বৃহস্পতিবার, ১৬ মার্চ, ২০২৩ ০০:০০ টা

বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণ ও ছাত্রলীগে থাকা বিতর্ক

নূরে আলম সিদ্দিকী

বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণ ও ছাত্রলীগে থাকা বিতর্ক

৭ মার্চের সূর্যস্নাত প্রভাতে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে একটি বিতর্ক প্রচ- রূপ ধারণ করে। এক পক্ষ, যারা বিশ্বাস করতেন, গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পথ পরিক্রমণের মধ্য দিয়ে জনগণের রায়সমৃদ্ধ হয়ে একটা পর্যায়ে বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে স্বাধীনতার আহ্বান উচ্চারিত হবে। ৭ মার্চে এ বিতর্কটি আবার নতুন করে অবতারণা করা হয়। যারা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন প্রতিষ্ঠিত করার দিবাস্বপ্নে বিভোর ছিলেন তাদের চাপ ছিল ৭ মার্চে রেসকোর্সের জনসভায় বঙ্গবন্ধু সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন। বাংলার স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধিকার, স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা আন্দোলনের উত্তরণে যারা বিশ্বাসী ছিলাম, তাদের চেতনার মণিকোঠায় ছিল ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা দেবেন- এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। যাতে তৎকালীন সমগ্র পাকিস্তানে বিশেষ করে এই বাংলার মানুষকে তারা ভুল বোঝাতে না পারে, আমাদের বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে চিহ্নিত করতে না পারে। তাই বঙ্গবন্ধুকে অতি সুকৌশলে স্বাধীনতার বার্তাটি উচ্চারণ করতে হবে, যাতে সাপও মরে লাঠিও না ভাঙে। একটি পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু আমাদের বললেন, তোমরা রেসকোর্সে গিয়ে মাইকের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে জনগণের চেতনাকে আরও শানিত, উদ্বেলিত ও উচ্ছ্বসিত করার লক্ষ্যে স্লোগান দিয়ে জনগণকে উদ্দীপ্ত করতে থাকো। এ নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা চারজন রেসকোর্সে গিয়ে মাইকের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করি এবং মুহুর্মুহু স্লোগানে রেসকোর্সের সর্বকালের সর্ববৃহৎ জনসভায় অংশগ্রহণকারীদের চিত্তকে উদ্বেলিত করতে থাকি, তাদের চেতনা শানিত করতে থাকি। মণি ভাই, রাজ্জাক ভাই, তোফায়েল সাহেব, জাতীয় চার নেতাসহ বেশকিছু নেতা মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন। আমি কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করব, সেদিন আমাদের স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের অন্য সদস্যরা আমাকে একটা ছাড় দিয়েছিল বলেই আমি মাইকের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে মুহুর্মুহু স্লোগান দিতে থাকি। আজকে বঙ্গবন্ধুর সেই ঐতিহাসিক ভাষণের যে রেকর্ডটি বাজে সেখানেও আমার কণ্ঠে উচ্চারিত স্লোগান সংযোজিত আছে।

আওয়ামী লীগের একটি ভাগ তখনো ধারণা পোষণ করত, ২৩ বছর পর সরকার গঠনের সুযোগ যখন পেয়েছি তখন সরকার গঠনের পর সব শোষণের হিসাব পাই পাই করে বুঝে নিয়ে ওদের আমরা নিজেরাই খোদা হাফেজ বলে দেব। এ চিন্তাটি উৎসারিত হয় দৈনিক ইত্তেফাকের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার কাছ থেকে। তাঁরই সহকর্মী ও চেতনার উত্তরসূরি, বঙ্গবন্ধুর বাল্যবন্ধু সিরাজুদ্দীন হোসেন এ ধারণাটির সরব প্রবক্তা ছিলেন। প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব খুব সম্ভবত ক্ষমতার প্রলোভনের আঙ্গিকে নয়, প্রত্যয়ের অংশ হিসেবেই ওই কথাটি বিশ্বাস করতেন। তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া ও সিরাজুদ্দীন হোসেনকে অনেকের সঙ্গে আমরাও সাংবাদিক হিসেবে নয়, বরং ভাবতাম আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক চেতনার দার্শনিক।

