মঙ্গলবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৩ ০০:০০ টা

বঙ্গবাজারে আগুন : কেঁচো খুঁড়তে সাপ

আলম রায়হান

বঙ্গবাজারে আগুন : কেঁচো খুঁড়তে সাপ

প্রবচন আছে, চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখানো। এবার চোখে আগুন দিয়ে দেখানোর মতো ঘটনা ঘটল রাজধানীতে। আতঙ্কগ্রস্ত অবস্থায় সবাই দেখল কতটা অনিরাপদ রাজধানী ঢাকা। মহানগরের অতি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বাঁশ-কাঠ-টিন দিয়ে তিনতলা স্থাপনায় চলছিল তৈরি পোশাকের হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য। কেন্দ্রটি বঙ্গবাজার হিসেবেই পরিচিত। এ বঙ্গবাজারে ৪ এপ্রিল ভোরে অগ্নিকান্ডের সূচনা হয়। দেশের অন্যতম বড় কাপড়ের  মার্কেট বঙ্গবাজারে সকাল ৬টার দিকে আগুন দৃশ্যমান হওয়ার পর খবর পেয়ে সেখানে ফায়ার সার্ভিস পৌঁছে যায়। কিন্তু সর্বনাশ ঠেকানো যায়নি।  নিয়ন্ত্রণের ব্যর্থতায় অগ্নিকান্ড হয়ে যায় ভয়াবহ। যে আগুন পুরোপুরি নেভাতে সময় লেগেছে ৭৫ ঘণ্টা পর। তবে এ সাফল্য অর্জিত হয়েছে তিনতলা স্থাপনা ও সব মালামাল পুড়ে যাওয়ার পর। এ কাজে ডেডিকেটেড ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স, দেশ রক্ষার সেনাবাহিনী ও বিমান বাহিনী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য পুলিশ-আনসারসহ আরও অনেক সংস্থা যৌথভাবে কাজ করেছে। এরপরও আগুনে বঙ্গবাজার মার্কেট, মহানগর মার্কেট, আদর্শ মার্কেট ও গুলিস্তান মার্কেট পুরোপুরি ভস্মীভূত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পাশের এনেক্সকো টাওয়ার এবং আরও কিছু ভবন। ঈদের আগে সব দোকানেই লাখ লাখ টাকার পোশাক তোলা হয়েছিল। পুড়ে গেছে সব। এ ঘটনায় প্রমাণিত হয়েছে, যে দেশ পদ্মা সেতুর স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে পারে সেই দেশের খোদ রাজধানীতে আগুন নিয়ন্ত্রণে কতটা মাজুল দশা বিরাজমান। এটি একটি বেদনার দিক। আরও বেশি হতাশার দিক হচ্ছে- বঙ্গবাজারের আগুনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে কতিপয় রঙ্গের বিষয়। বঙ্গবাজারের আগুনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে যেসব রঙ্গ হয়েছে তার মধ্যে প্রধান হচ্ছে- অগ্নিকান্ডের জন্য ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং সাবেক শাসক দল বিএনপি পরস্পরকে দায়ী করা। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ৭ এপ্রিল বলেছেন, ‘প্রকৃত নিরপেক্ষ তদন্ত যদি হয় তাহলে সম্ভাবনা আছে এটা বেরিয়ে আসার যে, এটা সম্পূর্ণভাবে আওয়ামী লীগের দ্বারাই হয়েছে।’ বঙ্গবাজারের অগ্নিকান্ড নিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুলের বক্তব্যকে দায়িত্বজ্ঞানহীন বলে মন্তব্য করেছেন তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। এদিকে মির্জা ফখরুলের গায়েবি আওয়াজের আগে ৬ এপ্রিল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘বঙ্গবাজারসহ অগ্নিকান্ডের ঘটনা নাশকতা কি না, আন্দোলনে ব্যর্থ হয়ে এ ঘটনা ঘটাচ্ছে কি না তা আমরা খতিয়ে দেখছি এবং তা তদন্ত করা দরকার।’ সেতুমন্ত্রী ৮ এপ্রিল বলেছেন, ‘আগুন নিয়ে যে নাশকতা হচ্ছে তার সঙ্গে বিএনপি যুক্ত।’ বঙ্গবাজারের অগ্নিকান্ডের বিষয় নিয়ে প্রধান দুই দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের এই যে বক্তব্য তা কি মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়েছে? হয়নি। হওয়ার কোনো কারণও নেই। তবু আমাদের নেতারা এ ধরনের কথা অহরহ বলে থাকেন। মানুষ কোন কথা গ্রহণ করবে, কোনটা করবে না- তা আমাদের দেশের রাজনীতিকরা সম্ভবত এখন আর তেমন ভাবেন না। ফলে রাজনীতিকদের কথাবার্তা নিছক কথামালার পর্যায় ছাড়িয়ে এখন রংতামাশার পর্যায়ে নেমেছে বলে অনেকেই মনে করেন। এই হচ্ছে পরিস্থিতি নিম্নগতির নগ্নধারা। অথচ এক সময় রাজনীতিকদের কথা শোনার জন্য মানুষ উন্মুখ হয়ে থাকত। এ ধারায় অনেক ছাত্রনেতাও রাতারাতি জাতীয় নেতা হয়ে ওঠার উদাহরণ আছে। কিন্তু এখন সবকিছুই যেন চলছে উল্টো রথে। এ দশা কেবল রাজনীতিতে নয়, প্রায় সব ক্ষেত্রেই একই দৃশ্যপট নগ্নভাবে প্রকট। সব পেশায়। সব ক্ষেত্রে। ফলে যা ছিল নদী তা এখন অনেক ক্ষেত্রে খালের মতো অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে কোনোরকম। অনেক নদী হয়ে গেছে পুকুর। কোনো কোনো নদী আবার পুকুরচুরির ধারায় অদৃশ্য। সবাই জানে, বাংলাদেশের প্রাণ হচ্ছে নদী। আর নদীর প্রাণ পানি। পানি না থাকলে নদী থাকে না। নদী না থাকলে বাংলাদেশ থাকবে না। নদী মানে বড় জলাধার। ছোট জলাধার না থাকলে কী দশা হয় তা তো বঙ্গবাজারের আগুনের ঘটনায় অকাট্যভাবে প্রমাণিত। কিন্তু শিক্ষা হয়নি। ফলে পানির প্রসঙ্গটি বেমালুম চেপে গিয়ে হেনতেন সাত-সতের বিষয় নিয়ে হা-হুতাশ করা হচ্ছে। চলছে নানা ধরনের বাগাড়ম্বর। কেউ আবার লাখ টাকার পোড়া লুঙ্গি কিনে নিজেকে জাহির করার চেষ্টা করছেন। রংতামাশা আর কাকে বলে! এ ব্যাপারে কোনোই সন্দেহ নেই, বঙ্গবাজারে আগুনের ঘটনায় বিপুলসংখ্যক মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এটি খুবই বেদনাদায়ক ঘটনা। এদের মধ্যে অনেকেই পুঁজি হারিয়েছেন। সঙ্গে এও মনে রাখতে হবে, ‘সবাই নিঃস্ব হয়ে পথে বসে গেছেন’ তা কিন্তু নয়। কিন্তু ‘সব শেষ হয়ে গেছে’- এ রকম একটি বিষয় বেশ প্রচারণা পাচ্ছে। এর নিচে চাপা পড়ে গেছে কয়েকটি প্রশ্ন। এক. রাষ্ট্রের নানান বিধিবিধানকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বাঁশ-কাঠ-টিনের তিনতলা কাঠামোতে হাজার কোটি টাকার ব্যবসা গড়ে ওঠার নেপথ্যের মোড়ল কারা? বারবার নোটিস দেওয়ার পরও কোন ক্ষমতার জোরে তা অবজ্ঞা করা হয়েছে? আদালতের নিষেধাজ্ঞার পর তা ভ্যাকেট করার জন্য দক্ষিণ ঢাকা সিটি করপোরেশন কতটা আন্তরিকভাবে চেষ্টা করেছে? কোন যুক্তিতে সরকারের পক্ষ থেকে আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের অর্থ সাহায্য করা হবে? খতিয়ে দেখা প্রয়োজন, ফুটপাতের হকার পুনর্বাসন নামে বিভিন্ন সময়ে এ পর্যন্ত কাদের পুনর্বাসন করা হয়েছে। এর নেপথ্যে থেকে ফায়দা লুটেছেন কারা। আরও যদি সংক্ষেপ করে প্রশ্ন তোলা যায়- বঙ্গবাজারে আগুনে যে ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তারা আসলে কারা। তাদের প্রাপ্তির নামে আসলে কাদের প্রাপ্তি ঘটেছে। আর সরকার যদি ক্ষতিপূরণ দেয় তাহলে প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের দেওয়া উচিত। খামখেয়ালি করে বাঁশের ঘরে বসে আকাশছোঁয়া ব্যবসা পরিচালনাকারীদের নয়। একটু গভীরে গেলেই বোঝা যাবে বঙ্গবাজারে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তারা আসলে হারিয়েছেন এক সিজনের পুঁজি ও মুনাফা। সর্বস্ব হারাননি। আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের সহায়তার নামে সরকারের তহবিল থেকে আমজনতার টাকা দেওয়া হলে তা আসলে চলে যাবে নেপথ্যের রাঘববোয়ালদের পেটে। যে পেট আগেই ঢোল হয়ে আছে। তবু তারা হা করে থাকে। এদের অনেকেই টাকার কুমির হিসেবে পরিচিত।

