শনিবার, ৬ মে, ২০২৩ ০০:০০ টা

তাজউদ্দীন চেয়েছিলেন গরু এবং দড়ি শেখ হাসিনা উপহার দিলেন পদ্মা সেতুর ছবি

সৈয়দ বোরহান কবীর

তাজউদ্দীন চেয়েছিলেন গরু এবং দড়ি শেখ হাসিনা উপহার দিলেন পদ্মা সেতুর ছবি

২৬ জানুয়ারি ১৯৭২। ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবস। আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে দিল্লিতে গেলেন সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। ওই অনুষ্ঠানে যোগ দেন বিশ্বব্যাংকের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রবার্ট ম্যাকনামারা। মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকার জন্য তাজউদ্দীন আহমদ যে বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্টকে পছন্দ করতেন না, তা ভারত সরকার খুব ভালো করেই জানত। তাই অনুষ্ঠানের আসনবিন্যাসে রবার্ট ম্যাকনামারার পাশেই তাজউদ্দীন আহমদের বসার ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু পুরো অনুষ্ঠানে তাজউদ্দীন আহমদ বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে একটি কথাও বলেননি। এমনকি তাঁর দিকে ফিরেও তাকাননি। ম্যাকনামারা অনুষ্ঠানে বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রীর দিকে তাকিয়েছেন। কিন্তু সাড়া পাননি। এর কদিন পরই (৩১ জানুয়ারি) ম্যাকনামারা প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ সফরে আসেন। অনেকেই বঙ্গবন্ধুকে পরামর্শ দিলেন বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্টকে বিমানবন্দরে গিয়ে তাঁরই রিসিভ করা উচিত। বঙ্গবন্ধু ডেকে পাঠালেন অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে। তাজউদ্দীন আহমদ যুক্তি দিয়ে বঙ্গবন্ধুর বিমানবন্দরে যাওয়া বন্ধ করলেন। এমনকি রবার্ট ম্যাকনামারাকে স্বাগত জানাতে নিজেও গেলেন না বিমানবন্দরে। শেষ পর্যন্ত পাঠানো হলো বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে। বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রীর আনুষ্ঠানিক বৈঠকটিও ছিল বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের বিরোধিতার মধুর প্রতিশোধ। বৈঠকে বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট জানতে চাইলেন বাংলাদেশের জন্য কোথায়, কী ধরনের সাহায্য দরকার। জবাবে তাজউদ্দীন আহমদ বললেন ‘আমাদের যা দরকার তা আপনি দিতে পারবেন কি না আমার সন্দেহ আছে।’ ম্যাকনামারা বললেন, ‘মিস্টার মিনিস্টার, আপনি বলুন আমরা চেষ্টা করব।’ উত্তরে তাজউদ্দীন বললেন, ‘মিস্টার ম্যাকনামারা, আমার গরু এবং দড়ি দরকার। মুক্তিযুদ্ধের সময় অনেক গরু হারিয়ে গেছে। এখানে ওখানে চলে গেছে। হারিয়ে গেছে, মরে গেছে। এখন যুদ্ধ শেষ, চাষিরা গ্রামে ফিরেছে। কিন্তু গরু নেই। তারা চাষ করবে কীভাবে? কাজেই আমাদের অগ্রাধিকার চাহিদা হলো গরু।’ ম্যাকনামারার চোখমুখ লাল হয়ে গেল। এবার বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী আরও একধাপ এগিয়ে গেলেন। বললেন, ‘আর আমাদের সব দড়ি তো পাকিস্তানিরা নষ্ট করে ফেলেছে। এখন গরু বাঁধার জন্য দড়ি প্রয়োজন।’ অর্থমন্ত্রী বললেন, ‘দড়ি এবং গরু খুব তাড়াতাড়ি প্রয়োজন। না হলে সামনে জমিতে চাষ হবে না।’ বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্টের সামনে এভাবেই সদ্যস্বাধীন দেশের আত্মমর্যাদার প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ। (তথ্যসূত্র : তাজউদ্দীন আহমদ-আলোকের অনন্তধারা প্রথম খন্ড)

