মঙ্গলবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৩ ০০:০০ টা

বঙ্গভবনে মহামান্য রাষ্ট্রপতির শপথ গ্রহণ

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম

বঙ্গভবনে মহামান্য রাষ্ট্রপতির শপথ গ্রহণ

লিখতে চেয়েছিলাম ঈদুল ফিতর, বাংলা নববর্ষ, ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর দিবস আর মাঝে মাঝেই যত্রতত্র অগ্নিকান্ডের ঘটনা-না দুর্ঘটনা নিয়ে। কিন্তু মহামান্য রাষ্ট্রপতির শপথ গ্রহণের কারণে এসবের কিছুই হলো না। গতকাল ছিল নতুন রাষ্ট্রপতির শপথ গ্রহণ। স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গভবনের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ২৮ ডিসেম্বর, ১৯৭১। ১৮ ডিসেম্বর ’৭১ নারী হরণকারী লুটেরা চারজনকে জনগণের রায়ে পল্টন ময়দানে কাদেরিয়া বাহিনী মৃত্যুদন্ড দিয়েছিল। আমি এখনো জানি না তারা বাঙালি, না নন-বাঙালি। ১৪-১৫ বছরের যে দুটি মেয়েকে হরণকারীরা নিয়ে যাচ্ছিল এবং তাদের বাবাকে গাড়ির পেছনের বনাটে আটকে রেখেছিল তাদের আমি ’৭১ থেকে ’৭৫ পর্যন্ত দেখেছি। বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাযজ্ঞের পর ১৬ বছর নির্বাসনে থেকে দেশে ফিরে আর দেখিনি। আমরা যাদের জনগণের রায়ে বিচার করেছিলাম বাংলাদেশ সরকার তাকে হত্যা বলে ধরে নিয়ে আমার নামে প্রথম গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছিল। এ নিয়ে ইল্লি দিল্লি অনেক হয়েছিল। লে. জে. জগজিৎ সিং অরোরা ২০ ডিসেম্বর শুধু পল্টনের ঘটনায় টাঙ্গাইল এসেছিলেন। প্রথমে ক্ষুব্ধ ছিলেন। মিলিটারি মানুষ ডিসিপ্লিন দেখতেই অভ্যস্ত। বিন্দুবাসিনী স্কুল মাঠে যখন তাকে গার্ড অব অনার দেওয়া হয় তিনি বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘এরা কারা? এরা কি সেনাবাহিনীর লোক?’ বলেছিলাম, না, দু-চার জন হতে পারে। তবে আর সবাই ছাত্র-যুবক-কৃষক-শ্রমিক। বিস্মিত হয়ে গিয়েছিলেন। মিত্রবাহিনীর প্রধান লে. জে. জগজিৎ সিং অরোরা সেদিনই দিল্লি গিয়েছিলেন। ভারতের মহান প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীকে আমার সম্পর্কে বাংলাদেশ সরকারের কথা বলেছিলেন। অরোরার কথা শুনে ইন্দিরা বলেছিলেন, ‘তুমি ঠিক করেছ। ওদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে আমাদের হাত না দেওয়াই ভালো।’ চলছিল উত্তেজনা। ২৮ ডিসেম্বর ’৭১ ভারতীয় কয়েকজন জেনারেল হেলিকপ্টারে টাঙ্গাইল আসেন। সেখানে যারা আমরা পায়ে হেঁটে ঢাকা জয় করেছিলাম সেই তিন মহাবীর মে. জে. নাগরা, ব্রি. সানসিং, ব্রি. ক্লের এবং মেজর জেনারেল বি এন সরকার ছিলেন। তাঁরা টাঙ্গাইল গিয়েই আমাকে পাকড়াও করেন, ‘টাইগার তোমাকে ঢাকা যেতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তোমার মন কষাকষি বা ভুল বোঝাবুঝি দূর করতে হবে। চল যাই।’ আমি তখনই বীর মুক্তিযোদ্ধা মাসুদকে নিয়ে ঢাকায় এসেছিলাম। মনে হয় ১৩-১৪ মিনিটের বেশি লাগেনি। যে হেলিকপ্টারে ঢাকা এসেছিলাম সেই হেলিকপ্টারে অনেকবার এদিকওদিক ছোটাছুটি করেছি। হেলিকপ্টারের পাইলটসহ সবাই ছিল চেনাজানা। মুক্তিবাহিনীর নেতা হিসেবে তারা অসম্ভব সম্মান করতেন। প্রথমেই উঠেছিলাম সেন্ট্রাল সার্কিট হাউসে আমাদের মহান নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ঢাকায় এলে যেখানে উঠতেন। দুপুরের পর নিয়ে যাওয়া হয়েছিল সচিবালয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গতাজ তাজউদ্দীনের ঘরে। তার ঘরে গিয়ে পাঁচজন একসঙ্গে স্যালুট করেছিলাম। কিন্তু তিনি চেয়ার থেকে ওঠেননি, হাত নাড়িয়ে আমাদের স্যালুটেরও জবাব দেননি। সে এক বিব্রতকর অবস্থা। একটু পর ভারতীয় জেনারেলদের বাইরে দাঁড়াতে বললেন। আমার সঙ্গে অনেকক্ষণ উত্তপ্ত কথা কাটাকাটি হয়। প্রথমেই তিনি বললেন, ‘পল্টনে ওইভাবে গুলি চালানো বা হত্যা করা ঠিক হয়নি।’ উত্তরে বলেছিলাম, সভায় উপস্থিত আড়াই-তিন লাখ মানুষের নির্দেশে আমরা চারজনকে শাস্তি দিয়েছি। এটা না করলে ঢাকা লুটের শহর হতো। দুটো মেয়েকে হরণ করে নিয়ে যাচ্ছিল। দুটোর জায়গায় ২ হাজার অথবা ২০ হাজার কিংবা ২ লাখ নারী হরণ হতো, চারজনের জায়গায় ৪০ হাজার গোলাগুলি করে মারা যেত। আপনি এই যে শান্ত শীতল দেশের রাজধানীর সচিবালয়ে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বসেছেন হয়তো এখনো আপনাকে মুজিবনগরেই থাকতে হতো। বঙ্গতাজ তাজউদ্দীন দারুণ মেধাবী পোড় খাওয়া মানুষ। তাঁর আমার কথা বুঝতে অসুবিধা হয়নি। সঙ্গে সঙ্গে চেয়ার থেকে উঠে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরেন এবং বলেন, ‘যা হবার হয়ে গেছে। এখন থেকে তোমার শতভাগ সমর্থন চাই। তোমার কথা ছাড়া ভারতীয় সেনারা টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ-মানিকগঞ্জ এবং ঢাকার দিকে গাজীপুর পর্যন্ত কোনো পা ফেলবে না। তুমি আমার রূঢ় ব্যবহার, তোমার প্রতি গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি এসব ভুলে যেও।’ আমিও ভুলে গিয়েছিলাম। এর পরও ছোট্ট একটি ঘটনা আছে বঙ্গতাজ তাজউদ্দীনকে নিয়ে। ’৭৩ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর কাছে গিয়েছিলাম বঙ্গবন্ধুর চিঠি নিয়ে খাদ্য সাহায্য চাইতে। ভারতে যেতে কী হবে, কত খরচ লাগবে কিছুই জানতাম না। মুক্তিযুদ্ধের কারণে লোকজন আমাকে সাহসী জানলেও আমি ছিলাম চরম ভীতু। ১ হাজার টাকা পকেটে নিয়ে যেতে সাহস পাইনি যদি কাস্টমস ধরে কী জবাব দেব। তাই বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলাম টাকা দিতে। তখন প্রতি জনের জন্য বরাদ্দ ২০০ ডলার। নিয়মমতো পাই ৬০০ ডলার। তখন ডলারের দাম ভারতে সাড়ে ৬ টাকা, বাংলাদেশে সাড়ে ৪ টাকা। বঙ্গবন্ধু বলে দিলেন, ‘ঠিক আছে তোরা প্রতি জন ২ হাজার করে নিয়ে যা।’ খুব সম্ভবত অর্থ সচিবকে ডেকে বলে দিয়েছিলেন। টাকা আনতে গিয়ে ব্যাংকওয়ালা প্রতি জনকে ২০০ ডলার দিতে চান। মাথায় আগুন ধরে যায়। পরদিন দিল্লির ফ্লাইট। এয়ার ইন্ডিয়ায় আমরা যাব। তিনজন শামসুদ্দিন আহমেদ বালু মোক্তার, বাবুল হক ও আমি। ডলার হবে ৬ হাজার, সেখানে ৬০০! শামসুদ্দিন আহমেদ বালু মোক্তার ডলার না নিয়েই বাড়ি ফিরে আসেন। শুনে আমি স্তম্ভিত হয়ে যাই। শামসুদ্দিন আহমেদ বালু মোক্তার ডলারের কথা বলতে বলতেই অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে ফোন, ‘তাজউদ্দীন সাহেব কথা বলতে চান।’ ফোন ধরতেই বললেন, ‘কাদের, তুমি খুব বিরক্ত হয়েছো? রাগ করেছো? একটু কি আসতে পারবে।’ বড়দের অস্বীকার করা আমাদের পারিবারিক ঐতিহ্যে বাজত। তাই গিয়েছিলাম। এখনকার মতো তখন যানজট ছিল না। রাস্তা থাকত ফাঁকা। ১২-১৫ মিনিট লেগেছিল। ২৮ ডিসেম্বর প্রথম সাক্ষাতে যেমন নিজের চেয়ার ছেড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরেছিলেন অনেকটা তেমনি আমাকে বসতে বলে আমার পাশে এসে বলেছিলেন, ‘কাদের, মনে হয় তুমি রাগ করেছ।’ বলেছিলাম, রাগ করব না? জাতির পিতা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু যেখানে প্রতি জনকে ২ হাজার ডলার করে দিতে বলেছেন আপনি সেটাকে ২০০ করে দিয়েছেন। আপনি তো আরেক প্রধানমন্ত্রী। তাজউদ্দীন সাহেব বললেন, ‘না কাদের, তেমন নয়। তোমার বন্ধু যেমন আছে শত্রুরও অভাব নেই। তোমাকে ২ হাজার ডলার দিলে ভবিষ্যতে শত্রুরা শক্তি পাবে। আর ভারতে তোমার কীসের টাকার দরকার? মুক্তিযুদ্ধে তুমি আর বঙ্গবন্ধুই তো ভারত জয় করেছ। ফিরে এসে আমাকে বোলো তোমার টাকার কোনো অভাব হয়েছে কি না। আমার বিশ্বাস এবার ভারত সফরে তোমার টাকা রাখার জায়গা হবে না।’ সত্যিই ওভাবেই গিয়েছিলাম প্রতি জন ২০০ ডলার নিয়ে। ফিরে আসার পথে অনেক টাকা। মনে হয় ৪৬ হাজার। বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকীর কর্মী বাংলাদেশ হাইকমিশনের সাধারণ এক কর্মচারী মজনুকে দিয়ে এসেছিলাম। টাকা পকেটে ভরে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিলেন। যখন বিমানে ওঠার জন্য ভিআইপি লাউঞ্জের গেট পার হচ্ছিলাম তখন আমার দিকে তাকিয়ে মজনু বলেছিলেন, ‘ছোট ভাই, আমাকে তো এত টাকার জন্য একটু পরই গ্রেফতার করবে। ৪০০ টাকা বেতনের কর্মচারীর হাতে ৪৬ হাজার কী জবাব দেব?’ সঙ্গে সঙ্গে উপরাষ্ট্রদূতকে বলেছিলাম, মজনু আমার ভাই। আমি তার কাছে টাকা রেখে গেলাম। এই ছিলেন বঙ্গতাজ তাজউদ্দীন। সেদিন ২৮ ডিসেম্বর ’৭১ স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বঙ্গভবনে গিয়েছিলাম। একেবারে প্রথম ’৬৬-তে বঙ্গভবনে ঢুকেছিলাম। তখন ভবনটার নাম ছিল গভর্নর হাউস। আর এই দ্বিতীয়বার। গিয়ে দেখি কর্নেল ফিরোজ সালাউদ্দিন রাষ্ট্রপতির মিলিটারি সচিব। যিনি গভর্নর ভবনে অনেকদিন ছিলেন। গভর্নর ডা. মালেকেরও মিলিটারি সচিব ছিলেন। টিক্কা খানেরও কিছুদিন সার্ভিস দিয়েছেন। গভর্নর মালেক হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে আশ্রয় নেওয়ার আগ পর্যন্ত ডা. মালেকের কাজ করেছেন। বাকি সময় বঙ্গভবন আগলে রেখেছেন। ২২ ডিসেম্বর মুজিবনগর সরকার ঢাকায় এলে বঙ্গভবনে সেই পাকিস্তানি কর্নেল স্বাধীন বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতিকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। মিলিটারি সচিব যেভাবে সার্ভিস দিতে পারেন সেভাবেই দিয়েছিলেন। এই হলো আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, এই হলো আমাদের দেশ। যার সুফল অথবা কুফল আমরা আজ ভোগ করছি।

