বুধবার, ৩ মে, ২০২৩ ০০:০০ টা

জাতিসংঘে গণহত্যার ছবি ও পাকিস্তানি মিথ্যাচার

বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক

জাতিসংঘে গণহত্যার ছবি ও পাকিস্তানি মিথ্যাচার

গত ৫ এপ্রিল দি নেশন নামক পাকিস্তানি একটি পত্রিকার সংবাদ আমার দৃষ্টিতে আসে। পাকিস্তানি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক মহিলা কর্মকর্তার ছবিসহ খবরটিতে উল্লেখ করা হয়, জাতিসংঘে বাংলাদেশ দূতাবাস একপেশে, ইতিহাস বিকৃত করে, নিয়ম না মেনে, একটি চিত্রপ্রদর্শনীর আয়োজন করলে জাতিসংঘ সেটি বন্ধ করে দেয় এবং বিতর্কিত ছবিগুলো নামিয়ে ফেলে।  পত্রিকাটি আরও উল্লেখ করেছে, পাকিস্তান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বাংলাদেশের প্রদর্শনীটি বন্ধ করার জন্য জাতিসংঘকে সাধুবাদ জানিয়েছে।

প্রকাশিত সংবাদটি দেখে অবাক এবং ক্ষিপ্ত হয়েছিলাম। কেননা এ বিষয়ে কোনো কিছুই আমাদের গণমাধ্যমে আসেনি। বাংলাদেশের একটি জাতীয় দৈনিকে একটি নিবন্ধে আমি বিষয়টি উল্লেখ করার পর সেটি আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নজর কাড়লে তারা এ মর্মে বিস্তারিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তি প্রদান করেন যে, পাকিস্তানি গণমাধ্যমের খবরটি মিথ্যাচারে ভরপুর। বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয় যে, জাতিসংঘের সমস্ত নিয়মকানুন মেনেই তিন দিনের জন্য চিত্র প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হয়েছিল, যা তিন দিন পূর্ণ হওয়ার পর স্বাভাবিক নিয়মেই বন্ধ হয়ে যায়। বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়, জাতিসংঘে ’৭১-এর গণহত্যার তথ্য সংবলিত চিত্র প্রদর্শনী এই প্রথম যার উদ্দেশ্য ’৭১-এ বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের চেষ্টা। আরও জানানো হয়েছে, প্রদর্শনী উদ্বোধনকালে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন ছাড়া বেশকটি দেশের কূটনীতিক, বাংলাদেশের কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা এবং শহীদ সন্তান উপস্থিত ছিলেন। আমি জেনেছি শহীদ সন্তান তৌহিদ রেজা নূরও উপস্থিত ছিলেন।

এই প্রথমবার জাতিসংঘে এ ধরনের একটি চিত্র প্রদর্শনীর জন্য নিশ্চিতভাবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং জাতিসংঘে আমাদের মিশন প্রশংসার দাবিদার। তবে পাকিস্তান যে এ ব্যাপারে মিথ্যাচারের আশ্রয় নিয়েছে, সে খবরটি আগেই দেওয়া উচিত ছিল, যাতে দেশের মানুষ পাকিস্তানি গণমাধ্যমের শঠতা জানতে পারতেন। পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেনের গোটা পরিবারকে শৈশব থেকেই চিনি একই এলাকায় বেড়ে উঠেছি বলে। তার পরিবার যেমনই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের তার শ্বশুর লুৎফর মতিনও একজন কূটনীতিক মুক্তিযোদ্ধা, যিনি মুক্তিযুদ্ধকালে লন্ডনস্থ পাকিস্তান দূতাবাস থেকে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন।

