সমন্বিত ফলবাগান তার। এখানে উৎপাদন করছেন অ্যাভোকাডো, মাল্টা, পারসিমন, লংগান, থাই জাম, কমলা, ড্রাগন, ফিলিপিনো আখসহ বিভিন্ন ফসল। গত এক যুগে দেশে ফলের উৎপাদন বেড়েছে ২২ শতাংশ। কম জমিতে বেশি মানুষের দেশ হিসেবে ফল উৎপাদনে বিশ্বের শীর্ষ দেশগুলোর তালিকাতেও এখন আমরা। আবার ফল চাষের জমি বৃদ্ধির দিক থেকেও বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষস্থানে উঠে এসেছে। এই হিসাবে, বছরে ফল চাষের জমি বাড়ছে ১০ শতাংশ হারে। শুধু ফলের উৎপাদন বৃদ্ধির দিক থেকে নয়, দেশের মানুষের মাথাপিছু ফল খাওয়ার পরিমাণও দ্বিগুণ হয়েছে গত এক যুগে। ২০০৬ সালের এক হিসাবে বাংলাদেশের মানুষ গড়ে দিনে প্রায় ৫৫ গ্রাম করে ফল খেত। বর্তমানের হিসাবে সেটি প্রায় ৮৫ গ্রামে উন্নীত হয়েছে। যা দেশের মানুষের জন্য নিরাপদ খাদ্য এবং নিরাপদ পুষ্টি গ্রহণ অবস্থার উন্নয়নের একটি বার্তা। দুই দশক আগেও দেশের বিভিন্ন এলাকায় আম, জাম, কাঁঠাল, কলা, পেঁপে, লিচু ছাড়া উল্লেখযোগ্য কোনো ফল উৎপাদনের চিত্র দেখিনি। অথচ গত দুই দশকে নতুন নতুন ফলফসলে বদলে যাওয়া বহু এলাকার চিত্র দেখছি। কৃষক, উদ্যোক্তাদের মাল্টা, ড্রাগন, পেয়ারা, কুল, কমলা, লটকন ও অ্যাভোকাডোর মতো পুষ্টিকর ফল উৎপাদনে সফল হয়েছেন অনেকে। যা হোক, গ্রামের ফসলের মাঠে হাঁটতে হাঁটতে কথা হচ্ছিল মুছার সঙ্গে। মাঠজুড়েই বিভিন্ন ফসল। কোথাও হয়তো লাউ চাষ হচ্ছে, পাশের জমিতেই ড্রাগনফ্রুট, পেয়ারা, কলা, আম্রপালি আম কিংবা ফিলিপিনো আখ। এক সময় শুধু ধানই চাষ হতো এসব জমিতে। এখন ফসল বৈচিত্র্যের দারুণ সম্মিলন। মুছা বলছিলেন, উচ্চমূল্যের ফসলের নেশায় যুক্ত হয়েছেন ২০০৫ সালে। প্রথমে বাউকুল, পেয়ারা চাষ করেছেন। তারপর একে একে ড্রাগন, ফিলিপিনো আখ থেকে নানারকম দেশি-বিদেশি উচ্চমূল্যের ফল চাষের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন তিনি। সারি বাঁধা আখের খেতের পাশ দিয়ে যেতে যেতে জানালেন, গত দুই বছর ধরে দুই বিঘা জমিতে চাষ করছেন ফিলিপিনো আখ। সারি সারি ফিলিপিনো আখ দেখতে কালচে রঙিন ও বেশ লম্বাকার। জানা গেল, মাঠের এই আখ ভোক্তাদের খাওয়ার জন্য নয়, উৎপাদন হচ্ছে বীজ হিসেবে। এই আখের চাহিদা অনেক। প্রতিটি আখ বীজ হিসেবে কমপক্ষে ১০০ টাকা আর চিবিয়ে খাওয়ার জন্য কমপক্ষে ৫০ টাকা দরে বিক্রি করা যায়। মুছা জানালেন এক বিঘা জমিতে আছে ১২ হাজার আখ। এই আখ চাষে মোট খরচ ৫০ হাজার টাকা। প্রতিটি আখ ৫০ টাকা হিসেবে বিক্রি করলেও ৬ লাখ টাকা অনায়েসেই পাওয়া যায়। আর বীজ হিসেবে বিক্রি করলে পাওয়া যাবে ১২ থেকে ১৫ লাখ টাকা। 

এরপর মুছা নিয়ে গেলেন ড্রাগন ফল চাষের খেতে। এখানে ১২ বিঘা ড্রাগন বাগানের মধ্যে পিংক রোজ জাতের ড্রাগন আবাদ হচ্ছে পাঁচ বিঘায়। দেখতে গোলাপি রঙের এই ড্রাগন অন্য জাতের ড্রাগনের থেকে অধিক ফলনশীল ও লাভজনক, বললেন তিনি। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে গোটা দেশেই রকমারি ফলের উৎপাদন লক্ষ্য করা যায়। শুধু ড্রাগন নয়, বারোমাসি আম, মাল্টা, কমলাসহ বিভিন্ন ফল উৎপাদনের সাফল্য দেখতে পাই। একজন স্কুলশিক্ষক হয়েও হারুন অর রশীদ মুছা কৃষিতেও দারুণ আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছেন। তার পরিশ্রম আর হাতের যশে উৎপাদন হচ্ছে বৈচিত্র্যময় ফসল। যা থেকে তিনি পেয়েছেন সচ্ছলতা। সবচেয়ে বড়কথা বহু মানুষের কাছে তিনি নতুন নতুন ফলের বীজ পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে অবদান রাখছেন। আবার সৃষ্টি করেছেন বহু মানুষের কর্মসংস্থানও।