আরেক দল, যারা কোনো অবস্থায়ই গণতান্ত্রিক ধারার আন্দোলন সফলতার সৈকতে পৌঁছাতে পারে এ চেতনাটিতে বিশ্বাস করত না বরং সত্তরের নির্বাচনের ম্যান্ডেট আদায়ের প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠে আওয়াজ তুলতেন। তারা বলতেন, ‘ভোটের কথা বলে যারা, এহিয়া খানের দালাল তারা’, ‘বাংলার অপর নাম, ভিয়েতনাম ভিয়েতনাম’, ‘মুক্তির একই পথ, সশস্ত্র বিপ্লব’, ‘ভোটের বাক্সে লাথি মারো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’, ‘নির্বাচন নির্বাচন, প্রহসন প্রহসন’। তারা চেয়েছিলেন, ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধু একতরফাভাবে জন-গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের নাম ঘোষণা করবেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তা করেননি। তৃতীয় দলে ছিলাম আমরা। যারা বন্দুকের নলকে শক্তির উৎস হিসেবে কোনো দিনই বিশ্বাস করিনি। আমরা আমাদের শক্তির উৎস হিসেবে পেন্টাগন, ক্রেমলিন অথবা দিল্লির দুর্গকে কোনো দিনই ভাবিনি। মানুষের বুক-নিঃসৃত সমর্থনই আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের মূল শক্তি মনে করেছি। মানুষের হৃদয়-নিংড়ানো আশীর্বাদই আমাদের ’৭০-এর নির্বাচনের সপক্ষে ম্যান্ডেট এনে দিতে পারবে- এ প্রত্যয়ে উজ্জীবিত ছিলাম।

উল্লিখিত তিনটি শক্তিকেই বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত সুকৌশলে পোষ মানিয়ে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। তা সত্ত্বেও আমাদের বিশ্বাস ও প্রতীতির প্রতি তাঁর নিরঙ্কুশ আস্থা ছিল। তাঁর সমস্ত সত্তায় বাংলার মানুষের হৃদয় অনুরণিত হতো। এ কারণেই স্বাধীনতা-পূর্বকালে সব ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে তিনি বাংলার মানুষকে একটি অদৃশ্য ঐক্যের রাখিবন্ধনে বাঁধতে পারলেন। এ তিন মতের সমর্থকরাই উপস্থিত ছিলেন ৩২ নম্বরে। মানিক মিয়ার চিন্তার উত্তরাধিকারী হিসেবে সিরাজুদ্দীন হোসেনসহ আওয়ামী লীগের বেশ কিছু প্রবীণ নেতা বঙ্গবন্ধুকে বুঝিয়েছিলেন, ক্ষমতার পথ ব্যবহার করাই হচ্ছে বাংলার কল্যাণের ও শোষণের প্রতিশোধের একমাত্র উপায়। জন-গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ ঘোষণা এবং সশস্ত্র বিপ্লবের প্রতি যাদের প্রতীতি ও প্রত্যয় ছিল অবিচল, তাদের মধ্যে প্রধান ছিলেন সিরাজুল আলম খান। আমাদের চেতনার আঙ্গিকে যারা আমার অগ্রজ শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, এনায়েতুর রহমান, সৈয়দ মাজহারুল হক বাকী, আবদুর রাজ্জাক প্রমুখ ছিলেন। তারা বিশ্বাস করতেন, ম্যান্ডেটের পর আঘাত হানলে জীবনের বিনিময়ে হলেও শুধু প্রতিরোধই নয়, প্রত্যাঘাতও করা হবে। আমাদের অভিমত ছিল ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানিদের কূটকৌশলগুলো বিবেচনায় রেখে তীক্ষè বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে স্বাধীনতার প্রত্যয়দীপ্ত ঘোষণা না দিলে আন্দোলন মুখ থুবড়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দেবে। ওরাও আমাদের ওপর হিংস্র হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়বে। এখানে আত্মপ্রচারের স্বার্থে নয়, ইতিহাসের দায় মোচনের জন্যই বলতে হচ্ছে, আমাদের মতটির প্রতিনিধিত্ব আমাকেই করতে হতো। এটা অন্য কোনো কারণে নয়, আমার প্রতি বঙ্গবন্ধুর অপত্য স্নেহ, কারাগারে দীর্ঘ ১৯ মাস তাঁর সান্নিধ্যে তাঁর মানসিকতাকে উপলব্ধি করার একটা বিরল সৌভাগ্যের অধিকারী ছিলাম আমি।