প্রায় একই সময়ে যখন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক সাবেক সচিব, প্রয়াত মহিউদ্দিন আহমেদও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে একাত্মতা ঘোষণা করেছিলেন। দুজনের সঙ্গেই যুক্তরাজ্যে মুক্তিসংগ্রামে কাজ করার সুযোগ হয়েছিল, যা সব সময় মনের কোণে স্থায়ীভাবে অমøান হয়ে থাকবে। সে অর্থে সচিব মাসুদ বিন মোমেন যে আমাদের গণহত্যার জন্য বিশ্ব স্বীকৃতির চেষ্টা করবেন, সেটাই স্বাভাবিক। গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য প্রয়োজন হবে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের প্রস্তাব। আজ পর্যন্ত এ ব্যাপারে ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং ইউরোপের কটি দেশ অনেকটাই আগ্রহী রয়েছে। গত বছর সেপ্টেম্বরে ব্রাসেলসে ইউরোপীয় ইউনিয়নে স্বীকৃতির দাবি জানানোর জন্য ’৭১-এর ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সঙ্গে ব্রাসেলস ভ্রমণকালে জানার সুযোগ হয়েছিল যে, ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশ স্বীকৃতি দিতে প্রস্তুত। কিন্তু পাকিস্তান যে এখনো গণহত্যার সত্যতা মানতে রাজি নয়, তার উপর্যুপরি প্রমাণ প্রতিনিয়তই আসছে। গত মার্চ মাসে শ্রীলঙ্কায় পাকিস্তানি পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হিনা রাব্বানি খাঁর কথায়ও এ ধরনের ইঙ্গিত রয়েছে। তিনি বলেছেন, ’৭১-এ যা ঘটেছে তার জন্য ক্ষমা চাওয়ার ব্যাপারে পাকিস্তানের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। পাকিস্তানি গণমাধ্যমে সর্বশেষ মিথ্যানির্ভর খবরটিতেও এর ইঙ্গিত রয়েছে। এ খবরের পেছনে যে পাকিস্তান সরকারের অন্তত পরোক্ষ ইন্ধন ছিল তার প্রমাণ মেলে উল্লিখিত পত্রিকায় পাকিস্তানি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দাবির উল্লেখ করা হলেও এবং তাদের মন্ত্রণালয়ের এক মহিলা কর্মকর্তার ছবি প্রকাশিত হলেও পাকিস্তান সরকারের নিশ্চুপতা থেকে। পত্রিকায় প্রকাশ করা হয়েছে যে, পাকিস্তান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাদের ভাষায় ‘বিতর্কিত ছবি’ নামিয়ে দেওয়ায় জাতিসংঘকে ধন্যবাদ জানিয়েছে। এ সংবাদটি শেষ হতে না হতেই এই মর্মে আরও একটি সংবাদ এসেছে, পাকিস্তানে মুক্তিযুদ্ধ এবং বন্ধবন্ধুকে বিকৃত করে একটি ‘প্রেমের ছবি’ নির্মাণ করা হয়েছে, যাতে বঙ্গবন্ধুর বক্তব্যকে ভ্রান্তভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। ইদানীং আরও একটি খবর মুক্তিযুদ্ধের চেতনাপন্থি সবার নিদ্রাভঙ্গ করেছে, যা হলো এই যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণহত্যা কেন্দ্রের প্রধানের পদ থেকে সম্প্রতি অব্যাহতি দেওয়া অধ্যাপক ইমতিয়াজের পুস্তক ‘হিস্টোরিসাইজিং ৭১ জেনোসাইড’ ছাপানোর জন্য সাবাহ খাট্টাক নামক ড. ইমতিয়াজের এক পাকিস্তানি বান্ধবী চাপ দিয়েছিলেন, যে কথা ড. ইমতিয়াজ তার বইতেই উল্লেখ করেছেন। ওই সাবাহ খাট্টাক পাকিস্তানের একটি ইনস্টিটিউটের প্রাক্তন পরিচালক বলেও ড. ইমতিয়াজ ব্যক্ত করেছেন। পরবর্তীকালে একটি অনলাইন পত্রিকার কাছে তিনি স্বীকার করেছেন যে, বইটি ছাপানোর জন্য তিনি পাকিস্তান থেকে টাকাও পেয়েছেন। বইটিতে শেখ মুজিব (তার ভাষায়) ৭ মার্চের ভাষণ ‘জয় পাকিস্তান’ বলে শেষ করেছিলেন। এ কথা বলা ছাড়াও এমন সব কথা রয়েছে যা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে, যেমন ড. ইমতিয়াজ শহীদদের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। লিখেছেন, বাঙালিরা সর্বোচ্চ ৫০ হাজার বিহারিকে হত্যা করেছে, যার বিচার হওয়া উচিত। লিখেছেন সংগ্রামটি বাংলাদেশের মুক্তির জন্য শুরু হলেও অবশেষে এটি একান্তই ভারত-পাকিস্তান বিষয়ে মোড় নিয়েছিল, লিখেছেন পাকিস্তানি সৈন্যরা শুধু ভারতীয় বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছে, লিখেছেন শেখ মুজিব (তার ভাষায়) কালক্ষেপণ করেছেন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঠেকানোর জন্য, এই যুক্তি দিয়ে যে এ ব্যাপারে সময় নষ্ট করা ঠিক হবে না কেননা সাক্ষী-প্রমাণ নেই। লিখেছেন ৯ মাসে ৩০ লাখ হত্যার দাবি পরিসংখ্যানগত দুঃস্বপ্ন। তবে তার মন্তব্যের সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক উপাদানটি লক্ষ্য করা যায়, তার এই মর্মে লেখা থেকে যে বাংলাদেশে হত্যাযজ্ঞ কোনো ভাষাগত, গোষ্ঠীগত, জাতিগত কারণে হয়নি, হয়েছে নেহায়েতই রাজনৈতিক কারণে কেননা পাকিস্তানি এবং বাঙালিদের মধ্যে এসব নিয়ে কোনো দ্বন্দ্ব ছিল না। তার এ দাবির অর্থ ’৭১-এর হত্যাযজ্ঞ ১৯৪৮ সালের গণহত্যার সংজ্ঞাভুক্ত নয় কেননা কনভেনশনভুক্ত হতে হলে একটি মানব গোষ্ঠী কর্তৃক অন্য গোষ্ঠীর ওপর আক্রমণ চালাতে হয় জাতিগত, গোত্রগত, বর্ণগত বা ধর্মগত দ্বন্দ্বের কারণে। বিশ্ব সম্প্রদায় যদি জানতে পারেন যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণহত্যা স্ট্যাডিস কেন্দ্রের প্রধানই লিখেছেন, ’৭১-এর হত্যাযজ্ঞ গণহত্যা কনভেনশনভুক্ত নয়, তাহলে তা নিয়ে দুশ্চিন্তার কারণ রয়েছে বৈকি। ড. ইমতিয়াজকে কেন্দ্র থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে বটে, কিন্তু তার বই তো রয়ে গেল। তার লেখাসমূহ যে সঠিক নয় সে কথা ড. ইমতিয়াজ নিজে লিখিতভাবে উল্লেখ না করলে সমস্যা থেকেই যাবে।