সদ্যবিদায়ী রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের সঙ্গে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের নেতৃবৃন্দ

সর্বশেষ রাষ্ট্রপতি ভবনে গিয়েছিলাম সেদিন স্বাধীনতা দিবসে ২৬ মার্চ। মহামান্য রাষ্ট্রপতি এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমন্ত্রিতদের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ করে যেখানে বসেন সেখানে যাইনি। তাই দুজনের কারও সঙ্গেই সেদিন দেখা হয়নি। কিন্তু তার আগে নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে গত বছরের ৯ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতির সঙ্গে কথা বলতে বঙ্গভবনে গিয়েছিলাম। শরীর ছিল খুবই নাজুক। আবার যাওয়ার পথে মোহাম্মদপুরের বাড়িতে সিঁড়ির শেষ ধাপে পড়ে গিয়েছিলাম। জীবনে সেই ছিল একবার সিঁড়ি থেকে পড়া। কিন্তু খুব একটা ব্যথা পাইনি। ফরিদ আর কে কে যেন টেনে তুলেছিল। পায়ে প্রচন্ড ব্যথা, তেমন চলতে পারতাম না। তাই নিচে ১০ মিনিট বসে থাকতেই কষ্ট চলে গিয়েছিল। গিয়েছিলাম বঙ্গভবনে। সেখানে হুইলচেয়ার খুঁজে ছিলাম। কিন্তু পাইনি। সামনে ড্রয়িং রুম থেকে দরবার হল কত আর হবে বড়জোর ৩০-৪০ গজ। হেঁটে গিয়ে দরবার হলে বসেছিলাম। মহামান্য রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ একজন আগাগোড়া রাজনৈতিক মানুষ। বৃহত্তর ময়মনসিংহের মানুষ। আমরা এখনো এক আত্মা এক প্রাণ। তিনি এসে হাত চেপে ধরে খোলামেলা বলেছিলেন, ‘আর বেশিদিন থাকব না ভাই। এপ্রিলে চলে যাব। দোয়া করবেন যাতে সম্মান নিয়ে যেতে পারি।’ সেই মানুষটা গতকাল বিদায় হলেন। তাঁর বিদায় অনুষ্ঠানে হাজির হতে পেরে নিজেকে বড় সৌভাগ্যবান মনে করেছি। মনে পড়ছে বিপ্লবী কবি কাজী নজরুলের অমর কবিতা-

বিদায়, হে মোর বাতায়ন-পাশে নিশীথ জাগার সাথী!