অর্থমন্ত্রী হিসেবে তাজউদ্দীন আহমদের ব্যক্তিত্ব এবং দৃঢ়তায় বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্টের কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল জানা যায়নি। তবে কাজ দিয়ে বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট বুঝিয়ে দেন ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে তাঁর ভূমিকার জন্য তিনি অনুতপ্ত। তাজউদ্দীন আহমদ জানতেন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে বিশ্বব্যাংকের সহযোগিতা লাগবেই। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণে আন্তর্জাতিক সাহায্য উপেক্ষা করা যাবে না। কিন্তু বিশ্বব্যাংকের কাছে ঋণ নিতে গিয়ে তিনি হাত পাতেননি। বাংলাদেশের আত্মমর্যাদা বিকিয়ে দেননি। বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্টও বুঝেছেন বাংলাদেশ নতজানু হওয়ার দেশ নয়। ম্যাকনামারার সফরের ছয় মাসের মধ্যেই ১৯৭২ সালের ১৭ আগস্ট বাংলাদেশ বিশ্বব্যাংকের ১১৭তম সদস্য হয়। সহজ শর্তে ঋণ প্রাপ্তির দরজা উন্মুক্ত হয় ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের (আইডিএ) ১০৮তম সদস্য হওয়ার মধ্য দিয়ে। সদস্য হওয়ার তিন মাসের মধ্যেই ১৯৭২ সালের ২৪ নভেম্বর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে ৫ কোটি ডলার ঋণ সহায়তা পায় বাংলাদেশ। এটি বাংলাদেশকে বিশ্বব্যাংকের প্রথম অর্থ ছাড়। এত দ্রুতগতিতে বিশ্বব্যাংক থেকে অন্য কোনো দেশ ঋণ পায়নি।

’৭২-এ বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথে তাজউদ্দীন আহমদ বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্টের ওপর যে মধুর প্রতিশোধ নিয়েছিলেন তা আবার দেখল বাংলাদেশ ১ মে, ২০২৩ সালে। আবারও প্রমাণ হলো, নতজানু হয়ে নয় বরং আত্মসম্মান দিয়েই দেশের স্বার্থ সবচেয়ে বেশি রক্ষা করা যায়। ’৭১-এর ভুলের জন্য অনুতপ্ত বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট দ্রুত ঋণ দেন বাংলাদেশকে। গরু আর দড়ির চাহিদার উপহাস হজম করেন আর ২০২৩ সালে পদ্মা সেতু নিয়ে অনুতপ্ত বিশ্বব্যাংক প্রধানমন্ত্রীকে ডেকে বাংলাদেশের উন্নয়নের স্তুতিগান গাইল। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বের ভূয়সী প্রশংসা করা হলো। পদ্মা সেতুর চিত্রকর্ম গ্রহণ করলেন বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট বিবর্ণ হাসিতে।

