সাদা রঙের গরু আমার পছন্দের। বাবার পছন্দ সুরমা রঙের। কোরবানির জন্য তিনি সুরমা রঙের গরু খুঁজতেন। গরু কিনতে পশুর হাটে যাওয়া ছিল তাঁর প্রিয় কাজগুলোর অন্যতম। এ সময় তাঁর সঙ্গে থাকতাম আমরা তিন ভাই। জাঁকের সঙ্গে পশুর হাটের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত বিরামহীন চক্কর দিতেন। সুরমা রং হলেই তাঁর চলত না; হালকা সুরমাবরণ গরু চাই। যে বছর ‘রোজগেরে ছেলে’ হলাম সে বছর থেকে তিনি ছেলের পছন্দের গরু কোরবানি দেওয়া শুরু করলেন। ঢাকা থেকে ঈদের আগের দিন বাড়ি এসে পৌঁছবে ছেলে। আসতে আসতে বিকাল হয়ে যাবে। তাই দৌহিত্র নয়নকে সঙ্গে করে একবার সকালে, আরেকবার দুপুরে হাটে গিয়ে কয়েকটি সাদা রং গরু ঠিক করে রাখলেন এবং ছেলে না আসা পর্যন্ত ওগুলো যাতে অবিক্রীত থাকে আল্লাহ আল্লাহ করলেন। ওই গরুগুলোর মধ্যে ছেলের যেটি পছন্দ সেটি কেনা হবে।
১৯৭৮ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি লোকান্তরে গেছেন বাবা। আজও প্রতি বছর ঈদুল আজহার আগে-পরে তাঁর অবয়ব চোখে ভাসতে থাকে। এখন কোরবানির ঈদের প্রাক্কালে গরু কিনে বাড়িমুখো হওয়া লোকদের পথচলা দেখি। তাদের মধ্যে আমার বাবার মতো ‘উপযুক্ত গরু’ কেনার আনন্দে প্রসন্ন চেহারার কেউ আছেন নাকি, খুঁজতে থাকি। কোনো কোনোবার ওরকম চেহারার ক্রেতা পেয়েও যাই। পাই আর স্মৃতিভারে কণ্ঠনালি টনটন করে ওঠে, অবর্ণনীয় বাষ্পে ভরে যায় চোখ, ঝাপসা হয়ে পড়ে দৃষ্টি। আসন্ন কান্নারোধের উপায় হিসেবে তখন নানা-নাতির রসচর্চা স্মরণ করি। কোরবানির গরু কেনাবেচার ব্যাপারে মানুষের কৌতূহল ঐতিহাসিক। কত টাকায় কেনা হলো জানতে চান অনেকে। ‘দাম নিছে কত ভাই?’- প্রশ্নের জবাব দিতে দিতে মেজাজ গরম হয়ে যায় নয়নের। সে বলে, নানু! দুই ডজন লোককে গরুর দাম বলেছি। এখনো টু-থার্ড পথ বাকি। তার মানে আরও চব্বিশজনের প্রশ্নের জবাব দিতে হবে? পারব না। আমি খুবই টায়ার্ড।
নাতিকে ক্লান্তি দূরীকরণ ফর্মুলা দিলেন নানা। সে অনুযায়ী প্রশ্নের উত্তর দেওয়া শুরু হয়। কত নিয়েছে দাম?- উত্তরে নয়ন বলে, ‘১৮ হাজার টাকা।’ প্রশ্নকর্তা বলেন, ‘ঠকেছো ভায়া। ১৬ হাজার হলে ঠিক হতো।’ কিছুক্ষণ পর আরেকজনের প্রশ্ন, ‘কত দাম নিয়েছে?’ নয়ন জানায়, ২০ হাজার। প্রশ্নকর্তার মন্তব্য, ‘ওরে বাপরে! বাজার তো কড়া হয়া গেছে।’ শুনে নানা-নাতির মজা-প্রাপ্তিজনিত হাহ্-হা হাসি। বড় ভাই বলেন, ‘দেখছসনি, জিগ্গাইলেই দাম দুই হাজার টিয়া করি বাড়াই দিতেছে।’ ব্যাপারটায় আমরা দুই ভাইও মজা পেলাম। নয়ন প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে একপর্যায়ে ‘৩৬ হাজারে কিনেছি’ বলায় স্তম্ভিত এক পৌঢ় বলেন, এ দামে তো দুইটা গরু কিনন যায়। হয় তুমি মহা ঠকা ঠকছো, নয় তো রং দিয়া কথা কয়া আমরারে টাসকি লাগায়া দিতেছ।’