৭ মার্চের ভাষণটি ছিল বাংলার মানুষের হৃদয়ের অনুরণন। ভাষাশৈলী, প্রকাশভঙ্গি, শব্দচয়ন, অভিব্যক্তির বহিঃপ্রকাশ-  সবকিছু মিলে একটা অদ্ভুত রাজনৈতিক কৌশলের মাধ্যমে স্বাধীনতার পূর্ণ ঘোষণাই দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু অতি সতর্কতার সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শব্দচয়নের যে কুশলী পারদর্শিতা দেখিয়েছেন, তাতে বিচ্ছিন্নতার অভিযোগে অভিযুক্ত করার কোনো সুযোগ তিনি রাখেননি। আমাদের সুস্পষ্ট অভিব্যক্তি ছিল- স্বাধীনতার ঘোষণা বঙ্গবন্ধুর মুখ থেকে অবশ্যই বজ্রনির্ঘোষে ঘোষিত হবে, কিন্তু বিচ্ছিন্নতাবাদের অভিযোগে বাংলার স্বাধীনতাকামী ও বিশ্বের জাগ্রত জনতাকে আদৌ যেন বিভ্রান্ত করতে না পারে। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধুই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন কিন্তু সব চিন্তার অভিব্যক্তিতে ধৈর্যসহকারে সবার অভিমত শ্রবণ করার অনন্যসাধারণ বৈশিষ্ট্য তাঁর ছিল। ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণটি শুধু পাকিস্তানের পরাজয় সুনিশ্চিতই করেনি, বরং বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিত্ব ও স্টেটসম্যানশিপকে ভিন্ন উচ্চতায় অধিষ্ঠিত করেছে। সেদিনের ভাষণটি কৌশলগত দিক থেকে এতই নিখুঁত ও নিষ্কলুষ ছিল যে, আজও আমি চোখ বন্ধ করলে দেখতে পাই- দিগন্তবিস্তৃত আকাশ থেকে বৃষ্টির মতো তাঁর ওপর আল্লাহর রহমত বর্ষিত হচ্ছে। ৭ মার্চের ভাষণে স্বাধীনতার নির্দেশনাটি এতই সুস্পষ্ট ছিল যে (আমি যদি হুকুম দিতে না-ও পারি) ২৫ মার্চ রাতে ওদের পৈশাচিক আক্রমণের পর আর নতুন করে কোনো নির্দেশনার অপেক্ষা রাখে না।