বঙ্গবন্ধু এবং তাজউদ্দীন আহমদ বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে যে সম্পর্কের সূচনা করেছিলেন, তা ৫০ বছর অতিক্রম করেছে নানা চড়াই-উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় ঘটনা ঘটেছে ২০১২ সালে। কথিত দুর্নীতির অভিযোগে সে বছর ২৯ জুন পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পে ১২০ কোটি ডলারের ঋণ চুক্তি বাতিলের ঘোষণা দেয় বিশ্বব্যাংক। এরপর তৎকালীন অর্থমন্ত্রী এবং প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টা ওয়াশিংটনে বিশ্বব্যাংকের সদর দফতরে দেনদরবার করেন। ঋণ দিতে বিশ্বব্যাংক বেশ কিছু শর্ত দেয়। সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, শর্ত সাপেক্ষে পদ্মা সেতুতে অর্থায়নে রাজি হয়েছে বিশ্বব্যাংক। কিন্তু এর পরই শুরু হয় চরিত্রহননের ষড়যন্ত্র। দুর্নীতি দমন কমিশনের কাঁধে বন্দুক রেখে বিশ্বব্যাংকের মনোবাসনা পূরণের মিশনে নামেন সরকারের কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। বর্তমান রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন তখন ছিলেন দুর্নীতি দমন কমিশনের সদস্য। সরকারের একজন মন্ত্রী ও উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকের জন্য প্রাতরাশের দাওয়াত পান এই বীর মুক্তিযোদ্ধাও। তবে তাঁকে দাওয়াত দেওয়া হয়েছিল সবার শেষে। তার আগেই দুদকের চেয়ারম্যান এবং অন্য কমিশনাররা মন্ত্রী ও উপদেষ্টার আমন্ত্রণে আপ্যায়িত হন। তাঁদের বলা হয়, সেতুমন্ত্রী (সৈয়দ আবুল হোসেন)-কে গ্রেফতার করতে হবে। হাতকড়া পরাতে হবে। টেন্ডার কমিটির সবাইকে গ্রেফতার করতে হবে। রিমান্ডে নিতে হবে। এদের কাছ থেকে বঙ্গবন্ধু পরিবারের বিরুদ্ধে স্বীকারোক্তি আদায় করতে হবে। তা হলেই পদ্মা সেতুর জন্য বিশ্বব্যাংকের কাক্সিক্ষত ঋণ পাওয়া যাবে। এ যেন ১৫ আগস্টের মতোই আরেক ষড়যন্ত্র। বঙ্গবন্ধু পরিবারকে কলুষিত করার আরেক নোংরা খেলা। মো. সাহাবুদ্দিন ছাড়া দুর্নীতি দমন কমিশনের বাকিরা রাজি হয়ে যান এ প্রস্তাবে। কিন্তু মো. সাহাবুদ্দিন আইনের মানুষ। বিচারক ছিলেন। তিনি সরকারের দুই প্রভাবশালীকে সাফ জানিয়ে দেন, আইনের বাইরে কিছুই করবেন না। এরপর বিশ্বব্যাংকের উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন প্রতিনিধিদল ঢাকায় আসে। দুদকের সঙ্গে বৈঠকে বসে। একাই লড়াই করেন মো. সাহাবুদ্দিন। বিশ্বব্যাংক প্রতিনিধিরা যুক্তিতে হেরে যান। ফলে পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। তথ্যপ্রমাণ না থাকায় দুদক বিশ্বব্যাংকের নির্দেশ প্রতিপালনে অস্বীকৃতি জানায় মূলত মো. সাহাবুদ্দিনের অনড় দৃঢ় অবস্থানের কারণেই। এ সময় প্রধানমন্ত্রী জাতীয় সংসদে নিজেদের অর্থে পদ্মা সেতুর ঘোষণা দেন। এ ঘোষণা ছিল আবেগের, আনন্দের। কিন্তু বাস্তবে এটি ছিল এক অভাবনীয় চ্যালেঞ্জের। অসম্ভবকে সম্ভব করার এক দুর্গম পথ পাড়ি দেওয়া। কিন্তু বাংলাদেশ হারে না। শেখ হাসিনাও হারেননি। পদ্মা সেতু আজ বাস্তবতা। বাংলাদেশের সক্ষমতা এবং গৌরবের প্রতীক। আমাদের আত্মমর্যাদার স্মারক।

