সম্প্রতি দক্ষিণ আমেরিকার পেরুতে কাঠের তৈরি ল্যাপটপ নিয়ে বিশ্বজুড়ে চলছে হইচই। পেরুর অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো হলেও পিছিয়ে পড়া জনগণের জন্য প্রযুক্তির ব্যবহার হাতের নাগালে আনতে সম্প্রতি উদ্ভাবন করেছে কাঠের তৈরি ল্যাপটপ। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীরা যেন সবার সঙ্গে যুক্ত হয়ে নিজেদের আরও এগিয়ে নিতে পারে- এমন ভাবনা থেকেই এ উদ্যোগ। বাস্তবতা হচ্ছে পেরুর প্রত্যন্ত অঞ্চলের অনেকটাই বিশ্বায়ন থেকে বিচ্ছিন্ন। তাদের আধুনিক প্রযুক্তির কোনো অভিজ্ঞতাই নেই। এ ধরনের মানুষের কাছে শিক্ষার আলো পৌঁছে দিতে এ অভিনব উদ্যোগ। পেরুর এক উদ্যোক্তা ‘আলেহান্দ্রা কারাস্কোর’ তৈরি করেছেন এ ল্যাপটপ- নাম ওয়া ওয়া ল্যাপটপ। দেখতে খুবই আকর্ষণীয়, পরিবেশবান্ধব এবং ভেঙে গেলেও খুব সহজেই যন্ত্রাংশ পরিবর্তন করা যায়। এ ল্যাপটপের আরেকটি প্রদান সুবিধা হলো এটি চার্জ করা যায় সোলার প্যানেলের মাধ্যমে। পেরুর এমন অনেক জায়গা আছে, যেখানে বিদ্যুৎ পাওয়া দুষ্কর। তাই শুধু প্রযুক্তির বিস্তৃতির জন্য নয় পরিবেশ সুরক্ষা এবং বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন অঞ্চলের কথা মাথায় রেখেই এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। অবশ্য সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষার্থীদের কাছে কাঠের ল্যাপটপ পৌঁছে তাদের মাধ্যমে সে দেশের অর্থনীতি ও গণতন্ত্রের চাকাও বদলে দিতে চান উদ্যোক্তারা। প্রকৃত অর্থে, উদ্যোক্তারা চেয়েছিলেন এমন একটি পণ্য তৈরি করতে যা সামাজিক পরিবর্তন আনবে। যেহেতু পেরুর অনেক মানুষ এখনো বৈশ্বিক প্রযুক্তির সঙ্গে যুক্ত হতে পারেনি। তাই প্রযুক্তির দুর্বলতা দূর করার লক্ষ্যে তারা এ ল্যাপটপ তৈরি করেছে, যা শিক্ষা বিস্তারে এক নতুন পথ খুলে দিয়েছে।
সুবিধাবঞ্চিত গরিব শিক্ষার্থীদের ল্যাপটপ দেওয়ার এ ধরনের কর্মসূচির আরও নজির আছে বিশ্বে। ২০০৫ সালে তিউনিসে জাতিসংঘ তথ্য সম্মেলনে উন্নয়নশীল বিশ্বের (আফ্রিকা এশিয়া এবং লাতিন আমেরিকা) দরিদ্র শিশুদের জন্য ১০০ ডলারের ল্যাপটপ কম্পিউটার বিতরণের ঘোষণা করেছিলেন ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (গওঞ)-এর প্রতিষ্ঠাতা এবং ‘ওয়ান ল্যাপটপ পার চাইল্ড’ (ওএলপিসি)-এর কর্ণধার প্রফেসর নিকোলাস নেগ্রোপন্টে। পরবর্তীতে ল্যাপটপের উচ্চমূল্য এবং দরিদ্র দেশসমূহে বিদ্যুৎ সমস্যার কথা চিন্তা করে ইউনিসেফ ওই প্রকল্পটি হাতে নেয় এবং ২০০৭-এর মাঝামাঝি এটি পুরোদমে উৎপাদন শুরু করে। সেই সময় ১০০ ডলারের ল্যাপটপের খবর প্রচার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ১ কোটি অগ্রিম অর্ডার আসে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে। বিশ্বব্যাপী প্রশংসা আর সুনাম যেন নেগ্রোপন্টেকে পৌঁছে দেয় আকাশচুম্বী সাফল্যে। কয়েক মাসের মধ্যেই লিবিয়া, থাইল্যান্ড, আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, নাইজেরিয়া, চীন, মিসর প্রায় ৭০ লক্ষাধিক ল্যাপটপ কেনে। শুধু মিসরই ১২ লাখ ল্যাপটপ তাদের শিশুদের বিতরণ করে। কিন্তু হঠাৎ করে ওই ল্যাপটপের দাম ১০০ থেকে বেড়ে ১৮৮ ডলারে পৌঁছে যাওয়ায় প্রকল্পটির সাফল্য আস্তে আস্তে ভাটা পড়ে।
