শুক্রবার, ২৪ মার্চ, ২০২৩ ০০:০০ টা

ব্যবসার সুযোগ বাড়াতে হবে

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

ব্যবসার সুযোগ বাড়াতে হবে

তিন দিনব্যাপী বাংলাদেশ বিজনেস সামিট-২০২৩ হয়ে গেল ঢাকায়। এ সম্মেলনে বাংলাদেশে বহুদিনের ব্যবসা-বাণিজ্য বিনিয়োগ ইতিহাস ও অর্থনৈতিক সমঝোতায়, সহমর্মী, সহযোগী দেশ অঞ্চল ও অর্থনীতির দিকপালরা যোগ দিয়েছিলেন। তারা এবং দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী নেতারা বাংলাদেশে বিনিয়োগ ব্যবসা ও সহযোগিতা বাড়ানোর অপার সম্ভাবনার প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন।  তবে তাদের মধ্যে কেউ কেউ ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ প্রকৃতির সমস্যা দূরীকরণের দাবি যে তোলেননি, পরামর্শ ও সুপারিশ যে রাখেননি তা নয়। দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য বিনিয়োগের মাথা যারা ছিলেন বা আছেন তারা সেই প্রশংসায় ধন্য যেমন হয়েছেন তেমনি উচ্চকণ্ঠ ছিলেন নিজেদের এবং দেশের ইমেজ প্রচারের কাজে ব্যবসা-বাণিজ্য বিনিয়োগের পরিবেশ নিয়ে সাফল্য তুলে ধরতে। দেশের পোশাকশিল্পের প্রতিনিধিরা নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রধানরা যেন জেগে উঠেছিলেন ‘সেবা’ ও ‘নিয়ন্ত্রণে’র নানান সওগাত নিয়ে বাস্তবে ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ পরিবেশে সেবা ও পরিপোষণা প্রাপ্তি কতখানি এবং তাতে দেশি-বিদেশি আমন্ত্রিত অতিথিরা তুষ্ট হয়েছেন, বাস্তবতায় পুষ্ট হয়েছেন বা হবেন কি না সে দ্বিধা তারা প্রকাশ করেছেন আভাসে-ইঙ্গিতে। বোঝা যাচ্ছিল আয়োজকরা এমন একটি প্রচারযজ্ঞের এন্তেজাম করেছিলেন মুখ্যত বিদেশিদের কাছে বাংলাদেশের ব্র্যান্ডিংকে, রোল মডেল হওয়ার ইমেজকে তুলে ধরতে। প্রচার-প্রচারণা বাহুল্য বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয়ে আয়োজিত ইতিবাচক এ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন অনেকে। তবে জাতীয় নির্বাচনের প্রাক্কালে এফবিসিসিআইর এ আয়োজনে বাংলাদেশের সম্মোহিত সমকালীন সমাজ, আমজনতা, পুঁজিহারা ব্যাংকের আমানতকারী, পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারী, পা পিছলানো মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীর মধ্যে দিনে দিনে জমে ওঠা নানান সংশয়-সন্দেহ নিঃসৃত নেতিবাচকতা কেটে যাওয়ার প্রত্যাশা করা হয়েছে।

একই সঙ্গে বাংলাদেশ বিজনেস সামিটকে দেশি ব্যবসা বিনিয়োগকারীদের মধ্যে জমে থাকা অভিযোগ, ক্ষোভ, কষ্ট অব ডুয়িং অব বিজনেস বৃদ্ধির, মূল্যস্ফীতির দোষ করোনা ও ইউরোপের যুদ্ধের ওপর চাপানোর সুযোগসহ দেশ ও রাজনৈতিক অর্থনীতি অভ্যন্তরে নিজেদের নানান ব্যর্থতা ও ‘অপ’প্রয়াস থেকে দৃষ্টি সরানোর সুযোগ বলা যায়। বলা যেতে পারে, অপারগতার বেদনাকে চাপা দেওয়া যায় যাতে দ্বিধা কেটে যায়, উন্নয়নশীল দেশের ক্লাবে প্রবেশের পথে সংশয়-সন্দেহগুলো অবগুণ্ঠিত অপনোদিত থাকে। সে নিরিখেও নিঃসন্দেহে এ উদ্যোগ ইতিবাচক।

এ ইতিবাচকতা যেন নেতিবাচকতাকে ঠেকাতে সক্ষম হয়। যেন উচিত পরিবর্তন আসে দেশের অর্থনীতিতে, ব্যাংকিং খাতের সবলতা বৃদ্ধি পায়, স্বচ্ছতা জবাবদিহিতার চর্চা চলে। এটি বেশি প্রয়োজন সমাজ যখন পরস্পর বিরোধিতায় আকীর্ণ, ন্যায়নীতিনির্ভরতার মূল্যবোধ যখন আইসিইউতে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে যথাযথভাবে মেরুদন্ড  খাড়া করে দাঁড়ানোর বা মানবসম্পদে পরিণত হওয়ার প্রেসক্রিপশন ও পথ্য (শিক্ষাব্যবস্থা) নির্মাণ ও রচনায় দারুণ দুর্গতি বিদ্যমান।