পদ্মা সেতু নির্মাণের কাজ যখন অর্ধেকের বেশি, তখন প্রথম সুখবর আসে কানাডা থেকে। পদ্মা সেতুর কল্পিত দুর্নীতির ঘটনা নিয়ে মামলা হয়েছিল কানাডার ফেডারেল আদালতে। কানাডার আদালত এ মামলার রায়ে পদ্মা সেতু নিয়ে দুর্নীতিকে কল্পকাহিনি হিসেবে আখ্যা দেন। আদালত দুর্নীতির অভিযোগ খারিজ করে একে ‘আষাঢ়ে গল্প’ বলে মন্তব্য করেন। বাংলাদেশ এবং শেখ হাসিনার সামনে পদ্মা সেতু নিয়ে দুটি চ্যালেঞ্জ ছিল। প্রথমত, পদ্মা সেতুতে কোনো দুর্নীতি হয়নি এটা প্রমাণ করা। দ্বিতীয়ত, নিজেদের সক্ষমতা প্রমাণ করে পদ্মা সেতু নির্মাণ। প্রথম চ্যালেঞ্জে শেখ হাসিনা জয়ী হন, পদ্মা সেতু নির্মাণ সমাপ্তির আগেই। আর পদ্মা সেতু নির্মাণের পর তিনি বিশ্বব্যাংকের অপমানের মধুর প্রতিশোধ নিলেন ১ মে। বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধু এবং তাজউদ্দীন আহমদের অনুসৃত তিনি অনুসরণ করেছেন। তিনি যেমন বাংলাদেশের মর্যাদার সুরক্ষা করেছেন, বিশ্বব্যাংকের অন্যায় অভিযোগ মানেননি; ঠিক তেমনি সম্পর্ক এগিয়েও নিয়ে গেছেন। ওয়াশিংটনে অবস্থানকালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ভয়েস অব আমেরিকার শতরূপা বড়ুয়াকে এক দীর্ঘ সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। ওই সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী বিশ্বব্যাংক প্রসঙ্গে বেশ কিছু খোলামেলা কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, বিশ্বব্যাংকের কাছে আমরা ভিক্ষা বা খয়রাত নিই না। ঋণ নিই। এ ঋণের টাকা আমরা সুদসহ পরিশোধ করি। ওই সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘পদ্মা সেতু নিয়ে বিশ্বব্যাংক যখন দুর্নীতির অভিযোগ আনে, তখন ওই অভিযোগটা আমি চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছিলাম।’ তিনি বলেন, ‘বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ আমি গ্রহণ করিনি। নীতিগতভাবে আমি গ্রহণ করতে পারি না। আমি তখন বিশ্বব্যাংককে চ্যালেঞ্জ দিলাম, আমাকে প্রমাণ দিতে হবে যে দুর্নীতি হয়েছে। তারা অনেক চেষ্টা করেও সেটা প্রমাণ করতে পারেনি।’ একই বক্তব্য সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানেও দেন শেখ হাসিনা। সাধারণ মানের রাজনীতিবিদ হলে এখান থেকেই হয়তো বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটত। বিশ্বব্যাংকের সহায়তা নেওয়াও সস্তা আবেগে বন্ধ হয়ে যেত। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একজন দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক। তাঁর রাজনৈতিক কৌশল ভিন্ন। তিনি বিশ্বব্যাংককে ভুল প্রমাণ করে সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে গেলেন। বিশ্বব্যাংকের কাছে সম্মান এবং সমীহ আদায় করে ৫০ বছরের সম্পর্ক উৎসবকে রঙিন করে তুললেন। মাথা উঁচু করে এ সম্পর্কের ধারা এবং নীতি শুরু করেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর ঘনিষ্ঠ সহচর বাংলাদেশের প্রথম অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। কিন্তু ’৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর আমরা আস্তে আস্তে নতজানু নীতি গ্রহণ করি। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফকে আমরা প্রভু ভাবতে শুরু করি। জনসম্পৃক্তহীন সরকারগুলো ঋণনির্ভর এক অর্থনীতির অন্ধকার গহ্বরে বাংলাদেশকে নিয়ে যায়। সামরিক একনায়করা বিশ্বব্যাংক, আইএমএফসহ দাতাদের একান্ত অনুগত ব্যক্তিদের অর্থমন্ত্রী বা অর্থ উপদেষ্টা বানানো শুরু করেন। জনগণের কাছে নয় বরং বার্ষিক ভিত্তিতে দাতাদের কাছে জবাবদিহিতার সংস্কৃতি চালু হয়। দাতাদের কনসোর্টিয়াম তৈরি করা হয়। সেখানে বার্ষিক সভায় একান্ত ভৃত্যের মতো আমাদের অর্থমন্ত্রী এবং সরকারি কর্মকর্তারা উপস্থিত হওয়ার রেওয়াজ চালু হয়। দাতাদের প্রশ্নবাণে জর্জরিত হয়ে করজোড়ে ক্ষমা ভিক্ষা করতেন আমাদের কর্তারা। কতটা নতজানু হলো তার ওপর নির্ভর করত ভিক্ষা কতটুক জুটবে। এই ভিক্ষার টাকা না এলে বাজেট করতে পারত না বাংলাদেশ। ’৭৫-পরবর্তী সময়ে বিশ্বব্যাংকসহ দাতা দেশ ও সংস্থাগুলো কী আচরণ করত বোঝার জন্য ড. আকবর আলি খানের ‘পরার্থপরতার অর্থনীতি’ গ্রন্থে ‘মোল্লা নস্্রুদ্দীনের অর্থনীতি’ শিরোনামে প্রবন্ধের খানিকটা স্মরণ করা যেতে পারে। ‘মোল্লা বিশ্বব্যাংক বা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল না দেখলেও অনেক মহাজন দেখেছেন। মহাজনদের আচরণ জানতে পারলেই এ দুটো প্রতিষ্ঠানের নিয়মনীতি আঁচ করা সম্ভব। এ প্রসঙ্গে মোল্লার একটি কাহিনি মনে পড়ছে। কথিত আছে মোল্লা নস্্রুদ্দীনের একটি হাতি দেখে খুবই পছন্দ হয়। তিনি হাতিটি কেনার অর্থ সংগ্রহের জন্য মহাজনের দোরে গিয়ে হাজির হলেন। মোল্লা মহাজনকে বললেন, আমাকে কিছু টাকা ধার দিন। মহাজন বললেন, কেন? মোল্লা জবাব দিলেন, আমি একটি হাতি কিনতে চাই। মহাজন প্রশ্ন করলেন, তোমার যদি টাকা না থাকে তুমি হাতি পালবে কী করে? মোল্লা আক্ষেপ করে বললেন, আমি আপনার কাছে টাকার জন্য এসেছি, উপদেশের জন্য নয়।’