কী অদ্ভুত কৌশলী ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন বক্তব্য ছিল সেটি! পাকিস্তানি জান্তারা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছিল। একদিকে তিনি সেনাবাহিনীকে উদ্দেশ করে বলছেন, ‘তোমরা আমার ভাই, তোমরা ব্যারাকে থাকো, কেউ তোমাদের কিচ্ছু বলবে না।’ অন্যদিকে বলছেন, ‘আর যদি একটা গুলি চলে, যদি আমার লোককে হত্যা করা হয় তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল- প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে।’ একদিকে তিনি ইয়াহিয়া খানকে চারটি শর্ত ছুড়ে দিলেন। অন্যদিকে নির্দেশনা দিলেন, ‘আমি যদি হুকুম দেবার না-ও পারি- যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেব, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশা আল্লাহ।’ এ উচ্চারণটি এতটাই সুদূরপ্রসারী ছিল যে, প্রতিটি মানুষ নিষ্কলুষ চিত্তে উজ্জীবিত হলো- শুধু শত্রুর আক্রমণকে প্রতিহত করা নয়, শত্রুর যে কোনো সশস্ত্র আক্রমণকে পরাভূত করতে হবে। আমি তাঁর নিজের প্রদত্ত শতাধিক ভাষণ নিজ কানে শোনার সৌভাগ্যের অধিকারী। রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে তো বটেই, নির্দেশ-নির্দেশনাকে উপলব্ধি ও মননশীলতায় পরিণত করার জন্য এবং তাঁর বাগ্মিতাকে জ্ঞানপিপাসু ঋষিবালকের মতো অনুশীলন করার জন্য আমি একান্তচিত্তে তাঁর বক্তৃতা শুধু শ্রবণই করিনি, অনুধাবন করেছি, উপলব্ধি করেছি, আত্মস্থ করার সর্বাত্মক প্রচেষ্টাও চালিয়েছি। সত্যতার খাতিরে এ বাধ্যবাধকতাকে স্বীকার করতেই হবে, তাঁর নিজের প্রদত্ত কোনো ভাষণের তুলনাও ৭ মার্চের ভাষণের সঙ্গে হতে পারে না। তিনি তেজস্বী বক্তা ছিলেন, অসাধারণ বাগ্মী ছিলেন, এটা অস্বীকার করা না গেলেও ৭ মার্চে শব্দচয়ন থেকে শুরু করে তার প্রয়োগ এতই কার্যকর ছিল যে, ওই সভায় উপস্থিত সবার মন ও মননশীলতাকে প্রচ- আবেগে শুধু অভিভূতই করেনি, স্বাধীনতার চেতনাকে প্রত্যয় ও প্রতীতিতে পরিণতই শুধু করেনি, বরং নিজ আঙ্গিকে সবাই এ প্রত্যয় ও প্রতিজ্ঞা নিয়ে ফিরেছে যে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে হলেও পরাধীনতার বক্ষবিদীর্ণ করে স্বাধীনতার সূর্যকে আমরা ছিনিয়ে আনব। আমি সমস্ত উপলব্ধি ও সত্তায় আল্লাহর ওপর নির্ভরশীল। আমার স্থির ধারণা, ৭ মার্চে বাংলাদেশকে পরাধীনতার শৃঙ্খলমুক্ত করার জন্য আল্লাহর রহমতে তিনি উজ্জীবিত ছিলেন। ওই ভাষণটি স্বাধীনতা আন্দোলনের পরিপূর্ণ প্রত্যয় সৃষ্টির লক্ষ্যে সমস্ত জাতীয় চেতনাকে এক অটুট বন্ধনে আবদ্ধ ও অঙ্গীকারবদ্ধ করেছিল।

ভাষণটি গোটা জাতিকে এমনভাবে উদ্বেলিত করেছিল যে, পৃথিবীর কোনো একক বক্তৃতায় এরূপ দৃষ্টান্ত আদৌ খুঁজে পাওয়া যাবে না। অনেকেই আবেগাপ্লুত হৃদয়ে, অভিভূত চিত্তে ৭ মার্চের ভাষণটিকে গ্যাটিসবার্গে আব্রাহাম লিঙ্কনের বক্তৃতার সঙ্গে তুলনা করে থাকেন। আমি এ তুলনাটি করতে নারাজ। কারণ দুটি বক্তৃতার প্রেক্ষাপট এবং আঙ্গিক ছিল ভিন্নতর। গৃহযুদ্ধ সমাপ্ত আমেরিকার গৌরবদীপ্ত মঞ্চে দাঁড়িয়ে আব্রাহাম লিঙ্কন ওই ভাষণটি দিয়েছিলেন। সামাজিক দুর্যোগের মেঘ সরে গিয়ে যখন আমেরিকার পূর্ব দিগন্তে হাস্যোজ্জ্বল সূর্য উদ্ভাসিত, তখন আমেরিকার বিজয়ী নেতা সারা বিশ্বের জন্য জগৎখ্যাত ভাষণটি দেন (Govt. of the people, by the people, for the people, can’t perish from the earth.) কিন্তু ৭ মার্চের প্রেক্ষাপটটি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। বাংলার দিগন্ত বিস্তৃত আকাশে ঘন কালো মেঘে ঢাকা। একদিকে নিদারুণ অনিশ্চয়তা, অন্যদিকে বুকভরা প্রত্যাশা। স্বাধীনতার উচ্ছ্বাস ও আকাক্সক্ষা তখন পরাধীনতার বক্ষ বিদীর্ণ করার জন্য উদগ্রীব। বাংলার মানুষের এ প্রত্যাশা সামনে রেখেই ৭ মার্চের ভাষণটি প্রদত্ত। এখানে অবশ্যই উল্লেখ্য যে, হরতাল, অসহযোগ, অবরোধের মধ্য দিয়ে অহিংস ধারাকে অব্যাহত রেখে চলছিল নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন। এর আগে ৩ মার্চ স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভায় বঙ্গবন্ধু অহিংস ও সুশৃঙ্খলভাবে এবং নাশকতার সম্পর্কে সতর্ক থেকে আন্দোলন এগিয়ে নেওয়ার আহ্বান জানান।

