শ্রেষ্ঠ ও মর্যাদাপূর্ণ নবীগণের অন্যতম হলেন হজরত ইবরাহিম (আ.)। মহাগ্রন্থ আল কোরআনে ২৫টি সুরায় তাঁর নাম এসেছে। তাঁর নাম অনুযায়ী আল কোরআনে সুরা ইবরাহিম নামে একটি সুরা নামকরণ হয়েছে। আল কোরআনের ভাষায় তিনি মানব জাতির ইমাম। (সুরা আল বাকারা-১২৪) তিনি আদর্শ স্বভাবের স্থপতি। (সুরা আন নাহল-১২০) পরিপূর্ণ একত্ববাদের অধিকারী তিনি। (সুরা আন নাহল-১২৩) তিনি শ্রেষ্ঠ খোদাভীতি ও আনুগত্যশীল মহৎ ব্যক্তি। (সুরা আন নাহল-১২০) আল কোরআনের আলোকে ইবরাহিম (আ.) একজন শ্রেষ্ঠ ও অনন্য ব্যক্তিত্ব। তিনি তাওহিদের আহ্বানদাতা হিসেবে নিজের জাতির মূর্তিপূজার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য পিতা, জাতি ও নিজের আরাম-আয়েশ ত্যাগ করেন। আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই ইবরাহিম ছিলেন একা একটি জাতি’ (সুরা আন নাহল ১২০) যা তাঁর ইমান, ধৈর্য ও আত্মত্যাগের স্বীকৃতি। তাই ইবরাহিম (আ.)-কে ইসলাম ধর্মের স্থপতি এবং মুসলিম জাতির পিতা ঘোষণা করা হয়েছে। মহান প্রভু ইরশাদ করেন, ‘তিনি ধর্মের ব্যাপারে তোমাদের ওপর কোনো কঠোরতা আরোপ করেননি। ইহা তোমাদের পিতা ইবরাহিমের ধর্ম, তিনি পূর্বে তোমাদের নামকরণ করেছেন মুসলিম।’ (সুরা আল হাজ-৭৮) মুসলিম উম্মাহ তাঁর অনুকরণে প্রতি বছর কোরবানি করে এবং পবিত্র হজ পালন করে থাকে। তাঁর স্মৃতি অনুসরণ করে দুই রাকাত নামাজ আদায় করা প্রত্যেক হজ পালনকারীর জন্য ওয়াজিব। মহান প্রভু ঘোষণা করেন, ‘যখন আমি কাবা গৃহকে মানুষের জন্য সম্মিলন স্থল ও শান্তির আলোয় করলাম, আর তোমরা ইবরাহিমের দাঁড়ানোর জায়গাকে নামাজের জায়গা বানাও।’ (সুরা আল বাকারা-১২৫) রসুলুল্লাহ (সা.) তাঁকে অনেক ভালোবাসতেন। ইবরাহিম (আ.)-এর নামে রসুলুল্লাহ (সা.)-এর এক পুত্রসন্তানের নামকরণ করেন। (সহিহ মুসলিম-২১৩৫) মহান প্রভু ইবরাহিম (আ.)-কে তাঁর একান্ত বন্ধু হিসেবে ঘোষণা করেছেন এবং তাঁর প্রতিষ্ঠিত ধর্মের অনুসরণ করার নির্দেশ প্রদান করেছেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যে আল্লাহর নির্দেশের সামনে মস্তক অবনত করে সৎকাজে নিয়োজিত থাকে এবং ইবরাহিমের ধর্ম অনুসরণ করে, যিনি একনিষ্ঠ ছিলেন, তাঁর চেয়ে উত্তম ধর্ম কার? অপর আয়াতে আল্লাহপাক ঘোষণা করেন, ‘বলুন, আল্লাহ সত্য বলেছেন। সবাই ইবরাহিমের ধর্মের অনুগত হয়ে যাও, যিনি ছিলেন একনিষ্ঠভাবে সত্যধর্মের অনুসারী। তিনি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না।’ (সুরা আলে-ইমরান-৯৫)
আল্লাহ ইবরাহিমকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করেছেন। (সুরা আন নিসা-১২৫)