২. আমার পছন্দকে সমুন্নত রাখতে বাবা যা করেছিলেন, বড় ভাইও তা-ই করলেন। সাদা গরু কোরবানি। বাবার আয়োজন ছিল পুরোপুরি তাঁর তহবিলে। আমরা চার ভাই কোরবানি দিই যৌথ উদ্যোগে। পশু কেনার দায়িত্ব বড় ভাইয়ের। তাঁর স্বভাবচরিত্রের সুনাম চারদিকে। নিদ্রাযাপন, পঠনপাঠন, ভ্রমণ-পর্যটন আর অতিথি সেবা কিংবা পানাহার সবকিছুতেই সময় ও পরিমিতির গুরুত্ব দিতেন তিনি। দিনে তিন কাপ চা খেতেন। এর বেশি ভুলেও কখনো নয়। বন্ধুরা বলতেন, রাষ্ট্রপতি অনুরোধ করলেও সে চতুর্থ কাপ খাবে না। অতীব নিয়মনিষ্ঠ এই মানুষটি হঠাৎ লিভার সিরোসিসকবলিত হয়ে চার মাসের মধ্যে দুনিয়া ছেড়ে চলে গেলেন।
‘প্রিয় বস্তু আল্লাহর নামে কোরবানি দিলে আল্লাহ খুশি হন। কথাটা শতভাগ সত্য, তা-ই না হুজুর?’ বড় ভাই জানতে চাইলে আমাদের এলাকার আলেম মাওলানা ইয়াকুব আলী বলেন, ‘অবশ্যই।’ বড় ভাই তখন আমার নামোল্লেখ করে বলেন, ‘তাইলে তো আমার ভাই ভালোই পারফর্ম করছে। সাদা গরু ওর প্রিয়। সেই প্রিয়কে প্রতি বছর সে কোরবানি দেয়।’ মাওলানা ইয়াকুব বলেন, সুবহানাল্লাহ।
ইয়াকুব আলীর ব্যবহার ও কণ্ঠ খুবই মিষ্ট। তাঁর কোরআন তেলাওয়াত ঘণ্টার পর ঘণ্টা শুনলেও আমার বিশ্বাস, শ্রোতার ক্লান্তিবোধ হতো না। ‘হয় না’ বলতে পারতাম, কিন্তু বলছি ‘হতো না’। কারণ এই শুদ্ধাচারী জ্ঞানী ধর্মানুরাগী ২০১২ সালে ইন্তেকাল করেছেন। ইয়াকুব আলী প্রদত্ত কোরবানিসংক্রান্ত একটি ব্যাখ্যা বড় ভাইর এতটাই পছন্দ হয়েছিল যে তিনি আমাদের অনেক আত্মীয়কে ওই ব্যাখ্যায় প্রভাবিত করেছিলেন।
ব্যাখ্যাটি ছিল- ‘কোরবানির গোশত তিন ভাগ করে এক ভাগ কোরবানিদাতা রাখবে; এক ভাগ আত্মীয়স্বজনকে দেবে, আরেক ভাগ দুস্থজনদের মধ্যে বিতরণ করবে মর্মে যে বিধান চালু রয়েছে, তা অক্ষরে অক্ষরে পালনের বাধ্যবাধকতা নেই। স্বজনদের না দিলে কোরবানি সার্থক হবে না- এরকম সিদ্ধান্তও অর্থহীন। প্রয়োজনে সব গোশত নিজে ভোগ করা যাবে। স্বজনদের মধ্যে যারা গোশত কেনার সামর্থ্য রাখে না, তাদের দেওয়া যুক্তিসংগত। সারা বছর খাওয়ার মতলবে কোরবানির গোশত ফ্রিজে সংরক্ষণ মানবিক আচরণ নয়। দুস্থদের যত বেশি বেশি করে গোশত দেওয়া যাবে, ততই সমাজের কল্যাণ।’
কোরবানির ঈদের দিন এবং ঈদের পরের দুই দিন পরিবারের সবাই তৃপ্তির সঙ্গে খেতে পারার মতো পরিমাণের গোশত রেখে বাকি সব গোশত দুস্থদের মধ্যে বণ্টন করতেন বড় ভাই। তাঁর সন্তানরা এই রীতি বজায় রেখেছে। তাঁর ভাইয়েরাও একই পন্থায় রয়েছে।
৩. কোরবানির পশু বেচাকেনা প্রক্রিয়ার অংশ যারা হন, তারা কমবেশি সবাই ফেলে আসা দিনের স্মৃতির ভারে স্বল্পতম সময়ের জন্য হলেও কাবু হন। বাবার সঙ্গে একবার গরু কিনতে গিয়ে যা দেখলাম, কথাশিল্পীরা তা দিয়ে হৃদয়ছোঁয়া গল্প লিখতে পারবেন। বড় মেয়ের ছোট ছেলে নয়ন তখন ক্লাস সিক্সের ছাত্র। তার পছন্দ হলদে রঙের গরু। বাবা ঘোষণা করলেন, এবার নাতি নয়নের পছন্দের গরু কেনা হবে। ব্যস, ক্রয় অভিযান শুরু। হাটের উত্তর থেকে দক্ষিণে মনোযোগ দিয়ে গরু দর্শন হলো। নয়নের একটিও পছন্দের না। ওর মামা শাজাহান ওর নানার না-শোনার মতো নিচুস্বরে বলে, ‘ফুটানি! মারুম এক থাপ্পড়! যে কোনো একটা পছন্দ করে কিন্না ফ্যাল কইলাম।’