মুছার বাড়ির আঙিনায় রীতিমতো চলছে নতুন ফলফসল নিয়ে গবেষণা। সব ধরনের উচ্চমূল্যের ফলফসলের চাষ মাঠে নেওয়ার আগে এখানেই ট্রায়াল করেন তিনি। এরপর মুছার বাড়ির পাশেই অ্যাভোকাডোর বাগানে গেলাম। দেশের বিভিন্ন স্থানে একটা-দুটো অ্যাভোকাডো গাছ থাকলেও, জানামতে বাণিজ্যিকভাবে এটিই বাংলাদেশের প্রথম অ্যাভোকাডো চাষের বাণিজ্যিক প্রয়াস। ছয় বিঘা জমিতে তিনি গড়ে তুলেছেন অ্যাভোকাডো বাগান। গাছে গাছে ঝুলছে দামি এই ফল। মুছা জানালেন তার অ্যাভোকাডো চাষের শুরুর গল্পটা। ২০১৯ সালে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণার সাবেক মহাপরিচালক এনামুল হকের সহযোগিতায় বিদেশি ব্যয়বহুল অ্যাভোকাডোর চারা এনে রোপণ করেন। দুই বছর ধরে তার গাছে অ্যাভোকাডো ধরছেও। তার বাগানে প্রায় ২৫০ অ্যাভোকাডো গাছ রয়েছে। যার বেশিরভাগেই ফল এসেছে। এবার তিনি প্রতি কেজি ৫০০ টাকা দরে ফল বিক্রি করছেন। যা বিদেশে মিশন থেকে ফিরে আসা সেনা সদস্যরা ছাড়াও ঢাকা, ময়মনসিংহ, বরিশাল, রংপুরসহ বিভিন্ন জেলার ফল ব্যবসায়ীরা অনলাইনে কিনে নিয়ে যাচ্ছেন।

মুছার কাছে জানতে চাইলাম, ‘অ্যাভোকাডো গাছ তো প্রচুর পানি শুষে নেয়। চাষে তো প্রচুর সেচ প্রয়োজন হয়। সেচের জন্য কী ব্যবস্থা নিয়েছেন?’ তিনি জানালেন, জুলাই-আগস্ট মাসে ফল আসে। তখন বর্ষাকাল বলে সেচ ততো দিতে হয় না। তবে শুকনো মৌসুমে সেচ দিতে হয়। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে তার বাড়ির চারদিক বাঁওড় বেষ্টিত, ফলে মাটিতে পানির তেমন ঘাটতি নেই।

ঢাকায় ফিরে উদ্যান বিশেষজ্ঞ মেহেদী মাসুদের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, অ্যাভোকাডো চাষ আমাদের দেশের মাটির জন্য কতটা উপযোগী। তিনি অ্যাভোকাডোর বাণিজ্যিক চাষকে নিরুৎসাহিত করলেন। বললেন, হয়তো ৫-৭ বছর ভালো ফলন মিলবে। কিন্তু এরপর যখন মাটি পানিশূন্য হয়ে যাবে। ফলন হবে না। তখন অন্য ফসলও চাষ করা কঠিন হয়ে যাবে।

যা হোক, ফলফসলের সঙ্গে নিবিড় এক সম্পর্ক হারুন অর রশীদ মুছার। ভিতরে কৃষির প্রতি গাঢ় টান না থাকলে সফলতা আসে না। তারই প্রমাণ হারুন অর রশীদ মুছা।

দিন দিন বাড়ছে ফসল বৈচিত্র্যের পরিধি। প্রশ্ন হচ্ছে, নতুন নতুন বিদেশি ফলফসল চাষে বাংলাদেশের পরিবেশে কোনো প্রভাব পড়বে কি না। দেশে ফলফসলের বৈচিত্র্য বাড়াতে এবং পুষ্টি চাহিদা পূরণে ব্যক্তি পর্যায়ের এই উদ্যোগগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। তবে যে কোনো বাণিজ্যিক উদ্যোগের আগে প্রয়োজন ভালো করে জানা-বোঝা এবং প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণার।  বিদেশি ফলফসল চাষ আমাদের মাটি ও পরিবেশে কোনো বিরূপ প্রভাব পড়ছে কি না তা যাচাইয়ের প্রয়োজন আছে। বাণিজ্যিক চাষের আগে চাষ-আবাদ সম্পর্কে যেমন পরিপূর্ণ ধারণা থাকা দরকার, তেমনি প্রয়োজন বাজার ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে সম্যক ধারণা।  কৃষির সুপরিকল্পিত বিকাশে সব পক্ষ থেকে কার্যকরী ভূমিকায় নিশ্চিত করতে পারে টেকসই উন্নয়ন।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।  

[email protected]

সর্বশেষ খবর