মোল্লা মহাজনের কাছে আক্ষেপ করতে পারতেন। কিন্তু নব্য মহাজন বিশ্বব্যাংক বা দাতা সংস্থার কাছে অগণতান্ত্রিক সরকারগুলো আক্ষেপ করতেও ভয় পেত। পাছে সাহায্য বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৭৫ থেকে ’৯৬ পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশের অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি নির্ধারিত হতো দাতাদের নির্দেশে। জনগণের চাহিদার কথা বিবেচনা করে উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হতো না। উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হতো দাতাদের পছন্দে। ’৭৫ থেকে ’৯৬ পর্যন্ত দাতাদের সহযোগিতায় গৃহীত প্রকল্পের অধিকাংশই জনবিচ্ছিন্ন। এসব প্রকল্পে জনগণের উপকার হয়েছে সামান্যই। অবশ্য আমলা ও লুটেরা রাজনীতিবিদদের পকেট ভর্তি হয়েছে ভালোভাবেই। এ সময় বাড়তে থাকে শর্তের পরিধিও। ড. আলি তাঁর ‘মোল্লা নস্রুদ্দীনের অর্থনীতি’ নিবন্ধে এই শর্তের বেড়াজাল উল্লেখ করেছেন এভাবে : ‘আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো একটি নতুন দাওয়াই আবিষ্কার করেছে। তারা এর নাম দিয়েছে প্রাক-কর্মসূচি শর্তনির্ভরশীলতা (upfront conditionality) অর্থাৎ আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলোচনা করে সম্মত কর্মসূচি গ্রহণের আগেই এ ধরনের শর্ত পালন করতে হয়। অবশ্য এ ধরনের শর্তনির্ভরশীলতা আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো আবিষ্কার করেনি। এ ধরনের ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা ত্রয়োদশ শতাব্দীতেই মোল্লা সাহেব চিন্তা করে গেছেন। মোল্লা একবার একটি ছোট ছেলেকে একটি পাত্রে কুয়ো থেকে পানি তুলে আনতে বলেন। ছেলেটির হাতে পাত্রটি তুলে তিনি চিৎকার করে বললেন, খেয়াল রেখো পাত্রটি যাতে কোনোমতেই না ভাঙে’ এবং তার পরই ছেলেটিকে থাপ্পড় মারলেন। ঘটনার সময় অন্য এক ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন। তিনি মোল্লার কাছে জানতে চাইলেন, মোল্লা কেন বিনা কারণে ছেলেটিকে আঘাত করলেন। মোল্লা বললেন, আহাম্মক, তুমি বুঝতে পারছ না, পাত্রটি ভাঙার পর ছেলেটিকে শাস্তি দিয়ে কোনো লাভ হবে না। কাজেই আগে শাস্তি দিলাম।’ মোল্লার মতো আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো পাত্র ভাঙার জন্য অপেক্ষা করতে রাজি নয়, তারা আগেই স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে থাপ্পড় মারে। থাপ্পড় খেয়ে খেয়েই ক্ষমতায় থাকার নিরন্তর চেষ্টায় সবকিছু বিসর্জনের ধারা চলে সামরিক জান্তাদের শাসনামলে। শুধু অর্থনীতি নয়, রাজনীতিরও নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠে দাতারা। কৃষিতে ভর্তুকি দেওয়া যাবে না, আদমজী পাটকল বন্ধ করে দিতে হবে, এ ধরনের দাতা নির্দেশনা মানতে বাধ্য হন সরকারপ্রধানরা। না হলে গদি হারানোর ভয়। এখান থেকেই ঘুরে দাঁড়ায় বাংলাদেশ। ১৯৯৬ সালে দীর্ঘ ২১ বছর পর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। সরকার গঠনের পর বিশ্বব্যাংক কৃষিতে ভর্তুকি প্রত্যাহারের পরামর্শ দেয় নতুন সরকারকে। কিন্তু শেখ হাসিনা সেই পরামর্শ অগ্রাহ্য করেন। শুরু করেন কৃষি ভর্তুকি। সেই ভর্তুকির কারণেই আজ বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। শেখ হাসিনা বুঝতে পেরেছিলেন যতক্ষণ পর্যন্ত বিদেশি সাহায্যের ওপর নির্ভরশীলতা থাকবে, ততদিন দাতাদের খবরদারি উপেক্ষা করা যাবে না। তাই তিনি স্বনির্ভর অর্থনীতির ওপর গুরুত্ব দেন। বাজেটে বিদেশি সহায়তা ও ঋণ হ্রাসের জন্য কাজ শুরু করেন। ২০০৯ থেকে ধাপে ধাপে বাংলাদেশ নিজস্ব অর্থায়নে বাজেট প্রণয়নের দিকে এগিয়েছে। ফলে এখন দাতাদের আর প্রভু মনে করা হয় না। তবে বাংলাদেশের আত্মমর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠার টার্নিং পয়েন্ট পদ্মা সেতু। পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের অর্থ ফিরিয়ে দেওয়ার সাহস সঞ্চালিত হয়েছে সর্বত্র। পদ্মা সেতুর ঘটনার আগে বিশ্বব্যাংক এবং দাতাদের ভয় সরকারের সর্বত্র ছিল। আমার মনে আছে, ২০০৯ সালে তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এলেন বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্তরের একজন পরামর্শক। তিনি বাঙালি। কিন্তু মন্ত্রণালয়ে তাঁর আগমন উপলক্ষে সাজসাজ রব। আতঙ্কে স্বয়ং স্বাস্থ্যমন্ত্রী। তিনি বিশ্বব্যাংকের পরামর্শক, স্বাস্থ্য অধিদফতরের কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নালিশ করলেন। মন্ত্রণালয় মুহূর্তের মধ্যে তাদের ওএসডি করল। বিশ্বব্যাংকের ওই কর্মকর্তা যেন মন্ত্রীর চেয়েও ক্ষমতাবান। পদ্মা সেতুর ঘটনার পর সম্পূর্ণ বিপরীত দৃশ্য দেখলাম একই মন্ত্রণালয়ে। করোনা মোকাবিলায় সীমাহীন ব্যর্থতার পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে ব্যাপক পরিবর্তন আনেন। বিতর্কিত সচিবকে বাদ দিয়ে নতুন সচিব করা হয় মো. আবদুল মান্নানকে। তাঁর কক্ষে একদিন হঠাৎ উঁকি মারতেই দেখি বিশ্বব্যাংকের কয়েকজন প্রতিনিধি। সঙ্গে সেই পরামর্শক যাকে নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় রীতিমতো আতঙ্কে থাকত। গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক ভেবে আমি বেরিয়ে যাচ্ছি, এ সময় সচিব নিজেই আমাকে ডাকলেন। সোফায় বসতে বললেন। শুনলাম স্বাস্থ্যসেবা সচিবের কণ্ঠে শেখ হাসিনার কণ্ঠের প্রতিধ্বনি। তিনি বলছিলেন, ‘বিশ্বব্যাংক আমাদের উন্নয়ন অংশীদার। আপনাদের প্রস্তাব যদি দেশের স্বার্থে হয় আমরা বিবেচনা করব। দেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে হলে আমরা দুঃখিত।’