এ বিষয়ে আমাদের একজন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত চিকিৎসা বিজ্ঞানী, বঙ্গবন্ধু চিকিৎসা বিশ্ববিদ্যালয়ের যকৃৎ বিভাগের প্রধান, অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নিল একটি সংবাদ মাধ্যমে লিখেছেন, একটি বিদেশি দূতাবাসের এক অনুষ্ঠানে ড. ইমতিয়াজ গর্বভরে বলছিলেন, তার বইটির মতো কোনো বই আজ পর্যন্ত লেখা হয়নি এবং একজন মন্ত্রী তার বইটি বিভিন্ন দেশে পাঠিয়েছেন। অর্থাৎ এরই মধ্যে বইটি অনেক দেশেই পৌঁছেছে। সুতরাং একে লুকানোর সুযোগ নেই। অনেকেরই প্রশ্ন, বইটি যে সমস্যার সৃষ্টি করেছে, তা থেকে উত্তরণের পথ কী? এটি দুইভাবে হতে পারে। প্রথমত, এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকারের মতো লিখিতভাবে মিথ্যাচার স্বীকার করে ক্ষমা প্রার্থনা, দ্বিতীয়ত, বইটির আর একটি সংস্করণ বের করে তাতে লেখা যে, ২০০৯-এর সংস্করণে মিথ্যাচার ছিল। আরও উল্লেখযোগ্য যে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চ ভাষণকে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ বলে স্বীকৃতি দিয়েছে সে ভাষণকে যা শেষ হয় ‘জয় বাংলায়’ যেখানে ‘জয় পাকিস্তান’ বলে কিছু ছিল না। সে কারণেও ড. ইমতিয়াজের লিখিতভাবে উল্লেখ করতে হবে যে, তিনি মিথ্যাচারের ওপর ভর করেই বইটি লিখেছেন। এ ব্যাপারে তিনি নিজে অগ্রণী হয়ে এগোলে, ভালো কথা। অন্যথায় আইনি প্রয়োগের মাধ্যমে তাকে মিথ্যাচার স্বীকার করতে বাধ্য করতে হবে। মুন্সীগঞ্জের মোহাম্মদ মহিউদ্দিন, সেদিন রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে কাছে যে লোকটি তার নিরাপত্তার জন্য দাঁড়িয়েছিলেন, তিনি অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ করেছেন যে, বঙ্গবন্ধু কখনো ‘জয় পাকিস্তান’ বলেননি, আর যারা বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণকে বিকৃত করার চেষ্টা করছে তারা মিথ্যাচারী, কুলাঙ্গার।  মঞ্চের খুব কাছেই ছিলেন ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী এবং তিনিও একই কথা বলেছেন। বঙ্গবন্ধুর খুব কাছেই ছিলেন এমন জীবিত জনদের মধ্যে রয়েছেন তোফায়েল আহমেদ, আমির হোসেন আমু প্রমুখ। তাদের ভাষ্য থেকেও জানা যাবে বঙ্গবন্ধু আসলে ‘জয় পাকিস্তান’ বলেছিলেন কি না?

ইতিহাসের এহেন বিকৃতি কোনো অবস্থায়ই ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত থাকতে দেওয়া যায় না, কেননা আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ছাড়াও এর ফলে প্রজন্মের পর প্রজন্মের মনে দ্বিধা এবং সংশয় দেখা দেবে।  তাই কালবিলম্ব না করে লিখিতভাবে ড. ইমতিয়াজকে মিথ্যা স্বীকার করে জাতির কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। 

                লেখক : আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি

সর্বশেষ খবর