নামাজের পর দোয়া করতে হবে এমন কোনো শর্ত নেই। তবে ওলামায়ে কেরাম নামাজের পর দোয়া করতে এ জন্য বলেছেন যে, অনেক মানুষ একসঙ্গে নামাজ পড়েছে; এত মানুষের মধ্যে কয়েকজন হলেও তো মুখলিস বান্দা ও আল্লাহর ওলী থাকবেই, তাই দোয়া কবুলের প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে। দোয়া নামাজের অংশ নয়, তবে নামাজের পর দোয়া কবুলের সময় হিসেবে দোয়া করা যেতে পারে। তবে দোয়া করার সময় এদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে যে, মাসবুকের নামাজের যেন কোনো ক্ষতি না হয়। জোরে দোয়া ওই সময় করা যায় যখন মানুষের তেলাওয়াত ও নামাজের কোনো অসুবিধা না হয়। এতে মানুষের মনে তৃপ্তি আসে, আর মানুষ উচ্চ আওয়াজে ‘আমিন’ বলে। হাদিস শরিফে এসেছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন দোয়া করতেন তখন হজরত সাহাবায়ে কেরামগণ জোরে জোরে ‘আমিন’ বলতেন। এর দ্বারা বোঝা গেল যে, অনেক সময় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জোরে জোরে দোয়া করতেন।
আল্লামা মাজহারী, কুরতুবী, আলূসী (রহ.) তাদের স্ব স্ব তাফসিরের কিতাবে অনেক হাদিস এনেছেন, তার মধ্যে চমৎকার একটি হাদিসও এনেছেন। বলতে মনে চাচ্ছে না, তবুও ইসলাহের নিয়তে বলে দিচ্ছি। রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, বান্দা যখন আল্লাহতায়ালাকে রব মেনে দোয়া করবে তখন তিনি তাদের দোয়া কবুল করবেন।
অনেকে দোয়ার ক্ষেত্রে গর্ব করে; মদিনা শরিফ, মক্কা শরিফ ও বায়তুল মুকাদ্দাস মসজিদে গিয়ে দোয়া করে, কিন্তু দোয়ার সুফল নেই। কারণ কী? কারণ, যে মুখে দোয়া করে সে মুখে শুধু হারাম খাদ্য ভক্ষণ করেছে। যার খাদ্য হারাম, শরীরের রক্ত হারাম, গোশত হারাম, হাড্ডি হারাম, তার দোয়া কবুল হয় না। আল্লাহপাক পবিত্র, তিনি পবিত্র মানুষের দোয়া কবুল করেন। যে দিলের মধ্যে আল্লাহর ভালোবাসা নেই, রসুলের ভালোবাসা নেই, সেই মানুষের দোয়া তিনি কবুল করেন না। সে যখন দোয়া করে তখন আল্লাহর রাগ বেড়ে যায়। বস্তুত এই হাদিসে দোয়া কবুল হওয়ার একটি বিশেষ শর্তের কথা বলা হয়েছে; তা হলো দোয়া কবুলের জন্য খানা হালাল হতে হবে। আমরা যে এত দোয়া করি তা কেন কবুল হয় না? আসলে না হওয়ার কারণ দুটি (১) আমরা দোয়া করি কিন্তু আমাদের খাবার হালাল নয়। (২) যাদের জন্য দোয়া করি তাদের খাবার হারাম। ঘুষ ও সুদের টাকায় যার জীবন চলে তার জন্য কোনো বড় হুজুর দ্বারা দোয়া করালেও লাভ নেই।
হজরত আবু সাঈদ খুদরি (রা.) একবার রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রশ্ন করেছিলেন, ইয়া রসুলুল্লাহ! আমাকে এমন এক সহজ আমল বলে দিন, যা করলে জান্নাতে যেতে পারব। তবে শুধু আমার জন্য নয়, বরং আপনার সমগ্র উম্মতের জন্য। রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হে আবু সাঈদ! তুমি তিনটি কাজ করতে পারলে জান্নাতে যেতে পারবে। (১) হালাল খাদ্য খাবে। (২) সব আমল সুন্নত মোতাবেক করবে। (৩) মানুষ যেন তোমার দ্বারা কোনো প্রকার কষ্ট না পায়। হে আবু সাঈদ এই তিনটি (নবীয়ানা, সাহাবিয়ানা) কাজ যদি তুমি করতে পারো তাহলে তুমি জান্নাতে যেতে পারবে।
