রাজধানী ঢাকা থেকে প্রত্যন্ত গ্রাম-মফস্বল পর্যন্ত সারা দেশে মাদকাসক্তি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। শিশু-কিশোর, তরুণ-যুবকদের বড় একটা অংশ মাদক আসক্তির শিকার। মাদকাসক্তি স্থায়ী রূপ ধারণ করেছে মাদকদ্রব্যের সহজলভ্যতা এবং মাদক কারবারিদের বিচারহীনতার কারণে। দেশের অসংখ্য স্থানে প্রকাশ্যে চলে মাদকদ্রব্য কেনাবেচা। মাদকাসক্তি দূর করার জন্য সামাজিক ও পারিবারিক প্রচেষ্টাও জরুরি। প্রতিটি পরিবারের সন্তানদের দিকে দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন; খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ইত্যাদি বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।
সর্বনাশা মাদকের কারণে দেশের লাখ লাখ লোক বিপথগামী হয়ে পড়ছে। শুধু তরুণরা নয়, এখন কিশোর, এমনকি কিশোরীরাও মাদকাসক্ত হচ্ছে। মাদকের বিষাক্ত ছোবলে অকালে ঝরে পড়ছে তাজা প্রাণ। আগে মাদক বলতে ছিল প্রধানত গাঁজা। এখন সে সঙ্গে যোগ হয়েছে আরও অনেক নাম। এর মধ্যে সবচেয়ে ভয়ংকর হচ্ছে ইয়াবা। এটা এখন প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও সহজলভ্য হয়ে উঠেছে। এ ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে সন্তানকে রক্ষার জন্য অভিভাবকদের সঙ্গে পুরো জাতি আজ শঙ্কিত। ইয়াবা হেরোইনের চেয়েও ক্ষতিকর। এটা একধরনের মনো উত্তেজক মাদক। ইয়াবা সেবনের ফলে কমতে থাকে জীবনীশক্তি। কিন্তু সমাজ, দেশ ও জাতিকে সুস্থ রাখতে হলে সর্বনাশা এ কারবার জরুরি ভিত্তিতে বন্ধ করা প্রয়োজন। কোনোভাবেই রোধ করা যাচ্ছে না। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এ মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ছে। এর প্রতিক্রিয়ার ভয়াবহতা এমনই যে এর সেবনকারী নিজেই নিজের ঘাতক হয়ে উঠতে পারে। উঠতি বয়সি কিশোরদের অনেকে মাদকাসক্ত, যারা খুন, ধর্ষণ, ছিনতাই, মাদক বেচাকেনায়ও জড়িত। ফলে সমাজে এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়ছে। মাদক এখন বাংলাদেশে সামাজিক বিপত্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সমাজের বিত্তবান ও প্রভাবশালী পরিবারের সন্তানরাও সর্বনাশা এ নেশার জগৎ ঘিরে গড়ে তোলে বাণিজ্যিক সিন্ডিকেট। মাদকের প্রভাব কমানো যাচ্ছে না। ভয়ংকর সব মাদকদ্রব্য সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ায় শহর ছাড়িয়ে গ্রামাঞ্চলেও তরুণ সমাজে মাদকাসক্তি ভয়ংকর রূপ নিচ্ছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠেছে মাদক সিন্ডিকেটের প্রধান লক্ষ্য অভিজাত পরিবারের সন্তানরা। পাশাপাশি উঠতি বয়সি কিশোর ও তরুণরাও তাদের টার্গেট। মাদকাসক্তরা যেমন নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। মাদকের ভয়াবহতা যে কতটা আমরা প্রতিনিয়ত দেখছি। কোনোভাবেই এটা হ্রাস হচ্ছে না। বরং দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। নিত্যনতুন কৌশলে মাদকের চোরাচালান দেশে ঢুকছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে প্রায় দিনই একাধিক চালান উদ্ধার ও বহনকারী গ্রেপ্তার হলেও যেন অপ্রতিরোধ্য মাদক কারবারিরা। বিশেষ করে মিয়ানমার সীমান্ত হয়ে ইয়াবার চালান আসছে প্রতিনিয়ত। সাগর, পাহাড় আর সড়কপথে নানা কৌশলে পাচার হচ্ছে এ ভয়ংকর নেশার ট্যাবলেট।
মরণ নেশা ইয়াবা দেশের তরুণ সমাজকে এখন সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করছে। মুড়িমুড়কির মতো সর্বত্র ইয়াবা পাওয়া যাচ্ছে। ইয়াবাকে পুঁজি করে রমরমা কারবার চলছে। ইয়াবাসহ অন্যান্য মাদকের ভয়াবহ আগ্রাসনের প্রেক্ষাপটে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণে কঠোর আইন প্রণয়ন করেছে সরকার। আইন প্রণয়নের চেয়ে আইনের যথাযথ প্রয়োগের বিষয়টি বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
সম্প্রতি আইস জব্দের ঘটনাও বেড়েছে। ইয়াবার বা আইসজাতীয় মাদক শরীরের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। ইয়াবায় অ্যামফিটামিন থাকে ৫ শতাংশ। আর আইসের পুরোটাই অ্যামফিটামিন। এসব মাদক সেবনকারীর মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের সমস্যা হতে পারে। মানসিক অবসাদ বা বিষণ্নতার কারণে আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে উঠতে পারে সেবনকারী।
তরুণ প্রজন্মের বিপথগামী ও উচ্ছৃঙ্খল করে তোলার পেছনে মূল ভূমিকা পালন করে মাদক। মাদক চোরাকারবারিদের লক্ষ্যই থাকে তরুণ ও যুবক শ্রেণির দিকে। তারাই তাদের মাদকের প্রধান খরিদ্দার। তারা নিত্যনতুন মাদক চোরাচালান করে তরুণদের মাঝে ছড়িয়ে দিচ্ছে। তারা ফেনসিডিল, হেরোইন, ইয়াবা থেকে শুরু করে এখন নতুন সংস্করণ হিসেবে এলএসডি এবং গাঁজার কেক নিয়ে আসছে। মাদক কারবারিরা অনলাইনে বিভিন্ন গ্রুপ খুলে মাদক বিক্রি করছে। দেখা যাচ্ছে, ইয়াবার সঙ্গে এখন এই মাদক যুক্ত হয়ে এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। বহুদিন ধরেই দেশে ইয়াবার ব্যাপক বিস্তার চলছে। মিয়ানমার থেকে কক্সবাজারের টেকনাফ দিয়ে জোয়ারের মতো ইয়াবা দেশে প্রবেশ করছে। প্রতিদিনই নতুন নতুন ইয়াবা কারবারি তৈরি হচ্ছে।
মাদকের বিস্তারের সঙ্গে জড়িতদের ধরে ও ক্রসফায়ার করে ঠেকানো যাবে না। এর মূল বা গোড়ায় যেতে হবে। এর পেছনে বিভিন্ন ক্ষেত্রের যেসব প্রভাবশালী ব্যক্তি রয়েছে তাদের ধরতে হবে। মাদক চোরাকারবারিকে কোনো দলীয় পরিচয় বা প্রভাবশালী বিবেচনায় ছাড় দেওয়া যাবে না। তাহলে মাদকের বিস্তার অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। মাদক ও অপরাধমুক্ত সমাজ গড়তে হলে মানুষের মধ্যে সংশোধন ও সংস্কার আনতে হবে।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য