২০১৮ সালে বাংলাদেশের প্রাণিসম্পদ খাতে সবচেয়ে বড় ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন করে বিশ্বব্যাংক। ‘লাইভস্টক অ্যান্ড ডেইরি ডেভেলপমেন্ট’ প্রকল্পে বিশ্বব্যাংক ৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ অনুমোদন করে। এ প্রকল্পের উদ্যোক্তা ডা. গোলাম রব্বানী। মেধাবী, পরিশ্রমী দেশপ্রেমিক একজন সরকারি কর্মকর্তা। তিনি এ প্রকল্পের মুখ্য কারিগরি কর্মকর্তা। তিনি আমাকে বলছিলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাদের সাহসের পরিধি বাড়িয়েছেন। এখন বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে বৈঠকে তারা কিছু চাপিয়ে দিলে আমরা তাদের পদ্মা সেতুর কথা বলি।’ দাতারা প্রভু নয় পার্টনার। পদ্মা সেতু বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিককে এ উপলব্ধি নতুন করে শিখিয়েছে। আর বিশ্বব্যাংকের বিদায়ী প্রেসিডেন্ট ডেভিড ম্যালপাসকে পদ্মা সেতুর ছবি উপহার দিয়ে শেখ হাসিনা সমমর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করলেন। যে সমমর্যাদা ও আত্মসম্মানের সম্পর্কের সূচনা করেছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ।

লেখক : নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত

[email protected]

সর্বশেষ খবর