উন্নয়ন বর্তমানে বেশ পরিচিত একটি শব্দ। বিভিন্ন কারণে এটি নিন্দিত ও নন্দিত। বহুবার বহু কারণে শ্লেষ হিসেবে অথবা প্রশংসা হিসেবে এটি ব্যবহৃত হয়। আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিসরের সঙ্গে ‘উন্নয়ন’-এর সম্পর্ক অধিক হলেও বর্তমানে সব বর্গের মানুষ ব্যবহার করতে অভ্যস্ত। উন্নয়ন কোনো অচল ও অটল ইমারত নয় বরং সচল ও সজীব প্রচেষ্টা। আমাদের সার্বিক বিকাশ এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে। বর্তমানে অগ্রগতির দিকনির্দেশনা ও ভবিষ্যতে অগ্রগতির পরিকল্পনা- এগুলো উন্নয়ন ভাবনার কেন্দ্রে বসে আছে। বোঝাই যাচ্ছে, উন্নয়ন কোনো হেলাফেলার বিষয় নয়। উন্নয়ন একটি বিস্তৃত ধারণা। উন্নয়নকে আমরা একটি যাত্রা হিসেবে বিবেচনা করতে পারি। এই যাত্রা মঙ্গলময়; সমগ্র মানব জাতির কল্যাণ অভিমুখে মঙ্গলময় যাত্রা।
উন্নয়ন হলো জীবনের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সংযুক্ত একটি পন্থা বা পদ্ধতি। এটি প্রতিনিয়ত পরীক্ষণ, পরিষ্করণ, সমন্বয় ও সাধনা দ্বারা পরিপুষ্ট হয়। নিছক অর্থশাস্ত্রের পরিমন্ডলে আটকে না রেখে দার্শনিক তত্ত্বের মাধ্যমেও আমরা উন্নয়নকে ব্যাখ্যা করতে পারি। দার্শনিক দৃষ্টিতে, উন্নয়ন হলো সত্যের এক সজীব ও প্রগতিশীল প্রবৃত্তি। উন্নয়ন সব সময় প্রয়োগের অবস্থায় আছে। উন্নয়ন কখনো কোনো একটি বিন্দুতে আটকে যায় না বা কোনো ক্ষেত্রকে অন্তিম বা চূড়ান্ত সত্য দাবি করে না।
উন্নয়নকে কেবল মোট উৎপাদনের বৃদ্ধি ও মাথাপিছু আয়ে সীমাবদ্ধ রাখা বিপজ্জনক। সমাজে বিত্ত-বৈভব বাড়লেই প্রকৃত উন্নয়ন হয় না। যদি সমাজের মানুষ তা ধারণ করার উপযুক্ত না হয়, যদি কেবলমাত্র আর্থিক প্রবৃদ্ধি ও সম্পদের যথেচ্ছ ব্যবহারে মনোযোগী হয় তবে বিভিন্ন ধরনের অস্থিতিশীল ও অপ্রীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। ক্রমাগত সংঘাত ও অশান্তি বাড়বে এবং একপর্যায়ে আইনশৃঙ্খলার অবনতির মাধ্যমে সমাজ কাঠামো ভেঙে পড়বে। ফলে বিত্ত-বৈভব জীবনযাত্রার মান বিকাশের কারক না হয়ে গোটা উন্নয়ন প্রক্রিয়াকেই হুমকির মুখে ফেলবে।
মানুষের মধ্যে অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক ভেদাভেদ দূর করার ওপর জোর দেওয়া ছাড়া প্রকৃত উন্নয়ন অসম্ভব। শুধু মুষ্টিমেয় লোকের অসংখ্য ভোগের চাহিদা সৃষ্টি করে সেসব পূরণে জোর দেওয়া একটি প্রবঞ্চনা। উন্নয়ন হলো একেবারে প্রান্তিক পর্যায়ে থাকা মানুষেরও স্বাধীনতা। এক্ষেত্রে উন্নয়নের দুটি শক্তি পুঁজি/মূলধন ও শ্রমের যথোপযুক্ত ব্যবহার করতে হবে। গঠনমূলক কাজে শ্রম ও মূলধনের ব্যবহার উন্নয়ন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করে।