বলাবাহুল্য, বিদ্যমান অপঅবস্থা-ব্যবস্থাকে ‘এনকোর’ ‘এনকোর’ (অনমোর অনমোর) করানোর প্রয়াস চলছে। উপলব্ধিতে আসছেই না সমাজ রাজনীতি অর্থনীতিকে নেতিবাচক হওয়ার উপাদান উৎপাটন হওয়া দরকার। তা না হলে এ তথাকথিত ইতিবাচক হওয়া বা করার চেষ্টা নেতিবাচকতাকে উসকে দিতে পারে। বাইরের প্রশংসাপত্র আর কত দরকার? অতীতে এমন প্রশংসা বহুবার শোনা বা শোনানো হয়েছে। বিদেশি বিনিয়োগ সে অর্থে তেমন আসেনি। এবারের বিজনেস সামিটে কোটরা (কোরীয় ট্রেড ইনভেস্টমেন্ট প্রমোশন এজেন্সি) গ্রিন গ্রোথ ডিপার্টমেন্টের ডিরেক্টর জেনারেল জানিয়েছেন, যারা ভিয়েতনামে চাইনিজ রিলোকেশনের বাস (বা নৌকা) মিস করেছেন তারা এখন বাংলাদেশে আসতে পারেন। এ কথা আজকের নয়, বছর আটেক আগে থেকেই জানান দেওয়া হচ্ছিল, জাপানিদের চীনা বিনিয়োগ বাংলাদেশে বিলোকেট করার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। বিগত ১০ বছরে ভিয়েতনাম ও ভারত কী করতে পেরেছে তার বিপরীতে বাংলাদেশ কী পদক্ষেপ (রিলোকেশন আকর্ষণে) নিতে পেরেছে বা নিয়েছে সেটার শুমার করলে বেরিয়ে আসবে চতুর, সচেতন, হিসেবি ও সক্রিয় বিনিয়োগকারীরা কেন উৎসাহী হননি বা আমরা তাদের আনতে পারিনি। বিগত এক দশকে আগের সময়গুলোর তুলনায় নিজ দেশে বিনিয়োগ না করে দেশের পুঁজি ও মেধা বা উদ্যোক্তা পাচার হয়েছে বিদেশে। বেড়েছে বহুগুণে এ প্রবণতা। কঠিন শর্তেও স্বল্পমেয়াদি সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট নেওয়া হয়েছে আগের চার দশকের প্রায় সমপরিমাণ। দেশে যখন স্থানীয় বিনিয়োগের পরিবেশ পরিস্থিতির তথৈবচ অবস্থা, স্থানীয় বিনিয়োগ বস্তুত স্থবির, যখন দেশের পুঁজি ও মেধা পাচার হয়ে সেসব দেশে ঘরবাড়ি ব্যবসাপাতি করে কেউ সেসব দেশের ধনীদের ক্লাবে ঢোকায় সফলও হয়েছেন, তখন বাইরের বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশের পেটানো ঢোলে কেন উদ্বুদ্ধ হবেন? দেশের পুঁজিবাজার যখন তলানিতে, বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বরং পুঁজি প্রত্যাহার করেই চলেছেন, ফরেন কারেন্সি রিজার্ভ যে কমছে যেসব খবর বিদেশি বিনিয়োগকারীদের অজানা নয়, সে সময় পুঁজিবাজারকে চাঙা করার নামে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার পক্ষ থেকে বিদেশে রোড শো করায় ইতিবাচকতা ও নেতিবাচকতা একাকার হয়ে যায়। ১০০টি ইকোনমিক জোনকে সত্যিকার অর্থে শিল্প ও বিনিয়োগ হাব হয়ে ওঠার সুযোগ, উপযোগিতা, কমপেটিটিভনেস ও মনোযোগিতা মিরসরাইতে সরকারি টাকায় ও খাসজমিতে বৃহৎ শিল্পাঞ্চল গড়ে তোলার মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছে। ১০০ ইকোনমিক জোন গড়ে ওঠার ব্যাপারে পরিষেবা, প্রণোদনা, ঘটা করে ঘোষিত ওয়ান স্টপ সার্ভিস সবকিছুকে যথাযথভাবে সংস্থান না করলে ইতিবাচক আবহ তৈরি হবে না। বেসরকারি খাতের বিনিয়োগকারীরা মাঝপথে এসে বশংবদ সমস্যার কাদায় আটকে গেলে তারা হতোদ্যম ও নিরুৎসাহিত হয়ে পড়বেন। ১৯৯৭ সালে এশিয়ান ক্রাইসিসের শানে নজুল পুনর্পাঠের প্রয়োজন হবে।

বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের বিদ্যমান ডেভেলপাররা কেমন আছেন বা কেমন থাকবেন সে ব্যাপারে অগৌনে মনোযোগ না দিলে বিশাল ইতিবাচকতা নেতিবাচকতায় নুয়ে পড়বে। শুধু জমি জোগাড়েই মাঠ পর্যায়ের (ভূমি) প্রশাসনের সেবা সহযোগিতার নমুনা যাচাই করলে বোঝা যাবে ডেভেলপাররা কেমন আছেন, কেন তারা নির্মাণ প্রকল্প শেষ করতে পারছেন না। গ্যাস বিদ্যুৎ প্রাপ্তির পরিস্থিতি পরিসংখ্যান বড় করুণ। প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ ও সমন্বয়হীনতা প্রকল্পের ব্যয় আয়ত্তের বাইরে নিয়ে যাচ্ছে। সুতরাং এ প্রচারসর্বস্ব বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মাহফিল আয়োজনে প্রশংসাবাক্য শোনা হবে শুধু সার, বাস্তবতার বাসর তো দিল্লি দুরস্ত। একজন ডেভেলপার সম্মেলনে কি নোট স্পিসে এ বিষয়গুলো তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন, বলতে গেলে অনেকটা রিস্ক নিয়ে। আসলে আমাদের এখন লুক টু দ্য ইস্ট ওয়েস্ট নর্থ সাউথ না করে লুক টু আওয়ার সেলফ (নিজের দিকে তাকাও) এ মনোনিবেশই হবে বরং ইতিবাচক অগ্রগতির, আবেগের অনুভূতির প্রত্যাশা প্রাপ্তির সোপান। ইতিবাচক এবং নেতিবাচককে এক বিছানায় নেওয়া সমীচীন ছিল না, কখনো হবেও না। অন্যের বিনিয়োগ ও রোলমডেল হওয়ার প্রশংসাপত্র পাওয়া কঠিন হবে না দেশের অর্থনীতির অন্তর্নিহিত দুর্বলতা শুধরে বিনিয়োগ পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারলে, এমনিতেই বিদেশি বিনিয়োগ আসার পথ সহজ হবে। তখন দেশের শিল্প উদ্যোক্তাকে দেশে রাখা যাবে, অর্থ ও মেধা পাচার বন্ধ হবে। বিদ্যমান সমস্যাকে এড়িয়ে, চেপে রেখে, ইতিবাচকতার ভান বা প্রত্যাশা করা হবে নেতিবাচকতার শামিল।

ইতিবাচক সম্মেলন চলার সময় দ্বিতীয় দিনেই একনেকে পাস হয়েছে ১ হাজার ৬৮৬ কোটি টাকা ব্যয়ে কাস্টমস আধুনিকায়ন ও অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প। অবশ্যই ইতিবাচক উদ্যোগ। স্বীকার করতেই হয়েছে, পাঁচ দশকে কাস্টমস ব্যবস্থাপনা ও অবকাঠামোর দক্ষতা উন্নয়নে কিছুই করা হয়নি। স্বীকার করা হয়েছে বহিঃসম্পদ (বিশ্বব্যাংকের লোন নিয়ে তাদের প্রেসক্রিপশনে) নিয়ে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগকে শক্তিশালী করতে হয়েছে বা হচ্ছে। বানানো হবে ভবন বলা হচ্ছে, বাড়বে দক্ষতা ও সক্ষমতা সেই ভবনের অধিকর্তাদের। নতুন করে তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধি, দায়িত্বশীলতা, ব্যবসা-বাণিজ্যের পোষক নিয়ন্ত্রক হিসেবে তাদের মনোভাবের পরিবর্তন বা উন্নয়ন প্রত্যাশা করা হয়েছে প্রকল্প দলিলে। বিদ্যমান নেতিবাচক মনোভঙ্গি সীমাবদ্ধতা (যা বিজনেস সামিটে বার বার উচ্চারিত হয়েছে) কাটিয়ে শুল্ক বিভাগকে ইতিবাচক ধারায় আনতে রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি, মন্ত্রতন্ত্র আইনকানুন কই? পর্যাপ্ত বরাদ্দ কই, ব্যয় পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কঠোর নজরদারি দরকার হবে। এত দিনে গালভরা শব্দমাধুর্যে মাখা বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে একাধিক প্রকল্পের বাস্তবায়ন ফলাফল ন্যায্য জবাবদিহির আওতায় না আনলে, অগ্রগতি মূল্যায়ন না করলে, হিসাব বুঝে না নিলে বর্তমান ও প্রস্তাবিত মোটা অঙ্কের অবকাঠামো উন্নয়নের দ্বারা নেতিবাচতাকে ইতিবাচক করা যাবে না। ইতিবাচকতার সুঘ্রাণ ও সমৃদ্ধির স্বার্থে নেতিবাচকতার অবসান কামনা সবার।  এ জন্য ব্যবসা বাণিজ্যের সুযোগ বাড়াতে হবে সবার আগে।

লেখক : সরকারের সাবেক সচিব, এনবিআর-এর প্রাক্তন চেয়ারম্যান

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর