শনিবার, ১০ জুন, ২০২৩ ০০:০০ টা

কৃষকের স্বার্থ রক্ষিত হলে বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা গতিশীল হবে

প্রিন্সিপাল এম এইচ খান মঞ্জু

কৃষকের স্বার্থ রক্ষিত হলে বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা গতিশীল হবে

বাংলাদেশে কর্মসংস্থানের সবচেয়ে বড় খাত হচ্ছে কৃষি। দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দারিদ্র্য দূরীকরণ, মানবসম্পদ উন্নয়ন এবং খাদ্য নিরাপত্তায় এ খাতের ভূমিকা অনস্বীকার্য। বাংলাদেশের জনগণের একটা বিশাল অংশ তাদের জীবনধারণের জন্য কৃষির ওপর নির্ভর করে। দেশের মোট শ্রমশক্তির ৪২.৬২ শতাংশ কৃষি ক্ষেত্রে নিয়োজিত। বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ হলেও কৃষি উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত কৃষকরা এখনো সমাজে অবহেলিত। যারা খাদ্য উৎপাদন করে তারা যদি ন্যায্যমূল্য না পান তাহলে কৃষি বাঁচবে না। শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বাংলাদেশের কৃষিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মূল দায়িত্ব পালন করছেন আমাদের কৃষকরা। কৃষিবিদরা যথাসম্ভব তাদের সহায়তা করছেন। আর এ কৃষিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে নীতিনির্ধারকদের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা কৃষকের পণ্যের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি কীভাবে নিশ্চিত করা যায় সে বিষয়টি নীতিনির্ধারকদের খুবই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে।

এবার বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। এটা কৃষক ও দেশের জন্য সুখবর। অন্যান্যবার আগাম বন্যা ও নানা কারণে বোরোর ক্ষতি হয়। কৃষক কাক্সিক্ষত উৎপাদন থেকে বঞ্চিত হয়। এবার তা হয়নি। ধানের আবাদ-উৎপাদন ভালো হলে শুধু কৃষকের মুখে হাসি ফোটে না, বরং জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তাও মজবুতি অর্জন করে। তবে অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, এখনো কৃষকের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিত হয়নি। এবার আগের তুলনায় ধান উৎপাদনে খরচ বেশি পড়েছে। বীজ, সার, কীটনাশক, সেচ, শ্রমিক মজুরি প্রভৃতি প্রতিটি ক্ষেত্রেই বাড়তি খরচ গুনতে হয়েছে। প্রতি মণ ধান উৎপাদনে কৃষকের খরচ হয়েছে কমপক্ষে ১ হাজার ১৫০ টাকা। অথচ এক মণ মোটা ধান বিক্রি করে তারা পাচ্ছেন বড়জোর ৯০০ থেকে ১ হাজার টাকা এবং সরু ধান ১ হাজার ১০০ টাকা। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ধান উৎপাদন করার পর যদি উৎপাদন খরচ পর্যন্ত না ওঠে তবে এর চেয়ে হতাশা ও বঞ্চনা আর কিছুই হতে পারে না। কৃষক উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য পান না। সে ধান, পাট, আখই হোক কিংবা হোক তরিতরকারি বা অন্য কিছু। পাট ও আখের ন্যায্যমূল্য না পেয়ে তা খেতেই রেখে দেওয়া অথবা পুড়িয়ে ফেলার দুঃখজনক ঘটনা আমাদের দেশে ঘটেছে। টমেটো, কপি, তরমুজ ইত্যাদি ফেলে দেওয়া বা গো-খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করার কথাও আমরা জেনেছি।

কৃষক যে ফসলের উপযুক্ত মূল্য পান না, সে ফসল উৎপাদন থেকে সরে আসেন। কৃষকরা তাদের পরিবার-পরিজনের খাদ্য সংস্থানের জন্যই বাধ্য হন ধান উৎপাদনে। তা ছাড়া দেশের কোনো কোনো এলাকায় বা জমিতে ধান ছাড়া অন্য ফসল উৎপাদন করার সুযোগ নেই। যেমন হাওর এলাকায় বছরের একমাত্র ফসল বোরো ধান উৎপাদন ছাড়া অন্য কোনো ফসল উৎপাদন করা সম্ভব হয় না। ধানের ন্যায্যমূল্য না পেয়ে কৃষক আবাদ ছেড়ে না দিলেও কমিয়ে দেন। বিভিন্ন বছরের আবাদ-উৎপাদনের তুলনামূলক পরিসংখ্যানে তার প্রমাণ পাওয়া যায়।

এখন ব্যবসায়ী ও মিলারদের কাছ থেকেই মূলত সরকার ধান-চাল কেনে। এ ব্যবস্থার ফলে কৃষক নয়, ধান-চালের ব্যাপারে ব্যবসায়ী ও মিলাররাই সর্বোচ্চ প্রাধান্যে এসেছেন। তারা কৃষকদের কাছ থেকে কম দামে ধান কিনে সরকার নির্ধারিত দামে সরকারের কাছে বিক্রি করে। তাই হতাশ ও বঞ্চিত কৃষক ধানের আবাদ কমিয়ে দিলে আগামীতে চালের মূল্য ও খাদ্য নিরাপত্তার ওপর তার অনিবার্য বিরূপ প্রভাব পড়বে।

কৃষকদের জন্য উৎপাদিত ধান ও অন্যান্য খাদ্যশস্যের মূল্য নির্ধারণ ও তার প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে। যাতে তারা সন্তুষ্ট ও উৎসাহিত হয়। সহজে কৃষকের কাছ থেকে ধান কেনার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক। কৃষকের মুখে হাসি ফোটাতে, গরিব-দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে কাজ করতে হবে। আমরা যদি কৃষকদের মূল্যায়ন করি তবেই আমরা সফল হতে পারব, খাদ্য সংকট মোকাবিলায়।

তবে আশার খবর হচ্ছে, দেশের কৃষিব্যবস্থায় যান্ত্রিকীকরণ প্রক্রিয়া অর্থনীতিতে বড় সম্ভাবনার হাতছানি দিচ্ছে। কৃষিতে যন্ত্রপাতি ব্যবহারের ফলে উৎপাদন বৃদ্ধি, ফসল সংগ্রহোত্তর অপচয় হ্রাস, শস্যের নিবিড়তা বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাফল্য পেতে শুরু করেছে কৃষক।

জলবায়ু পরিবর্তন তথা বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দায় খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আধুনিকায়ন ও যান্ত্রিকীকরণের কোনো বিকল্প নেই। দেশে কম্বাইন হারভেস্টারসহ রাইস ট্রান্সপ্লান্টার, সিডার ও রিপার মেশিনের ব্যবহার বাড়ছে। স্থানীয় পর্যায়ে ট্রান্সপ্লান্টার ব্যবহার উপযোগী ধানের চারা উৎপাদনে উদ্যোক্তা তৈরিতে সাহায্য করছে। কৃষি আমাদের জাতীয় অর্থনীতির জীবনীশক্তি।

পরিশেষে বলছি, বছরব্যাপী ফল উৎপাদন বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে কলা, পেঁপে, থাই পেয়ারা, আপেল কুল চাষ বেড়েছে। আউশ ও রোপা আমন চাষে সরকার কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। ব্যবসায়িক ভিত্তিতে কৃষি খামার স্থাপন, খামার যান্ত্রিকীকরণ বর্তমান কৃষিকে একটি টেকসই ও সমৃদ্ধ অবস্থানে নিয়ে যাবে। কৃষি, কৃষক ও শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষিত হলে বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা আরও গতিশীল হবে।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য ও প্রাক্তন প্রিন্সিপাল এম এইচ খান ডিগ্রি কলেজ, গোপালগঞ্জ

সর্বশেষ খবর