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণটি পাকিস্তানি সামরিক জান্তার পরাজয়কেই কেবল নিশ্চিত করেনি, সমস্ত মানুষের মননশীলতা ও প্রতীতিকে প্রত্যয়ে উজ্জীবিতই করেনি, একটা অদৃশ্য রাখিবন্ধনে সমগ্র জাতিকে শুধু আবদ্ধই করেনি, লড়াকু, অকুতোভয় একটি সত্তাকে কুশলী রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে ভিন্ন উচ্চতায় অধিষ্ঠিত করেছে। শব্দচয়ন- তার বহিঃপ্রকাশ লাখ লাখ মানুষের মননশীলতাকে এমনভাবে শানিত করেছে যে, সব শ্রেণি-পেশার আবালবৃদ্ধবনিতার সবাই যা শুনতে এসেছিলেন, ঠিক তাই শ্রবণ করে স্বাধীনতার দৃপ্ত শপথে উজ্জীবিত হয়ে সেদিন ঘরে ফিরেছেন।

এর আগে সব জনসভায় বাংলার মানুষ তার বক্ষে লালিত স্বপ্ন, কণ্ঠে উচ্চারিত গগনবিদারী স্লোগান এবং দুই বাহু বাড়িয়ে উদাত্ত কণ্ঠের স্লোগান নিয়ে উপস্থিত হতো। ৭ মার্চের সেই ঐতিহাসিক জনসভা একটি ভিন্ন মাত্রায় রূপ নেয়। সেদিন সবার হাতেই ছিল একটি করে বাঁশের লাঠি। এ লাঠি শুধু একটি বংশদ-ই ছিল না, একটি প্রতীকী প্রতিবাদ ছিল যে, এবার আঘাত এলে বাঙালি প্রত্যাঘাত হানবে। যে কোনো আক্রমণের মোকাবিলা করার জন্য তারা প্রতিশোধের দৃপ্ত আকাক্সক্ষা নিয়ে তা মোকাবিলা করবে। পরবর্তীতে ২৫ মার্চের যে হিংস্র আক্রমণ, প্রতিরোধ ও প্রতিশোধের জিঘাংসায় উজ্জীবিত হয়ে বাঙালি তার মোকাবিলা করে এবং সমগ্র রাজনৈতিক বিশ্বাসকে তারা একটি চেতনার মোড়কে আচ্ছাদিত করে। জাতিকে স্বাধীনতার মহামন্ত্রে উজ্জীবিত করার একটি স্বরলিপি ছিল ৭ মার্চের সেই ঐতিহাসিক ভাষণ। ৫২ বছর পর আজও যে কোনো স্বাধীনতাকামী মানুষ সেই ভাষণ শ্রবণ করলে তার সমস্ত শরীরে একটা প্রচ- জাগরণ ও বিশেষ অনুভূতির সৃষ্টি হয়। এত বছর পরও এটি যেন একটি অম্লান, অবিস্মরণীয় এবং স্বাধীনতার চেতনায় উজ্জীবিত একটি মহাকাব্য।

লেখক : স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ও ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি

সর্বশেষ খবর