বৃহস্পতিবার, ২ মার্চ, ২০২৩ ০০:০০ টা

উদ্যোক্তা তৈরির মোক্ষম হাতিয়ার!

ড. মো. জামাল উদ্দিন

উদ্যোক্তা তৈরির মোক্ষম হাতিয়ার!

টিভিতে প্রচারিত কৃষি বিষয়ক একটি অনুষ্ঠান উদ্যোক্তা তৈরিতে মানুষের মনোজাগতিক কত পরিবর্তন আনতে পারে, তা ‘চ্যানেল আই’-এর ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’ না দেখলে বোঝা যাবে না। সম্প্রতি চ্যানেল আইয়ে প্রচারিত মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কৃষি বিষয়ক বিশেষ অনুষ্ঠান ‘শেখ হাসিনার ফসলি উঠোন’টি সারা দেশে বেশ সাড়া ফেলেছে। পৃথিবীতে কোনো রাষ্ট্রপ্রধানের কৃষির প্রতি এহেন আগ্রহ আছে বলে জানা নেই যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রয়েছে। কৃষি উন্নয়ন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব জনপ্রিয় শাইখ সিরাজের সাবলীল ভঙ্গিতে করা পুরো অনুষ্ঠানটি পরিবারসহ বেশ উপভোগ করেছি। অনুষ্ঠানটি দেখতে দেখতে কখন শেষ হয়ে গিয়েছিল তা বুঝতে পারিনি। যতই দেখি ততই দেখার সাধ জেগেছিল। প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে শাইখ সিরাজের এহেন অসাধারণ উপস্থাপনা নিঃসন্দেহে সবার হৃদয়ে দাগ কেটেছিল। কৃষির প্রতি মানুষের তাৎক্ষণিক চমৎকার অনুভূতি তৈরি হয়েছিল। একজন প্রধানমন্ত্রীর এ ধরনের অনুষ্ঠান করতে রাজি হওয়া দেশের প্রতি তথা কৃষির প্রতি ভালোবাসারই বহিঃপ্রকাশ।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী গণভবনে যে বহুমুখী কৃষি উৎপাদনের দৃষ্টান্ত গড়েছেন, তা দেশের মানুষের জন্য শিক্ষণীয়। তাকে দেখে দেশের মানুষ আরও অনেক বেশি আগ্রহী ও উৎসাহিত হবে কৃষিতে। সত্যি এ দেশের মাটি সোনার চেয়ে খাঁটি। গণভবনের মাটিও এর থেকে বাদ যায়নি। তাই গণভবনের আঙিনা কৃষিতে সোনার ফসল ফলেছে। সে উল্লেখযোগ্য বতুয়া শাক (বুইত্ত্যা শাক) থেকে শুরু করে সরিষায় মৌ চাষ, হাঁস-মুরগি ও কবুতর পালন, মাছ চাষ ও গরুর খামারসহ কৃষির এক মহামিলন ঘটেছে ওই আঙিনা কৃষিতে। যাকে এক কথায় বলা যায় একটি সমন্বিত আধুনিক কৃষি খামার। এখান থেকে দেশের মানুষের অনেক কিছু শেখা বা উপলব্ধি করার রয়েছে যার ওপর ভিত্তি করে দেশের মানুষ ইচ্ছে করলে যে কোনো জায়গায় কৃষির বিপ্লব ঘটাতে পারে। যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী করে দেখিয়েছেন। এটি বহিঃবিশ্বের অনেক সরকার প্রধানের জন্যও অনুকরণীয় হতে পারে।

ওই অনুষ্ঠানে শাইখ সিরাজকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানিয়েছেন, ছোটবেলায় বাবার কাছেই তাঁর কৃষির হাতেখড়ি। তিনিই সব ভাইবোনকে কৃষি অনুশীলনের সুযোগ করে দিতেন। পরবর্তী সময়ে দেশের রাজনীতির সঙ্গে যখন সরাসরি সম্পৃক্ত হন, তখনো গ্রামের হতদরিদ্র মানুষ নিয়ে কাজ করেছেন, দেখেছেন তাদের দুঃখ-দুর্দশার কথা। বাংলাদেশের অর্থনীতির ভিত্তিই তো কৃষির ওপর। অন্যদিকে জনসংখ্যাও বেশি। সেটা বিচার করে কৃষির ওপর জোর দিতেই হয় সব সময় সেটাও ওই সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী।

‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’ প্রতিনিয়ত দেশি-বিদেশি কৃষির বিভিন্ন সফল দিক নিয়ে অনুষ্ঠান করে থাকেন যা উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য মানুষ অনুপ্রাণিত হয়। অনুষ্ঠানগুলো বেশ মানসম্মত হয় বিধায় দেখার ইচ্ছে জাগে। তেমনি কিছু অনুষ্ঠানের কথা না বললে নয়। সম্প্রতি প্রচারিত হৃদয়ে মাটি ও মানুষের এক অনুষ্ঠানে নতুন আবাসনের জন্য গড়ে ওঠা খালি জায়গায় সবুজের সমারোহ ঘটিয়েছেন ঢাকা পূর্বাচলের আঙিনা কৃষি উদ্যোক্তা কাজী ফাহমিদা হক। একই সঙ্গে প্রচারিত হয় আমেরিকার আটলান্টিক সিটির আঙিনা কৃষির প্রবাসী উদ্যোক্তা রাজিব আহমদের ওপর শাইখ সিরাজের করা চমৎকার প্রতিবেদনটি। যেটি বিদেশের মাটিতে মনে হবে ছোট্ট এক সবুজ বাংলাদেশ। এরকম বহু অনুষ্ঠান তার চমৎকার উপস্থাপনার মধ্য দিয়ে তিনি জাতিকে উপহার দিয়েছেন। দেশি-বিদেশি সফল কৃষি উদ্যোক্তাকে নিয়ে শাইখ সিরাজের এমন অনুষ্ঠান দেশের তরুণ যুবকদের কৃষিতে বেশ আগ্রহী করে তুলছে এবং তুলবে। খোরপোষ কৃষি থেকে বাণিজ্যিক কৃষিতে রূপান্তরে শাইখ সিরাজের এ ধরনের অনুষ্ঠান বেশ কার্যকর ভূমিকা রাখে নিঃসন্দেহে। অন্যান্য টিভির কৃষির বিভিন্ন অনুষ্ঠানও কৃষির উন্নয়নে বেশ সহায়ক ভূমিকা রাখছে। উদ্যোক্তা তৈরিতে গণমাধ্যমের ভূমিকা অনস্বীকার্য। কৃষির উন্নয়নে বর্তমান গণমাধ্যমের ভূমিকা বেশ প্রশংসনীয়।

গত ডিসেম্বর ২০২২-এ ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’ অনুষ্ঠানে ফিলিপিন্সের ‘সাইলেন্ট ইন্টিগ্রেটেড ফার্ম’ নিয়ে শাইখ সিরাজের প্রতিবেদনটি পরিবারসহ দেখে বেশ আবেগ-আপ্লুত হয়ে পড়েছিলাম। ফিলিপিন্সের লাগুনা প্রভিন্সের লিলিউতে অবস্থিত অর্গানিক খামারটির ওপর প্রতিবেদনটি ছিল অসাধারণ! একদল বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষ যারা শারীরিক ও মানসিক সীমাবদ্ধ তাদের নিয়ে ফার্মটি পরিচালিত করছেন ২৩ বছর বয়সী একজন তরুণী উদ্যোক্তা। যিনি নিজেকে সব সময়ই আড়ালে রাখলেও তাঁর দ্বারা পরিচালিত সাড়ে তিন হেক্টর অর্থাৎ প্রায় ২৫-২৬ বিঘা জমির ওপর গড়ে ওঠা সাইলেন্ট ইন্টিগ্রেটেড ফার্মটি একটি অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হতে পারে। অর্থনৈতিক উন্নয়নে, খাদ্য নিরাপত্তা ও নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে শারীরিক ও মানসিক সীমাবদ্ধ লোক যে নীরবে (সাইলেন্ট) ভূমিকা রাখছেন তা ওই প্রতিবেদনে চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে। বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষের পাশাপাশি সেখানে কাজের সুযোগ পেয়েছেন স্থানীয় অনেক সিনিয়র সিটিজেন। সব মিলে সম্পূর্ণ অর্গানিক ও স্বাস্থ্যসম্মত কৃষিক্ষেত্রটি পরিণত হয়েছে ভিন্ন এক মাত্রায়। ২০১৮ সালে ফিলিপিন্সের লাগুনাতে আমারও যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। ওই ফার্মটি আমার দেখার সুযোগ না হলেও সেখানকার অনেক সফল কৃষি উদ্যোক্তাদের ফার্ম দেখার সুযোগ হয়েছিল এবং অনুপ্রাণিত হয়েছি। শাইখ সিরাজের দেশি-বিদেশি কৃষি বিষয়ক অনুষ্ঠান দেখে অনেক লোক অনুপ্রাণিত হয়ে কৃষির উদ্যোক্তা হওয়ার নজির রয়েছে বহু। এসব অনুষ্ঠানের চমৎকার ইতিবাচক দিক রয়েছে যা দেশের সামগ্রিক কৃষির উন্নয়নের জন্য একটি মাইলফলক।

 

                লেখক : কৃষি অর্থনীতিবিদ ও       প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বারি

সর্বশেষ খবর