আমেরিকার ৪৭তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন ট্রাম্প। আমেরিকার ইতিহাসে কোনো নারী প্রেসিডেন্ট এখনো আসেনি। সহজে আসবে বলেও মনে হয় না। নারীকে প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচন করার মতো এতটা উদার মানসিকতা আমেরিকানদের নেই বলে মনে হয়। ২০১৬ সালে ট্রাম্পের কাছেই হেরেছিলেন হিলারি ক্লিনটন। এবার হারলেন কমলা হ্যারিস। কিন্তু মাত্র কদিন আগে ৪৩টি অঙ্গরাজ্যে ভোট জরিপে উভয়ে জনপ্রিয় ভোট পেয়েছিলেন ৪৭%। অর্থাৎ সমান সমান। বাকি ছিল সাতটি রাজ্য। যাদের বলা হয় সুইং স্টেট। এই পরিস্থিতিতে ম্যাজিক দেখালেন ট্রাম্প। ক্ষমতায় ফিরলেন রাজার মতো। আমেরিকার ইতিহাসে তিনিই দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এলেন। সংগত কারণে প্রশ্ন আসে, কেন ক্ষমতার শীর্ষে যেতে পারছেন না আমেরিকান নারী! যোগ্যতা-দক্ষতা কোনো দিকেই তাঁরা কম নন। তারপরও কেন? তাহলে কী ভালো নেই আমেরিকান নারী! এত বড় মহাদেশ, ডলারে ইনকাম, সাদা রং, স্বাধীনতা ভোগ করে, ভালোই তো থাকার কথা।
আমেরিকার পরিবার আমাদের মতো নয়। ১৮ বছর বয়স হওয়ার পর ছেলেমেয়েরা স্বাধীন হয়ে নিজেদের মতো জায়গা খুঁজে নেন। বাবা-মায়ের তাদের ওপর দায়িত্ব থাকে না। বাবা-মা নিজেদের মতো জীবন কাটায়। অনেকেই শেষ বয়সে বৃদ্ধাশ্রমে যায়। মোটামুটি এটাই রুটিন। ব্যতিক্রম কিছু আছে।
ও দেশের বাবা-মা নিজেদের জীবনপাত করে, বঞ্চিত করে সন্তানের জন্য টাকা জমায় না। সম্পত্তি কেনে না। তাদের জীবন নিরাপদ করতে জীবনভর কষ্ট করে না। ওরা নিজেদের সাধ্যমতো সবচেয়ে ভালো জীবনযাপন করে, ছুটিতে ভ্রমণে যায়, ভালো খায়, ভালো পরে। জীবনকে চুটিয়ে উপভোগ করে। উত্তরাধিকার সূত্রে সন্তানরা সম্পত্তি পায় না বললেই চলে। নিজেরটা নিজেকেই করে নিতে হয়, গড়ে নিতে হয়। ও দেশে লেখাপড়ার খরচ অনেক। স্টাডি লোন নিয়ে পড়াশোনা করে কেউ কেউ। অনেকে হাই স্কুল শেষ না করেই কাজে লেগে যায়। অনেক মেয়ে স্কুলজীবনেই বিয়ে করে ফেলে। ছেলেরা বিয়ে করে সাধারণত কমবয়সি স্কুলের নিচু ক্লাসের কোনো ছাত্রীকে। যারা উচ্চশিক্ষায় যায়, পিএইচডি করে, তারা বিয়েটাকে ঠেকিয়ে রাখে। পঁয়ত্রিশ চল্লিশ কখনো পঞ্চাশে কমবয়সি মেয়ে বিয়ে করে। বেশি বয়সে কমবয়সি মেয়ে বিয়ে করাকে ব্যঙ্গ করে বলা হয় ‘সুগার ড্যাডি’। আমেরিকানরা হিসাব করে চলে। বিয়ের ঝক্কি অনেক। বিয়ের পর খরচ অনেক বেড়ে যায় বলে সহজে বিয়ে করতে চায় না। গার্লফ্রেন্ড বয়ফ্রেন্ড সম্পর্ক সমাজস্বীকৃত, স্বামী-স্ত্রীর মতোই। এরা খুব অল্প বয়সে যৌনজীবন শুরু করে বলে একসময় অনেকেই বিয়ের আগ্রহ হারিয়ে ফেলে।
