সোমবার, ৮ মে, ২০২৩ ০০:০০ টা

ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী

ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না

জীবনে এমনও সময় আসতে পারে, যখন সারা পৃথিবী একদিকে আর তুমি আরেকদিকে। যদি নিজের বিশ্বাসকে সত্য বলে মনে কর তবে তুমি সে সত্যকে আঁকড়ে ধরে একাই লড়ে যাও। মনস্তত্ত্ব বলছে, বেশির ভাগ মানুষ সত্যের চেয়ে সংখ্যাকে বেশি প্রাধান্য দিতে গিয়ে মিথ্যার দিকে ঝুঁকে পড়ে। স্রোতের বিপরীতে মানুষ যেতে ভয় পায়, সাহসী মানুষরাই স্রোতের বিপরীতে যাওয়ার সাহস দেখায়। কাপুরুষরা প্রতিদিন মরে, সাহসীদের প্রতিদিন নতুন করে জন্ম হয়।

খুব কঠিন একটা সময় হয়তো তুমি অতিক্রম করছ। সময় যখন কঠিন হয় তখন প্রতিটি মুহূর্ত যেন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়। সারা পৃথিবীর মানুষ তোমাকে তাদের পৃথিবী থেকে বিতাড়িত করেছে। সবাই তোমার বিপক্ষে কথা বলছে। এক একটা আঘাত এসে তোমার দেহকে ক্ষত-বিক্ষত করছে, সে আঘাত তোমার মনের ভিতরে লালিত তোমার আজন্ম সত্যের ওপরও হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ছে। এমন বিপন্ন দিনেও তোমার মনোবলকে ভাঙতে দিও না। মনে রেখ, তাদের পৃথিবী তোমার জন্য নিষিদ্ধ হলেও তোমার পৃথিবীর তুমিই রাজা। পথ যত কঠিন হয় মানুষ তত নতুন নতুন পথের সন্ধান পায়। স্বার্থের দরজা-জানালাগুলো যতই বন্ধ হয়, নিজের চিন্তার দরজা-জানালাগুলো ততই খুলতে খুলতে মহাবিশ্বের মহাবিস্ময় হয়।

খুব চেনা মুখগুলো অচেনা হতে দেখছ তুমি। মানুষের রং বদলানো মুখের মুখোশটা তোমাকে বুঝিয়ে দিচ্ছে, মানুষ সুসময়ের বন্ধু হয়, দুঃসময়ে ছেড়ে চলে যায়। আপনজনরাও কত সহজে বন্ধন ভেঙে ভেঙে পর হয়ে যাচ্ছে তোমার। মানুষের এই সুবিধাবাদিতা তোমাকে চিৎকার করে বলছে, সব রঙ্গমঞ্চের খেলা, সব অভিনয়, পৃথিবীতে আপন কেউ কারও নয়। তখনো তোমার আত্মবিশ্বাসটা তুমি ধরে রেখ। তোমার মানুষের প্রতি বিশ্বাসকেও ভেঙে ফেল না। এই প্রতিকূল সময়টা না এলে তুমি যে মানুষ চিনতে পারতে না। মনে রেখ তুমি একটা জাদুর আয়না পেয়েছ, যে আয়না তোমাকে মানুষের ভিতরের আর বাইরের লুকানো মুখগুলো চেনার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। তুমি তোমার সঙ্গে আছ, তোমার চিন্তাশক্তি তোমার সঙ্গে আছে এর যে বড় আর কিছু হতে পারে না।

পৃথিবীতে যত ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে, সে ইতিবাচক পরিবর্তনে বেশির ভাগ সময়ে মানুষকে একাই লড়তে হয়েছে। ইতিহাস সেই কথায় বলছে। মনে পড়ছে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কথা, রাজা রামমোহন রায়ের কথা, হেমলক পানে সক্রেটিসের মৃত্যুর কথা, রোমের রাজপথে জিওর্দানো ব্রুনোকে পুড়িয়ে মারার কথা। এমন অনেক উদাহরণ হয়তো দেওয়া যেতে পারে, দেওয়া যায়। কেউ সত্যের জন্য সারা পৃথিবীর সঙ্গে আজীবন লড়েছেন, কেউ কেউ সত্যকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য মৃত্যুদন্ডকে বেছে নিয়েছেন। হয়তো মিথ্যাকে মেনে নিলে তারা বেঁচে যেতেন, কিন্তু সত্য যে চিরকালের জন্য মরে যেত। দেহের মৃত্যু আছে, মনের মৃত্যু নেই, সত্যের মৃত্যু নেই। ভীরু ও কাপুরুষরা সত্যকে মরতে দেয়, সাহসী ও মহাপুরুষরা নিজের জীবন দিয়ে সত্যকে বাঁচিয়ে রাখেন। যারা একাই লড়েছেন তারা ইতিহাসে আজও বেঁচে আছেন, তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো সে সময়ের মানুষদের ইতিহাসে জায়গা হয়নি। ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না, যেমন প্রকৃতির বিচার কেউ উপেক্ষা করতে পারে না। তার চেয়েও সত্য বচন হলো, পাপ বাপকেও ছাড়ে না।