বিশ্বমানবতার হেদায়েত ও কল্যাণে এই ভূপৃষ্ঠে নবী আদম (আ.)-এর মাধ্যমে নির্মিত হয় পবিত্র কাবাঘর। এরপর শীষ (আ.) একবার সংস্কার করেন। ইবরাহিম (আ.)-এর যুগে মহাপ্লাবনে পবিত্র কাবাঘর নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। মহান প্রভু ইবরাহিম (আ.)-এর মাধ্যমে এই পবিত্র বরকতময় ঘর পুনর্নির্মাণের ব্যবস্থা করেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘স্মরণ করো, যখন ইবরাহিম ও ইসমাইল কাবাগৃহের ভিত্তি স্থাপন করছিলেন।’ (সুরা আল বাকারা-১২৭)
প্রজ্ঞাময় প্রভু স্বীয় বন্ধু ইবরাহিম (আ.)-কে বিশেষ কুদরতে লালন করে তাঁকে পূর্ণত্বের স্তর পর্যন্ত পৌঁছানো এবং তাঁর মহত্ত্বকে ফুটিয়ে তোলার জন্য প্রায় ৩০টি পরীক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। কোরআনে কারিমে ইরশাদ হচ্ছে, ‘যখন ইবরাহিমকে তাঁর পালনকর্তা কয়েকটি বিষয়ে পরীক্ষা করলেন, অতঃপর তিনি তা পূর্ণ করে দিলেন, তখন পালনকর্তা বললেন, আমি তোমাকে মানব জাতির নেতা করব। তিনি বললেন, আমার বংশধর থেকেও! তিনি বললেন আমার অঙ্গীকার অত্যাচারীদের পর্যন্ত পৌঁছাবে না।’ (সুরা আল বাকারা-১২৪) ইবরাহিম (আ.)-এর পরীক্ষার বিষয়বস্তুর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি হলো, কর্মক্ষেত্রে দৃঢ়তা যাচাই, নমরুদের অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ, মাতৃভূমি ও স্বজাতি ত্যাগ করে সিরিয়া হিজরত, বিবি হাজেরা (রা.) ও তাঁর দুগ্ধপোষ্য শিশু ইসমাইল (আ.)-সহ শুষ্ক পাহাড় ও উত্তপ্ত বালুকাময়, তৃণলতাহীন প্রান্তর মক্কা নগরীতে একাকিত্ব অবস্থান, ছেলে ইসমাইল (আ.)-কে নিজ হাতে কোরবানি করার নির্দেশ, কাবাগৃহ নির্মাণ এবং ১০টি খাসায়েল বা প্রকৃতিসুলভ কাজ জীবনে বাস্তবায়ন ইত্যাদি ছিল ইবরাহিম (আ.)-এর জন্য বড়ই কঠিন পরীক্ষা। ইবরাহিম (আ.) আল্লাহর পক্ষ থেকে নেওয়া সব পরীক্ষায় পরিপূর্ণভাবে সফলতা লাভ করেন। ফলে আল্লাহতায়ালা পুরস্কার হিসেবে ঘোষণা করেন, ‘আমি তোমাকে মানব জাতির ইমাম বানাব।’ (সুরা আল বাকারা-১২৪)
মুসলিম জাতির পিতা ইবরাহিম (আ.)-এর জীবনের শিক্ষা হলো, পরিপূর্ণ আল্লাহর প্রতি আস্থা ও তাঁর আনুগত্য। তাঁর গোটা জীবন ত্যাগ, বিসর্জন গাথা। তাঁর কর্ম ও জীবনে প্রতিটি মুসলমানের জন্য শিক্ষা রয়েছে। পরীক্ষা ও ত্যাগের ফলে আল্লাহ তাঁর নেক বান্দাদের কাছে টেনে নেন, সম্মান বাড়িয়ে দেন, উম¥তের নেতা বানিয়ে দেন।
লেখক : গবেষক, ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার, বসুন্ধরা, ঢাকা