আরবি পঞ্জিকার সর্বশেষ মাস জিলহজ। ইসলামে যে চার মাসকে বিশেষ মর্যাদাসম্পন্ন বলা হয়েছে, এর মধ্যে শ্রেষ্ঠ মাস এটি। আর এ মাসের সবচেয়ে ফজিলতপূর্ণ সময় হলো ‘আশারায়ে জিলহজ’ তথা জিলহজ মাসের প্রথম দশক। জিলহজ মাসের প্রথম দশকের মাহাত্ম্য ও গুরুত্ব অপরিসীম। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ কসম করে বলেন, শপথ ফজরের, শপথ দশ রাত্রির। (সুরা ফাজর (৮৯) : ১-২)। এখানে ‘দশ রাত্রি’ দ্বারা জিলহজের প্রথম দশ রাতের কথা বলা হয়েছে। এ দশ দিনের নেক আমল আল্লাহর কাছে অনেক প্রিয়। হাদিস শরিফে আছে, রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আল্লাহর কাছে জিলহজের দশ দিনের (নফল) নেক আমলের চেয়ে অধিক প্রিয় অন্য কোনো দিনের আমল নেই। (সহিহ বুখারি, হাদিস ৯৬৯)
জিলহজ মাসের ৮ থেকে ১৩ তারিখ পর্যন্ত হাজিরা হজ পালনে নিয়োজিত থাকেন। কিরান ও ইফরাদ হজযাত্রীরা মক্কা মুকাররমায় পৌঁছে ইহরাম অবস্থায় হজের অপেক্ষায় থাকেন। তামাত্তু হজযাত্রী হলে মক্কায় পৌঁছে ওমরাহর আহকাম শেষ করে ইহরামমুক্ত হবেন। এরপর মক্কা মুকাররমা থেকে মিনায় রওনা হওয়ার আগে হজের নিয়তে ইহরাম পরে নেবেন।
৮ জিলহজ : বাদ ফজর রওনা হবেন মক্কা মুকাররমা থেকে প্রায় ৫ কিলোমিটার পূর্ব-দক্ষিণে মিনায়। ৮ তারিখ জোহর থেকে ৯ তারিখ ফজর পর্যন্ত পরপর এ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ মিনায় পড়া সুন্নত। মিনায় রাতযাপন করাও সুন্নত।
৯ জিলহজ : বাদ ফজর মিনা থেকে রওনা হতে হবে প্রায় ৬ কিলোমিটার দক্ষিণে আরাফাতের উদ্দেশে। জোহর ও আসর নামাজ আরাফাতে পড়তে হবে। আরাফাতের মসজিদে নামিরায় জামাতে নামাজ পড়লে ইমামের পেছনে এক আজানে দুই ইকামতে পরপর দুই রাকাত করে দুই ওয়াক্তের চার রাকাত ফরজ নামাজ কসর (সুন্নত বাদে) করে পড়বেন। আর তাঁবুতে পড়লে যাঁর যাঁর মাজহাবের নিয়মে পড়বেন। ৯ জিলহজ সূর্য দুপুরে পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়া থেকে অস্ত যাওয়া পর্যন্ত আরাফাতে অবস্থান করা ফরজ। আরাফাত দোয়া কবুলের অন্যতম স্থান। যতটুকু পারা যায় আল্লাহর দরবারে দোয়া-দরুদ পাঠ ও কান্নাকাটি করা চাই। ৯ জিলহজ সূর্য অস্ত যাওয়ার পর আরাফাত থেকে প্রায় ৪ কিলোমিটার পশ্চিমে মুজদালিফার উদ্দেশে রওনা হতে হবে এবং মুজদালিফায় পৌঁছে মাগরিব ও এশার নামাজ এক আজানে দুই ইকামতে পরপর পড়তে হবে। তারপর মাগরিব ও এশার সুন্নত। মিনায় শয়তানের প্রতি নিক্ষেপ করার জন্য ৪৯টি পাথর সংগ্রহ করতে হবে মুজদালিফা থেকে। মুজদালিফায় অবস্থান ওয়াজিব। মুজদালিফায় ফজরের নামাজ পড়ে কিছুক্ষণ অবস্থান শেষে কিছুটা পশ্চিমে মিনার উদ্দেশে রওনা হতে হবে।