মেয়েরা বিয়ের জন্য আগের দিনে পছন্দ করত লম্বা, শক্তসমর্থ্য পেশিবহুল কর্মক্ষম পুরুষ। যে খেতখামারে ভালো কাজ করে ফসল ফলাতে পারবে অথবা শিকার করতে পারবে। এখন ধারণা বদলে তারা পছন্দ করে টাকাওয়ালাদের। গরিবি হালে জীবন কাটানোর চেয়ে ‘সুগার ড্যাডি’ হলেও আপত্তি করে না।
সাদারা সাদাই পছন্দ করে প্রধানত। ধর্ম ও দেশে বড় ফ্যাক্টর। ধর্ম বা বর্ণ আলাদা হলে অনেক সময় ত্যাজ্য হতে হয়। এমনও শুনেছি, সাদা ছেলে যদি কালো মেয়ে বিয়ে করে তাহলে পাশের সাদারা বাড়ি বদলে চলে যায়। অন্য সাদারা সে বাড়ি কিনতে চায় না। এলাকার সম্পত্তির মূল্য কমে যায়। ধারণা করা হয় এভাবে সাদাদের নির্বাসনে দিয়ে জেঁকে বসবে কালোরা। যাকে বলে ‘হোয়াইট ফ্লাইট’। আমেরিকান সাদা ছেলেদের সবচেয়ে পছন্দ চাইনিজ মেয়ে। তাদের রং সাদা, ধর্ম নিয়ে খুঁতখুঁতি নেই, সহজেই ধর্মান্তরিত হয়। সব পরিবেশে মানিয়ে নেয়, সহজে ডিভোর্স দেয় না। তাই নিজেদের বাইরে বিয়ে করতে হলে তারা চীনা মেয়ের দিকেই ঝুঁকে থাকে বেশি। এরপর তালিকায় আছে কোরিয়ানরা। বিয়ে করার ব্যাপারে ওরা সতর্ক। অসুখী দাম্পত্য কাটানোর চেয়ে ওরা ডিভোর্সকে মূল্য দেয়। ওখানে ঘরে ঘরে ডিভোর্স। দ্বিতীয় স্বামী, তৃতীয় স্ত্রী, সৎ ছেলেমেয়ে ব্যাপারই না। ওরা এমন কাউকে বিয়ে করতে চেষ্টা করে যাতে ডিভোর্স না হয়। ঠিকঠাক বিয়ে না হলে পার্টনারকে হয় সারা জীবন ‘এলিমনি’ দিতে হবে নতুবা জীবন নরক হয়ে যাবে। ব্রোকেন ফ্যামিলিতে বড় হওয়া সন্তানদের মনোজগতে সমস্যা থাকে। তাই ওরা চায় সুসংহত পরিবার থেকে আসা পাত্রপাত্রী বিয়ে করতে। যাদের জীবনে ট্রমা নেই।
আমেরিকান নারীরা সন্তানদের ব্যাপারে তেমন মনোযোগী না, এমন শুনেছিলাম। বাস্তবে তেমনটা নয়। ওখানে অধিকাংশ বাস আর উবার ড্রাইভার নারী। তারা আত্মপ্রত্যয়ী এবং সচেতন। একদিন এক নারী ড্রাইভারকে স্যুটকেশ ধরতে বলেছিলাম। উনি বললেন, স্যরি আই এম প্রেগনেন্ট। অর্থাৎ তিনি তার প্রেগনেন্সির ব্যাপারে অত্যন্ত সতর্ক এবং মনোযোগী। আরেক দিন একজন নারী সারাটা পথ তার মেয়ের গল্প করলেন। মেয়ে কী করে, কী পছন্দ করে, কী পড়বে, মেয়েকে নিয়ে কী কী পরিকল্পনা ইত্যাদি ইত্যাদি। ঠিক যেভাবে একজন বাঙালি মা তার সন্তানের গল্প করেন, সেভাবেই। তিনি একজন স্কুল টিচার। অবসর সময়ে উবার চালান মেয়ের স্কুলের খরচ চালাতে। আরেকজনকে জানি, যিনি প্রতিদিন বাচ্চাকে স্কুলে দিয়ে আসেন। সন্তানদের সঙ্গে নিয়ে মাছ ধরেন, বাগান পরিচর্যা করেন। আমেরিকা যত বড় মহাদেশ, যত সুযোগসুবিধা ততটা সুবিধায় কিন্তু নারীরা নেই। আমেরিকান নারী স্বামীসহ মাত্র ১২ সপ্তাহের বিনা বেতনে মাতৃত্বকালীন ছুটি পান। একজন প্রেগনেন্ট মহিলাকে প্রেগনেন্সির পুরোটা সময় কাজ করতে হয় অথবা বিনা বেতনে ছুটি নিতে হয়। এটা সত্যিই বেদনার!