ওগো বন্ধুরা, পান্ডুর হ’য়ে এল বিদায়ের রাতি!

আজ হ’তে হ’ল বন্ধ আমাদের জানালার ঝিলিমিলি,

আজ হ’তে হ’ল বন্ধ মোদের আলাপন নিরিবিলি। ...

অস্ত-আকাশ-অলিন্দে তার শীর্ণ কপোল রাখি,

কাঁদিতেছে চাঁদ, মুসাফির জাগো, নিশি আর নাই বাকী!

নিশীথিনী যায় দূর বন-ছায়, তন্দ্রায় ঢুলুঢুল্,

ফিরে ফিরে চায়, দু’-হাতে জড়ায় আঁধারের এলোচুল।-

নতুন রাষ্ট্রপতির শপথ অনুষ্ঠান মাত্র চার-সাড়ে চার মিনিটের। সময় খরচ হলো আড়াই ঘণ্টা। মোহাম্মদপুরের বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলাম ৯টা ৩০ মিনিটে। রাস্তা ছিল একেবারে ফাঁকা। তবু রাষ্ট্রপতি ভবনের দোরগোড়ায় পৌঁছাতে ১০টা ১০-১২ মিনিট লেগেছিল। বসতে দিয়েছিল একেবারে সামনের কাতারে দরজার পাশে এক রো পরে। কিন্তু আমার সামনে দুই সিট খালি ছিল। একেবারে সামনে বসেছিলেন জি এম কাদের। আমার বাঁ পাশে রাশেদ খান মেনন, ডান পাশে মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া। অনেক মন্ত্রীও পেছনে ছিলেন। ১০টা ২৫-৩০ মিনিটে শেখ রেহানাকে নিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দরবার হলে প্রবেশ করেন। তাঁদের আগে আগে এসেছিলেন আমির হোসেন আমু। তারও আগে মতিয়া চৌধুরী। মাঝে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। একেবারে কাঁটায় কাঁটায় ১১টায় শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী। তাঁর কণ্ঠ সুদৃঢ়। শপথ শেষে আপ্যায়নের ব্যবস্থা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং বিদায়ী ও নবনির্বাচিত রাষ্ট্রপতি যে ঘরে বসেছিলেন আমিও সেখানে গিয়েছিলাম। আমাকে দেখেই বোন বলছিলেন, ‘ও তুমি এসেছ?’ বলেছিলাম, হ্যাঁ। সঙ্গে বলেছিলাম পবিত্র ঈদের জন্য সালাম করতে চাই। বোন বললেন, ‘না না এখানে না।’ শেখ রেহানা সহজাতভাবে বলে বসল, ‘আপা না করলে কি হলো আপনি জোর করে করবেন। আপনাকে আবার ঠেকায় কে?’ জোর করে করেছি কি না জানি না। কিন্তু আমি সালাম করে এসেছি। অনেকের সঙ্গে দেখা হয়েছে ভালো লেগেছে। কিন্তু ব্যাপারটা কেমন যেন একতরফা শুধু আওয়ামী লীগ আর আওয়ামী লীগ। বাইরের হয়তো দু-চার জন ছিলেন। কিন্তু চোখে পড়েনি। বঙ্গভবনে ঢুকেই টাঙ্গাইলের ছোট মণিকে পেয়েছিলাম। ওকে অনেক রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে দেখি। ঢাকা উত্তরের মেয়র জোরজবরদস্তি করে এক টেবিলে নিয়ে বসিয়েছিলেন। ডানে দক্ষিণের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস, বাঁয়ে উত্তরের মেয়র আতিকুল ইসলাম বসেছিলেন। অনুষ্ঠান থেকে বেরোতে অনেক সময় লেগেছে। মূল কারণ প্রথম মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, পরেরটুকু বিদায়ী রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের প্রতিক্রিয়া জানতে অনেক টেলিভিশন ক্যামেরা রাস্তা বন্ধ করে রেখেছিল। তাই কিছুটা দেরি হয়েছে। তবে সর্বোপরি একটি চমৎকার শপথ অনুষ্ঠান হয়েছে। এর আগে কেউ একটানা ১০ বছর রাষ্ট্রপতি ভবনে থাকেননি।