১০ জিলহজ : ১. মিনায় পৌঁছে বড় শয়তানের প্রতি সাতটি পাথর নিক্ষেপ করা। ২. তামাত্তু বা কিরান হাজি হলে হজের কোরবানি দমে শুকরিয়া (আর্থিক অক্ষম হলে রোজার ব্যবস্থা করা)। ৩. মাথা মুন্ডানো বা চুল কাটা (এরপর ইহরামমুক্ত হওয়া)। ৪. ১০ থেকে ১২ জিলহজের মধ্যে মক্কা মুকাররমা গিয়ে (হজের ফরজ তথা রুকন) তাওয়াফে জিয়ারত করা।
১১ জিলহজ : সূর্য দুপুরে পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়লে প্রথমে ছোট তারপর মেজো এরপর বড় শয়তানের প্রতি সাতটি করে পরপর ২১টি পাথর নিক্ষেপ করা ওয়াজিব। ১০ ও ১১ জিলহজ দিবাগত রাত মিনায় অবস্থান করা সুন্নত। শয়তানের প্রতি পাথর নিক্ষেপের সময় শুধু ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার’ বললেই চলবে।
১২ জিলহজ : সূর্য দুপুরে পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়লে ১১ জিলহজের নিয়মে তিন শয়তানের প্রতি ২১টি পাথর নিক্ষেপ করে মক্কা মুকাররমার উদ্দেশে সূর্যাস্তের আগে মিনার সীমানা ত্যাগ করা। ১২ জিলহজ মিনায় অবস্থান করে ১৩ জিলহজ ১১ ও ১২ জিলহজের মতো তিন শয়তানের প্রতি ২১টি কঙ্কর নিক্ষেপ করে মিনা ত্যাগ করা সুন্নত।
কিন্তু ১২ জিলহজ মিনা ত্যাগ করা প্রচলন হয়ে গেছে। আর মুয়াল্লিমরাও ১২ তারিখ দুপুর থেকে মিনায় তাদের ব্যবস্থাপনাও গোটাতে শুরু করেন। অতএব, হজ কার্যক্রমে ১৩ তারিখের কথা তেমন আসে না।
জিলহজ মাসের প্রথম দশ দিনের বিশেষ কিছু আমল রয়েছে। যেমন, ১. জিলহজের চাঁদ ওঠা থেকে নিয়ে কোরবানি করার আগ পর্যন্ত নখ-চুল না কাটা। (সহিহ মুসলিম, হাদিস ১৯৭৭)। যারা কোরবানি করবেন না তারাও এ আমলে শরিক হতে পারেন। এমনকি এ সময় বাচ্চাদের চুল-নখ কাটা থেকেও বিরত থাকা ভালো। (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস ২৭৮৯)। ২. বেশি বেশি লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আল্লাহু আকবার এবং আলহামদু লিল্লাহ তাসবিহ পাঠ করা। (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস ৫৪৪৬)। ৩. প্রথম নয় দিন রোজা রাখা। রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাধারণত এ সময় রোজা রাখতেন। (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস ২৪৩৭)। সামর্থ্যবান ব্যক্তিদের জন্য কোরবানি করা। (সুরা কাউসার (১০৮) : ২)। ৮. ঈদ ও আইয়ামে তাশরিকে রোজা না রাখা। (সহিহ বুখারি, হাদিস ১৯৯১; সহিহ মুসলিম, হাদিস ১১৪১)। ৯. ঈদুল আজহার নামাজ পড়া।
♦ লেখক : প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আমেনা খাতুন হাফেজিয়া কোরআন রিসার্চ অ্যান্ড ক্যাডেট ইনস্টিটিউট কটিয়াদী, কিশোরগঞ্জ