এ কুমির চক্রের মুখোমুখি দাঁড়ালে সর্বনাশের সমূহ সম্ভাবনা। উদাহরণ, আজকের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেকের বাবা কর্নেল (অব.) আবদুল মালেক। তিনি এরশাদ সরকারের মন্ত্রী ছিলেন। স্বল্প মেয়াদে। তাও বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের। এর আগে ১৯৮৬-১৯৮৯ মেয়াদে ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়র ছিলেন। সেসময় ঢাকা সিটি ছিল অবিভক্ত। তখনো ঢাকা ছিল মশক উপদ্রুত, এখনকার মতো। যেমন পাকিস্তান চিরকাল সেনা উপদ্রুত। মশার উপদ্রবে অতিষ্ঠ নগরবাসীর উদ্দেশে মেয়র কর্নেল মালেক যে কথা বলেছিলেন তা ছিল আজকের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মোমেনের উচ্চারণের চেয়েও বেশি বালখিল্য। তিনি বলেছিলেন, এক কেজি মশা মারলে ১০০ টাকা দেওয়া হবে। তার এ বেফজুল রসিকতার উচ্চারণে বেশ বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়েছিল। সে সময় তিনি আরও বলেছিলেন, আর মার্কেট হবে না। বরং মাঠ ও পুকুর টিকিয়ে রাখতে হবে। বলাবাহুল্য, তিনি এক কেজি মশার বদলে যেমন ১০০ টাকা দেওয়ার সুযোগ পাননি, তেমনই মাঠ ও পুকুর টিকিয়ে রাখতে পারেননি। তিনি তো মেয়র পদই টেকাতে পারেননি শেষ পর্যন্ত। তাকে অপসারণ করে এ পদে দেওয়া হয় নাজিউর রহমান মঞ্জুরকে। মেয়র পদ থেকে সরিয়ে কর্নেল মালেককে করা হয় বস্ত্রমন্ত্রী। এরপর স্বল্প সময়ের ব্যবধানে পত্রপাঠ বিদায়। অনেকেই বলেন, হঠাৎ হঠাৎ মন্ত্রী বিদায় করা ছিল জেনারেল এরশাদের মোক্ষম কৌশল। তখনই বলা হয়েছে, সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে মার্কেট নির্মাণের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে কর্নেল মালেক নিজের পায়ে কুঠারাঘাত করেছেন। কারণ সরকারি ব্যবস্থাপনায় মার্কেট মানে হীরার ডিমপাড়া হাঁস এবং এ হাঁস জন্ম প্রক্রিয়া থেকেই ডিম পাড়ে!