আজ আমরা সামষ্টিকভাবে আমাদের কল্পনাশক্তিকে বিকশিত করে সামগ্রিক উন্নয়নের রূপকল্প তৈরিতে ব্যস্ত। আমাদের প্রত্যাশা গগনচুম্বী উন্নতির। আমরা চাই প্রাচুর্য। এই চাওয়ায় কোনো অন্যায় নেই। এই চাওয়াটা ন্যায়সংগত ও মানব সমাজের বিকাশে এই ধরনের আশা-আকাক্সক্ষা শুভফল আনবে। অন্যায়টা অন্য জায়গায়। আমরা শুভ কাজ করতে গিয়ে অসংখ্য অশুভ কাজ করেছি। আমরা ভোগসুখের স্বপ্ন লালন করতে গিয়ে নিজের জীবনকে নরক করে তুলেছি। তাহলে স্বীকার করতে হবে, কোথাও একটা ত্রুটি রয়ে গেছে। আমাদের উন্নয়ন ভাবনায় যথেষ্ট সীমাবদ্ধতা বিদ্যমান।
সভ্যতা-সংস্কৃতি, সাহিত্য, ইতিহাস, দর্শন ইত্যাদি নিয়ে আমরা ব্যাপক কাজ করছি না বা এগুলো অনেকাংশে অবহেলা করছি বিধায় আমরা আমাদের অমিত সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে ব্যর্থ হচ্ছি। একটি উন্নত ব্যবস্থাপনা সমৃদ্ধ কাঠামো বা পরিকল্পিত শাসনব্যবস্থা নির্মাণ করা ছাড়া গণতান্ত্রিক চর্চা অসম্ভব। আমরা সামষ্টিকভাবে আমাদের অমিত সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে ব্যর্থ হলে এ ধরনের কাঠামো নির্মাণ করা যাবে না। আমরা বোঝাপড়াটা আরও পোক্ত করার জন্য আরেকটু সরল ভাষায় ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করতে পারি। বিচ্ছিন্নভাবে বৌদ্ধিক উন্নতি ও আর্থিক প্রবৃদ্ধির কথা আমরা সর্বত্র শুনি। বস্তুত, প্রকৃত উন্নয়ন ব্যাপারটা অনেকটা পাখির মতো। পাখির উড়তে যেমন দুটি পাখা প্রয়োজন তেমনি প্রকৃত উন্নয়নের স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য বৌদ্ধিক উন্নতি ও আর্থিক প্রবৃদ্ধির সমন্বয় প্রয়োজন। বৌদ্ধিক উন্নতি ও আর্থিক প্রবৃদ্ধির সমন্বিত রূপই স্থায়ী/ টেকসই উন্নয়নের প্রকৃত রূপকল্প। আমরা বৌদ্ধিক ও আর্থিক বিকাশের সমন্বয় নিয়ে গুরুত্ব না দেওয়ায় মানব সভ্যতা আজ এই দুর্বিষহ পরিস্থিতির শিকার। আমরা যদি আমাদের উন্নয়ন ভাবনায় আর্থিক ও বৌদ্ধিক অগ্রগতিকে সংযুক্ত করতে পারতাম তবে আমাদের আজ প্রকৃত উন্নয়ন নিয়ে কথা বলতে হতো না।
উন্নয়ন করতে গেলে অবশ্যই দক্ষ মানব সম্পদের প্রতি গুরুত্বারোপ করতে হবে। দক্ষ মানব সম্পদের জন্য দুই ধরনের শিক্ষা আবশ্যক। একটি হলো তত্ত্বীয়, অপরটি ব্যবহারিক। তাত্ত্বিক বিষয়সমূহ (নীতি, বিচারবোধ, দর্শনচিন্তা, সমাজভাবনা, সাহিত্য, শিল্প, গণিত, বিজ্ঞানসহ বিভিন্ন বিষয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞান) তত্ত্বীয় শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত। ব্যবহারিক বিষয়সমূহ (উন্নত প্রশিক্ষণ, কর্মমুখী শিক্ষা, বাণিজ্য সম্পর্কিত ধারণা, প্রযুক্তির ব্যবহার, নিয়োগ ও কর্মসংস্থানসংক্রান্ত জ্ঞান, সমাজের আর্থিক প্রবৃদ্ধি সম্পর্কিত জ্ঞান ইত্যাদি) ব্যবহারিক শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত।
♦ লেখক : গবেষক