নারী-পুরুষের বেতন বৈষম্যও আছে ওখানে। একই কাজ করে নারী পুরুষের চেয়ে কম বেতন পায়। এ বিষয়ে অবশ্য কেউ কেউ যুক্তি দেখান, নারীরা শ্রমসাধ্য কাজ কম করতে পারে। তাহলে নারীকে সে কাজে নেওয়ার দরকার নেই। কাজে নিলে, একই সময় কাজ করলে বেতন সমান দিতে হবে এটাই ন্যায্যতা। ও দেশের সুপ্রিম কোর্ট পাস করেছে গর্ভপাতবিরোধী আইন। ইতোমধ্যে ২২টি রাজ্যে এই আইন কার্যকরও করা হয়েছে। কেড়ে নেওয়া হয়েছে নারীর গর্ভপাত করানোর সাংবিধানিক অধিকার। এই আইন যাতে কঠোরভাবে পালিত হয়, এক স্টেট থেকে আরেক স্টেটে গিয়ে গোপনে যাতে গর্ভপাত ঘটাতে না পারে, সে জন্য মেয়েদের পিরিয়ড অ্যাপস-এ কঠোরভাবে নজরদারি করছে সরকার। এটা নারীর শরীরের ওপর সরাসরি নিয়ন্ত্রণ। কারও হয়তো শারীরিক কারণেই ডিএনসি করা প্রয়োজন। এই আইনে আটকে যাচ্ছে সে। এই আইন জারির ফলে মেয়েরা যৌনমিলনে ভয় পাচ্ছে। তাদের স্বাভাবিক যৌনজীবন ব্যাহত হচ্ছে। গর্ভবতী হওয়ার ভয়ে গুটিয়ে থাকছে তারা। এটা কোনো প্রশংসনীয় পদক্ষেপ হতে পারে না।
এটাই প্রবল পরাক্রমশালী আমেরিকার মেয়েদের অবস্থা। কালোরা সংখ্যালঘু। আমেরিকায় ‘অ্যারিং ব্ল্যাক ওম্যান’ বা ‘রাগী কৃষাঙ্গ’ নারী বলে একটা কথা প্রচলিত আছে। কালো নারীদের অনারীসুলভ, যুক্তিহীন আর কঠোর হিসেবে তুলে ধরতে কথাটা প্রচলন করা হয়েছে। পাশাপাশি এ কথাও বলা হয়, নারীর প্রেসিডেন্ট বা ভাইস প্রেসিডেন্ট হওয়ার মতো সক্ষমতা নেই। তারা কঠিন মনের নন, তাদের চারিত্রিক দৃঢ়তা নেই। কিন্তু তারা যদি রাগই প্রকাশ না করতে পারেন, দৃঢ়তা দেখাবেন কী করে! কী বৈপরীত্য! কমলা হ্যারিস আমেরিকার ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে বড় উল্লসিত হয়েছিলাম আমরা। কিন্তু তাঁকে কম বন্ধুর পথ পেরিয়ে আসতে হয়নি। তিনি জোরে কথা বললে প্রতিপক্ষ বলেছে বদমেজাজি, আস্তে কথা বললে বলেছে আত্মবিশ্বাসের অভাব। যে কথা বলে পুরুষ আত্মবিশ্বাসীর তকমা পেয়েছেন, একই কথা বলে তিনি তকমা পেয়েছেন ক্ষমতা জাহিরের। তাঁর প্রতিপক্ষ মি. পেন্স এমন ভাব করেছিলেন, যেন নারী ধর্তব্যের মধ্যেই না। নারীকে থামিয়ে দিয়ে কথা বলার প্রবৃত্তিও দেখা গেছে বারবার।