মোট কথা দোয়া কবুলের জন্য শর্ত হলো হালাল খাদ্য ভক্ষণ। দোয়া স্থান-কাল-পাত্র বিশেষে বেশি কবুল হয়। অর্থাৎ এমন বিশেষ জায়গা আছে যেখানে দোয়া বেশি কবুল হয়। এমন বিশেষ সময় আছে যখন দোয়া বেশি কবুল হয়। এমন বিশেষ ব্যক্তি আছে যার দোয়া বেশি কবুল হয়। যেমন দুনিয়াতে সর্বশ্রেষ্ঠ দোয়া কবুলের স্থানটি হলো বায়তুল্লাহ শরিফ। ওখানেও আবার শ্রেষ্ঠ স্থান হলো মাকামে ইব্রাহিম, মীযাবে রহমত ও মুলতাযাম। আল্লাহ পাক সকলকে সেখানে যাওয়ার তাওফিক দান করুন।
দোয়া কবুলের বিশেষ সময় হলো, জুমার রাত্রি, জুমার দিন আসরের পর, দুই ঈদের রাতে, লাইলাতুল কদরে, লাইলাতুল বরাতে ইত্যাদি। আর বিশেষ ব্যক্তি হলো ইয়াতিমের দোয়া, মজলুমের দোয়া। তদ্রুপ বিশেষ ইবাদতের পরেও দোয়া কবুল হয়। যেমন- নামাজের পর, কোরআন তেলাওয়াতের পর দোয়া কবুল হয়।
দোয়ার মাধ্যমে যেমন সহজেই আল্লাহর নৈকট্য হাছিল করা যায়, তেমনি আল্লাহর থেকে সহজে দূরত্ব সৃষ্টি হওয়ার একটি কারণ রয়েছে, তা হলো অহংকার। পূর্বোক্ত আয়াতের শেষাংশে বলা হয়েছে- যারা ইবাদতের ক্ষেত্রে অহংকার করে অচিরেই তারা জাহান্নামে প্রবেশ করবে। অহংকার একমাত্র আল্লাহর জন্যই শোভনীয়। কারণ তিনি সবচেয়ে বড়। আর অহংকার আল্লাহর জন্য ভালো গুণ। এটা হাদিসেও এসেছে। মানুষের মধ্যে অহংকার ও অহমিকা সৃষ্টি হয় জ্ঞানের কারণে, মালের কারণে, পদমর্যাদার কারণে। ধর্মীয় অঙ্গনে হাফেজ ও কারি সাহেবদের মাঝে অহংকার বেশি, কারণ তাদের অন্তরে আছে আল্লাহর পবিত্র কালাম। তারা তা সুন্দর করে পড়তে পারে। মাসয়ালা না জানার দরুন তাদের এ দশা। আর আলেমদের মাঝেও অহংকার আছে, কিন্তু মাসআলা জানা থাকার কারণে তারা তা দাবিয়ে রাখে। তবে যদি উত্তেজিত হয়ে যায় তাহলে আর ঠিক থাকতে পারে না। কারণ হলো, সমগ্র দুনিয়ার উত্তম জ্ঞান তাদের মাঝে। আর জ্ঞানের বাহ্যিক প্রকাশ হলো অহংকার। আলেমরা এত এহসান করছে উম্মতের ওপরে, এত মুজাহাদা ও কষ্ট করছে দীনের জন্য, ইসলামের জন্য, এর পরেও তাদের মূল্যায়ন নেই।
বুখারি শরিফের হাদিসে এসেছে, নেওয়ার জন্য যে হাত পাতে সে নিচে থাকবে আর যে দেওয়ার জন্য হাত বাড়ায় সে উপরে থাকবে। আমার এক উস্তাদ ছিলেন, তিনি মাদরাসা হতে বেতন নেওয়ার সময় হাত ওপরে রেখে বেতন নিতেন। কারণ জিজ্ঞাসা করলে বললেন, বেতন না নিয়ে তো পারি না; তবে হাদিসের কথা মনে করে হাত ওপরে উঠিয়ে নেই। নিচের দিক থেকে নিলে তো নিকৃষ্ট হয়ে যাব তাই ওপর দিক দিয়ে নেই। যা হোক আয়াতে আল্লাহ প্রথমে বললেন, আমার কাছে দোয়া করো আমি কবুল করবো। এরপরেই স্বাভাবিকভাবে এ কথা আসে যে, যারা দোয়া করে না তারা জাহান্নামে যাবে। কিন্তু আল্লাহতায়ালা তা বলেননি। আল্লাহ বললেন, যারা আমার ইবাদত করে না তারা মুতাকাব্বির তথা অহংকারী। অতিসত্বর তারা লাঞ্ছিত ও অপদস্থ হয়ে জাহান্নামে প্রবেশ করবে। এরূপ বলার কারণ হলো- দোয়াই তো একটা ইবাদত; শুধু ইবাদত নয় বরং হাদিসে এসেছে, ‘দোয়া হলো সমস্ত ইবাদতের মগজ।’
লেখক : আমির, আল হাইআতুল উলয়া ও বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