এরশাদ আমলের এ ঘটনা উল্লেখ করার উদ্দেশ্য হচ্ছে- মার্কেট বাণিজ্যের গভীরতার দিকে নজরকাড়ার মৃদু প্রয়াস। বলাবাহুল্য, মার্কেট-বাণিজ্য বহুগুণ বড় হয়েছে। আর নেপথ্য প্রাপ্তি মুরগির সাইজ থেকে বড় হতে হতে হাতির সাইজ হয়ে গেছে। আর নেপথ্য খেলোয়াড়রা হয়ে গেছে দানব! ফলে বঙ্গবাজারে আগুনের পর যাদের আইনের আওতায় গ্রেফতার হয়ে জেলখানায় থাকার কথা তারা নানারকম দেনদরবার করছেন। হা-হুতাশও করছেন আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের জন্য। বঙ্গবাজারকেন্দ্রিক হরেকরকম সমিতির নামে নেতা পরিচয়ে ব্যক্তিদের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো প্রয়োজন। তাদের জবাবদিহি করতে হবে, সরকারের পুনঃ পুনঃ সতর্ক বার্তা এবং সিদ্ধান্ত কেন উপেক্ষা করেছেন। শুধু তাই নয়, জবাবদিহিতার মধ্যে আনা প্রয়োজন খোদ সিটি করপোরেশনকেও। ফায়ার ব্রিগেড তো তার দায়িত্ব লাগাতারভাবে পালন করে গেছে। একের পর এক চিঠি দিয়েছে। কিন্তু সিটি করপোরেশন কেন ভোমভোলানাথ হয়ে ঘুমিয়েছিল? বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন, এখনো কিন্তু ঢাকা নগরবাসী আনিসুল হকের কথা স্মরণ করে।  বরিশালে যেমন স্মরণ করা হয় শওকত হোসেন হিরণকে। ঢাকা দক্ষিণের মেয়র ব্যারিস্টার তাপস তো এদের চেয়ে অনেক বেশি ক্ষমতা ধারণ করেন যে কোনো মানদন্ডে। এরপরও একটি মার্কেট নিয়ে তার কেন লেজেগোবরে অবস্থা! মাননীয় মেয়র কি একটি বিনীত প্রশ্নের উত্তর দেবেন, আদালতের নিষেধাজ্ঞার পর তার লোকজন কি হাত-পা গুটিয়ে বসেছিলেন? নাকি নিষেধাজ্ঞা ভ্যাকেট করার কোনো চেষ্টা করেছে?  মাননীয় মেয়র এই একটি কাজ করলে হয়তো অনেক রহস্যের জট খুলবে। বেরিয়ে আসতে পারে আরও অনেক কিছু। প্রবচন আছে- কেচো খুঁড়তে সাপ!

লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক

সর্বশেষ খবর