আসা-যাওয়াই পৃথিবী, আসা-যাওয়াই জীবন। ‘জন্মিলে মরিতে হইবে অমর কোথা কে কবে?’ রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নিয়েছিলেন ১০ বছর আগে, কাল ছেড়ে গেলেন। সত্যিই তাঁকে অসম্মান হতে হয়নি। তেমন বড়সড় সংকট পার করতেও হয়নি। আল্লাহ তাঁকে অসম্ভব মেহেরবানি করেছেন। বাকি জীবন যাতে ভালো যায় আল্লাহ রব্বুল আলামিনের কাছে সেই কামনাই করি। ‘ঐ নূতনের কেতন ওড়ে তোরা সব জয়ধ্বনি কর, তোরা সব জয়ধ্বনি কর।’ গৃহপ্রবেশ ঘটেছে নতুন রাষ্ট্রপতি জনাব মো. সাহাবুদ্দিনের। আরেকজন সাহাবুদ্দীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন। তাঁর বাড়ি বৃহত্তর ময়মনসিংহের নেত্রকোনায়। তারপর ছিলেন জিল্লুর রহমান। তাঁর বাড়িও বৃহত্তর ময়মনসিংহের ভৈরবে। এবার একজন পাবনার লোক এলেন। তাঁকে নিয়ে ভালোমন্দ কোনো কিছুই বলতে চাই না। তবে বিচারপতি সাহাবুদ্দীনকে নিয়ে আমরা খুব শান্তি পাইনি। খুব গর্ব করা যায় না। মুক্তিযুদ্ধের সময় ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। পুরো নয় মাসই চাকরি করেছেন পাকিস্তান সরকারের, বেতন তুলেছেন। তারপর একসময় সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি হন। সেখান থেকে তাঁকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি করা হয়। প্রধান বিচারপতির কার্যকাল বাকি ছিল। তিনি আবার রাষ্ট্রপতি থেকে প্রধান বিচারপতির যে কার্যকাল বাকি ছিল তা পুরো করেছিলেন। তারপর তাঁকে পূর্ণ রাষ্ট্রপতি করা হয়। সেখানেও রাষ্ট্রপতির কার্যকাল শেষ করে তবে বনানীর সরকারি বাড়িতে অনেকদিন কাটিয়েছিলেন। এবার বৃহত্তর ময়মনসিংহ থেকে পদটি পাবনায় চলে গেল। জানাজানি পরিচয় না থাকলেও আমি খুশি। তাঁকে রাষ্ট্রপতি বানানো হয়েছে মাননীয় সংসদ সদস্যদের সম্মতিতে। সংসদীয় দলের সদস্যরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে রাষ্ট্রপতি মনোনয়নের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। তিনি তাঁর দলের এবং সংসদের অর্পিত দায়িত্ব যথাযথ পালন করেছেন। দেখা যাক এক সাহাবুদ্দীন আমাদের অনেকটাই হতাশ করেছিলেন, মহামান্য রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন কতটা আশান্বিত করতে পারেন। আল্লাহ রব্বুল আলামিন নতুন মহামান্য রাষ্ট্রপতিকে দীর্ঘায়ু দান ও সফলকাম করুন।

♦ লেখক : রাজনীতিক

www.ksjleague.com

 

সর্বশেষ খবর