পুরুষ সব সময়ই যোগ্য পুরুষ বলেই। নারীর যোগ্যতা প্রমাণ করতে হয় বাড়তি কিছু করে। নারীর সংসারজীবনও আলোচনায় আসে। বিয়ে করলেন না কেন, বিয়ে করলে সন্তানদের কে দেখবে, সন্তানদের দেখাশোনা না করে রাজনীতিতে নামছেন কেন এটাও ইস্যু হয়। তাই কমলাকে বারবার বলতে হয়েছে, তাঁর দুজন সৎ সন্তান আছে, সৎ ছেলেরা তাঁকে ‘মোমালা’ ডাকে। তাঁর মা তাঁকে মানুষ করেছেন সিঙ্গেল মাদার হিসেবে ইত্যাদি ইত্যাদি। অর্থাৎ তাঁর পারিবারিক বন্ধন যে অটুট এবং মিশ্র জাতিগোষ্ঠীর পরিবার সেটাও প্রচার করতে হয়েছে। কোনো নারীর সন্তান না থাকলে, সংসার না থাকলে তিনি কী বলবেন! এটা কী তার অযোগ্যতা! পুরুষকে কেউ কখনো প্রশ্ন করে না, তিনি রাজনীতিতে নামলে তার সন্তানদের কে দেখবে, কে সংসার সামলাবে। কেউ তাকে প্রশ্ন করে না আপনার কাছে রাজনীতি বড় না পরিবার বড়।
শুধু কমলাই নন, ২০০৮ সালের ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান দলের প্রার্থী সারা পেলিনের বেলায়ও পরিবার নিয়ে বিতর্ক তোলা হয়েছিল। পেলিন তখন আলাস্কার গভর্নর। সে সময় পেলিনের পাঁচ সন্তানের মধ্যে এক শিশুসন্তানের ডাউন সিনড্রম নিয়ে ব্যাপক কাটাছেঁড়া করেছিল সংবাদমাধ্যম এবং কিছু ডেমোক্র্যাট সদস্য। সন্তানকে অবহেলা করে তিনি রাজনীতিতে নামছেন কি না, তা নিয়ে বিস্তর প্রশ্ন তুলেছিল সমালোচকরা। এ কারণে রাজনীতিতে নামতে হলে মেয়েদের বলা হতো, শিশুসন্তান থাকলে গোপন রাখতে, ঘর ভেঙে গেলে সেটা প্রকাশ না করতে বা আর্থিক দৈন্য থাকলে সেটা আড়াল করতে। এই ধ্যানধারণা আগের চেয়ে কিছুটা বদলালেও এখনো নারীরা এ থেকে সম্পূর্ণ মুক্তি পায়নি। এত সব বাধা ডিঙিয়েও রাজনীতিতে স্থান করে নিয়েছেন জেরাল্ডিন পেরারো থেকে শুরু করে সারা পেলিন, হিলারি ক্লিনটন, কমলা হ্যারিসসহ অনেকে। কিন্তু আজও আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হতে পারেননি কোনো নারী! এবারও পারলেন না কমলা।
২০১৮ সালের পর থেকে রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। নারীরা আগের চেয়েও আত্মবিশ্বাসী হয়েছেন। আমেরিকার সাবেক সেক্রেটারি অব স্টেটস কনডেলিৎসা রাইস আজও নারীর অধিকার বিষয়ে সোচ্চার। তিনি বলেছেন, কেউ আপনাকে ছোট করার চেষ্টা করলে মেনে নেবেন না, রুখে দাঁড়াবেন, প্রাপ্য বুঝে নেবেন। আমেরিকার সাবেক ফার্স্ট লেডি জিল বাইডেন বলেছেন, মেয়েদের যুদ্ধ এখনো চলছে। ভাবতে ভালো লাগে, কিছু সীমাবদ্ধতা থাকার পরও আমাদের মেয়েরা, মা-বোনেরা ওদের চেয়ে ভালো আছি!
লেখক : কথাশিল্পী ও গবেষক