ছিন্নমূল শিশুদের ল্যাপটপ দেওয়ার কর্মসূচি আমাদের দেশেও আছে। ২০০৫ সালে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের নিয়ে কাজ করে এমন তিনটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠানকে বিশ্বব্যাংক ১০০টি কম্পিউটার ও ল্যাপটপ অনুদান হিসেবে হস্তান্তর করে। প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে, আন্ডারপ্রিভি লাইলজ চিলড্র্রেন এডুকেশন প্রোগ্রাম (ইউসিইপি), গেন্ডারিয়া কিশলয় কচি-কাঁচার মেলা এবং কপারস কৃষ্টি হাইস্কুল। ২০১৫ সালের ১৮ মে, জাতিসংঘের সাউথ এডুকেশন ফাউন্ডেশন থেকে ৫০টি ল্যাপটপ অনুদান হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ও অসচ্ছল শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেন। এর আগে ৩ মে ২০১৫ সালে, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের ‘ওয়ান স্টুডেন্ট ওয়ান ল্যাপটপ’ প্রকল্পের আওতায় এক্সিম ব্যাংকের সহায়তায় বিনামূল্যে ৫০০ ল্যাপটপ বিতরণ করা হয়। এর মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০০ জন, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০০ জন এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০০ শিক্ষার্থীকে এ ল্যাপটপ দেওয়া হয়। একই বছর এক্সিম ব্যাংকের সহযোগিতায় ‘ওয়ান ল্যাপটপ ওয়ান ড্রিম’ প্রকল্পের আওতায় দেশের ৬৪ জেলার ৮৫ জন শিশু ও কিশোর সাংবাদিককে ল্যাপটপ প্রদান করা হয়। তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের ‘লার্নিং অ্যান্ড আর্নিং’ প্রকল্পের আওতায় ২০১৮ সালে দেশের ১৩০০ প্রশিক্ষণার্থীর হাতে একটি করে ল্যাপটপ দেওয়া হয়। একই সময়ে রোটারি ক্লাবের উদ্যোগে আটজন দরিদ্র মেধাবী শিক্ষার্থীকে অনলাইনে লেখাপড়া করার জন্য একটি ল্যাপটপ ও সাতটি স্মার্টফোন দেওয়া হয় এবং পর্যায়ক্রমে ৪৫ শিক্ষার্থীকে এ সেবার আওতায় আনা হয়। গত সরকার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লাখ লাখ ল্যাপটপ বিতরণ করেছে। কিন্তু প্রয়োজনীয় লোকবল ও লজিস্টিক সাপোর্টের অভাবে এগুলোর অধিকাংশই এখন অকেজো। দেশে এখন অনেক প্রতিষ্ঠিত আইটি প্রতিষ্ঠান আছে, বিদেশি আইটি সংস্থার সঙ্গেও আছে তাদের ব্যবসায়িক চমৎকার যোগাযোগ। এরা ইচ্ছা করলে সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে কিংবা স্বল্প মূল্যে ল্যাপটপ বিতরণ করে তাদের আধুনিক শিক্ষা ও প্রযুক্তির সঙ্গে কানেক্ট করতে পারে।লেখক : অধ্যাপক এবং তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, আইআইটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়