২. একটা মানুষ হারছে। একটার পর একটা পরাজয়ের গ্লানি তাকে মাথা পেতে নিতে হচ্ছে। তারপরও মানুষটা হাসছে। কারণ, সে পরাজয়কে ইতিবাচকভাবে দেখার মতো মানসিকতা গড়ে তুলতে পেরেছে। পরাজয় এক ধরনের অভিজ্ঞতা, যা মানুষকে প্রতিকূলতার সঙ্গে খাপখাইয়ে নেওয়ার শক্তি জোগায়। পরাজিত মানুষ কখনো হাল ছাড়ে না, জয়ের স্বপ্ন সব সময় তার মধ্যে বেঁচে থাকে। সে জানে এভাবে হারতে হারতে একদিন সে জয়ের মুখ দেখবে।

পরাজয় কখনো কখনো ত্যাগ হয়, যখন একটা মানুষ স্বেচ্ছায় হেরে অন্যদের জিতিয়ে দেয়। মানুষ পরাজিত হয় বলেই দুঃসময়কে চিনতে পারে। সুসময়ের বন্ধুদের মুখগুলো তার কাছে আরও উজ্জ্বল হয়ে ধরা দেয়। যে মানুষটা হারে, সে জানে সারা পৃথিবী যখন জয়ের আনন্দে উৎসবে মেতে উঠবে তখন তার নিজের পৃথিবীর আনন্দটা ঘুম ভেঙে জেগে উঠবে। যে পৃথিবীটা তার নিজের, সে পৃথিবীর রাজা সে একা। মানুষ যখন একা হয়ে যায় তখন এটাই তার শক্তি হয়ে ওঠে। পৃথিবীর ইতিহাস বলছে, অনেক মানুষের মিলিত শক্তি যা পারেনি, একাকিত্বের শক্তি তাই পেরেছে। পরাজয় মানুষকে বদলে দেয়, বদলে যাওয়া মানুষটাই পারে পৃথিবীর ইতিহাস বদলে দিতে। মানুষ পরাজিত হলে চেনা মুখগুলো অচেনা হয়ে তাকে আঘাতে আঘাতে জর্জরিত করতে কুণ্ঠিত হয় না। কিন্তু মানুষ আঘাত পেলেই তার মধ্যে ইতিবাচক প্রতিঘাতের শক্তির সন্ধান পায়। এক একটা নির্দয় আঘাত এক একটা অমিত শক্তির উৎস হয়ে ওঠে।

পরাজয় মানুষকে জ্ঞানী বানায়, বিনীত হতে শেখায়, ছোটত্বের বোঝা মাথায় নিয়ে মাটির গভীরে শক্ত শেকড়ের সন্ধান দেয়। মানুষটা হারছে বলে সে অনেক মানুষের বিজয়ের পথ তৈরি করে দেয়। পরাজিত মানুষ জানে এই পরাজয় তার নয়, এই পরাজয় সেই পৃথিবীর যারা যোগ্যদের জায়গাগুলো কেড়ে নিয়ে অযোগ্যদের মাথায় তুলে নাচে। পরাজয় মানুষকে কাঁদতে শেখায়, কান্না লুকিয়ে হাসতে শেখায়। পরাজয় একটা আগুনে পোড়া বইয়ের মতো, যেখানে অনেক দুর্লভ সত্য আত্মগোপন করে থাকে। যারা তার সন্ধান পায়, তারাই জীবনের প্রকৃত রহস্য উদঘাটন করতে পারে।

জয় একটা শব্দ মাত্র, জয় মানুষকে কখনো কখনো থামিয়ে দেয়। যে মানুষ কেবল জিততেই শিখে সে মানুষের ভিতরে সব সময় হারানোর ভয় কাজ করে। পরাজয় কোনো শব্দ নয়, পরাজয় মানুষের ভিতরের চুপ করে বসে থাকা এক নির্বাক আহ্বান। যা একদিন সব অচলায়তন ভেঙে আলোর উৎসবে পরিণত হয়। সেই আলোতে যে ছায়াটা থাকে, মানুষটা সে ছায়াটাকে তার ছায়া বলে বিশ্বাস করে না, কারণ মানুষের সঙ্গে আলোতে চলা ছায়াটা অন্ধকারে বিশ্বাসঘাতক হয়ে হারিয়ে যায়। যা হারিয়ে যায় তা হারিয়ে যাওয়ায় ভালো, সেটাকে খুঁজতে গিয়ে নিজের অকৃত্রিম সত্তাকে হারিয়ে না ফেলাটাই সবচেয়ে ভালো। সবচেয়ে বড় কথা, মানুষকে পরাজিত করা যায়, ধ্বংস করা যায় না।

৩. রোমান সম্রাট নিরোর কথা মনে পড়ছে। নিরোকে নিয়ে সবচেয়ে প্রচলিত কথাটি হলো-রোম যখন পুড়ছিল, নিরো তখন বাঁশি বাজাচ্ছিল। এটা সত্য না মিথ্যা ছিল, সে বিচারের ভার সময়ের হাতে। কারণ সময় সর্বদাই বেঁচে থাকে, কিন্তু মানুষ সময়ের গর্ভে হারিয়ে যায়। এই নিরোর ভিতরে একজন শিল্পী বাস করত। কিন্তু নিরোর বাইরের মানুষটা ক্ষমতার লোভকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে তার ভিতরের সৃজনশীল মানুষটাকে হত্যা করেছিল। অথচ ক্ষমতার চেয়ে সৃজনশীলতার মূল্য অনেক বেশি। ক্ষমতা তাসের ঘরের মতো ভেঙে যায়, সৃজনশীলতা বেঁচে থাকে যুগ থেকে যুগান্তরে। এত সহজ একটা অঙ্কের হিসাব মানুষ সময় থাকতে বোঝে না। যখন বোঝে তখন করার আর কিছুই থাকে না। সব যে সময়ের খেলা। সময় কারও জন্য বসে থাকে না।

রোমান সম্রাট নিরো ইতিহাসের সবচেয়ে নির্মম ও পাগলাটে ধাঁচের শাসক ছিলেন। কথিত আছে, নিরোর মা নিরোকে ক্ষমতায় বসালেও তিনি তার মাকে হত্যা করেন। ক্ষমতার উন্মত্ততায় নিরোর হত্যার শিকার হয়েছেন তার সৎভাই ও স্ত্রীরা।

বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ওপর তার দমন-পীড়নের কাহিনি এখনো মানুষের মুখে মুখে। একটা আবেগতাড়িত শিল্পমনস্কতা তার মধ্যে বিদ্যমান ছিল। নিরো থিয়েটার করতে খুব পছন্দ করতেন। তিনি বীণা জাতীয় বিশেষ একটি বাদ্যযন্ত্র বাজাতেন, গান গাইতেন, কবিতা লিখতেন এবং মঞ্চে অভিনয়ও করতেন। সম্রাট নিরোর শাসনকালের প্রথম পাঁচ বছর তার জনপ্রিয়তা ছিল ঈর্ষণীয়। এ সময়টা রোমান জনগণের জন্য ‘স্বর্ণযুগ’ হিসেবে বিবেচনা করা হতো। সময় তাকে মানুষের রাজা বানিয়েছিল। সময়ের ভয়ংকর নিষ্ঠুরতা আবার তাকে পথের মাটিতে ছুড়ে মেরেছে।

এটা তো সময়ের খেলা, সময়ের নাটক। সেনাবাহিনী ও সিনেট তাকে ‘জনগণের শত্রু’ হিসেবে ঘোষণা করে। নিরোকে যেখানেই পাওয়া যাবে, সেখানেই হত্যা করার আদেশ জারি হয়। বিশাল রাজপ্রাসাদে থাকা সম্রাট নিরো গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে পালিয়ে বেড়াতে থাকেন। কিন্তু সেটা আর কতক্ষণ? রক্ষীরা তার গন্তব্যের খোঁজ পেয়ে যখন অগ্রসর হচ্ছিল, তখন তিনি আত্মহত্যা করেন।

মৃত্যুর আগে তিনি ‘কোয়ালিস আর্টিফেক্স পেরেও’ বলে চিৎকার করছিলেন। কী অদ্ভুত! সময় যেটা তাকে উচ্চারণ করতে প্ররোচিত করেছিল, সেটার অর্থ ছিল বহুমাত্রিক। তবে এর মধ্যে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য অর্থ হিসেবে যা বিবেচনা করা হয়, তা হলো- ‘আমার মৃত্যুর সময়ে আমি কী দারুণ এক শিল্পী’ অথবা ‘আমার সঙ্গে কী এক শিল্পীর মৃত্যু হচ্ছে’। আহা, আহারে জীবন। হয়তো জীবনের অন্তিম সময়ে ভিতরের মানুষটাকে পাওয়ার তীব্র বাসনা তার মধ্যে সক্রিয় হয়ে উঠেছিল। কিন্তু তখন যে সব শেষ। শেষের পরে আবার কি নতুন করে শুরু হতে পারে জীবনের গল্প?... শীতের সকালে তীব্র ঠান্ডায় জমে যাওয়া শরীরটা সূর্যের উত্তাপকে টেনে নেয় অথচ প্রচন্ড গরমে সূর্যকে মানুষ ভুলে যায়। সূর্য নিজে পুড়ে, মানুষও পুড়ে, ইতিহাসও পুড়ে। তবে অদ্ভুত এক শহরে দেখা মেলে পোড় খাওয়া একটা মানুষের, যে মানুষটার নামও নিরো।  কিন্তু সে যে অন্য এক নিরো, যে বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে গান ধরে, ছেঁড়া কাগজে কবিতা লিখে, ভাঙাচোরা মঞ্চ কাঁপিয়ে অভিনয় করে। আমাদের তরুণরা কি পারবে সে নতুন জীবনের গল্প লিখতে, যেখানে সময়ের পেছনে তরুণরা ছুটবে না, সময় ছুটবে তরুণদের পেছনে।

লেখক : শিক্ষাবিদ, কলামিস্ট, ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর

সর্বশেষ খবর