‘পূর্ব-পশ্চিমে তো গরু দেখন হয় নাই মামা। দেইখা লই।’ বলল নয়ন, ‘বেশি ঘ্যানর ঘ্যানর কইরো না। নানুরে দিমুনি কইয়া। তোমাদেরই মারবে এক থাপ্পড়।’ ভাগনের হুমকিতে চুপসে যায় মামা। তবু বলে, ‘বাড়িত চল্। তোরে কী করি দেখিস।’ নয়ন এবার আরও ডর দেখায়, আজ সে সারা বাজার চক্কর দিয়ে একটা গরুও পছন্দ করবে না। নানাকে বলবে, আগামীকাল (ঈদের আগের দিন) আবার হাটে আসতে হবে।
করজোড়ে ইশারায় আত্মসমর্পণ করে শাজাহান। চুপিচুপি বলে, ‘ঠিক আছে। কিসসু কমুনা। আইজকাই কিন্না ফ্যাল্।’ নয়নও ফিসফিস করে সহাস্যে বলে, ‘ঈদের দিন সিনেমা হলে নিয়া যাবা না?’ শাজাহান বলে, ‘একশবার নিয়া যামু।’ নয়ন বলে, ‘য়্যাঁ... হ্! একবারই নিতে চাওনা, আবার একশবার নিবা! সত্যই নিবা মামা?’ সেই নয়ন যুবা বয়সে, দুই সন্তানের পিতা হওয়ার পর অকালে হার্টফেল করে মারা গেছে। নয়নের মৃত্যুর এগারো বছর পর দুই কিডনি বিকল হয়ে শেষনিঃশ্বাস ছাড়ে শাজাহান।
হাটের নানা কোণে ঘোরাঘুরি করেছি আমরা পাঁচজন- বাবা, নয়ন আর ওর তিন মামা। সন্ধ্যা হয় হয় সময়টায় নয়নের পছন্দের গরু পাওয়া গেল। টসটসে নাদুসনুদুসদেহী গরু। শহর থেকে সাত মাইল দূরের গ্রাম থেকে তাকে নিয়ে এসেছেন এক কৃষক। দরাদরির পর কেনা হলো। বাবার উদ্দেশে কৃষক বলেন, ‘কর্জ শোধ করবার পারতেছি না চাচা। উপায় নাই দেইখা আমার শাহজাদারে বেইচতে আনলাম।’ হাউমাউ করে তিনি কাঁদতে থাকেন। বড় ভাই লোকটাকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দেন। জানতে চান, যে দাম পেলেন তাতে ঋণ শোধের পর হাতে কিছু থাকবে? কৃষক জানান, বার শ টাকার মতো থাকবে। বাবা নির্দেশ দিলেন : ওনারে আরও দেড় হাজার দাও।
দড়িতে বাঁধা গরু। দড়িটা নয়নের হাতে দিলেন বিক্রেতা। দড়িতে টান দেয় নয়ন। গরু নড়ে না। বড় ভাই পেছন থেকে ধাক্কা দেন, তবু নড়ে না, শক্ত পায়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কৃষক এগিয়ে এসে গরুর দুই চোয়ালে হাত বুলিয়ে আদর করতে করতে বলেন, ‘যা বাবা শাহজাদা যা। তোরে ভালো মাইনষেগোর কাছে দিছি যা।’ এবার হাঁটতে শুরু করে গরু। দেখি, ওর দুচোখের পানি গড়িয়ে পড়ছে। পাশেই দাঁড়ানো ওর পালক। তার চোখেও পানি। ‘শাহজাদা’কে নিয়ে হাটের গেটের দিকে রওনা দিলাম। কিছু দূর গিয়ে পেছন ফিরে দেখি, কৃষকটি তাঁর প্রিয় শাহজাদার যাওয়ার দিকে বিহ্বল হয়ে তাকিয়ে রয়েছেন আর বারবার গামছা দিয়ে চোখের পানি মুছছেন। ঘটনাটি ১৯৮৩ সালে ‘সংবাদ’ অফিসে বর্ণনা করেছিলাম সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের কাছে। তিনি বললেন, এ ধরনের কৃষকের কান্না আড়াল করার জন্য পাহাড়ের প্রয়োজন। বিরাট পাহাড়। যেসব সমস্যায় পড়ে কৃষক তার সম্বল হারায়, হারিয়ে কাঁদে আর কাঁদে, সেসব সমস্যা দূর করার ব্যবস্থাই হবে সেই পাহাড়। ব্যবস্থাটা বলবৎ যিনি বা যারা করবেন, তারাই পাহাড়। এরকম পাহাড় ছোট ছোট আকারে ক্রিয়াশীল রয়েছে প্রচারহীন। চমকপ্রদ কিছু ঘটার পরই সাধারণ জনের নজরে আসে সেই পাহাড়ের অস্তিত্ব।
৪. সাইনবোর্ডে লেখা ‘এখানে এলেম দ্বারা চোর ধরা হয়।’ আমার বন্ধু হেলাল উদ্দিন মুহাম্মদ বদরুল ইসলাম ধরনা দেন ওই গুনিনের কাছে। তেলমাখানো পানকে মন্ত্রপূত করলে পানপাতাটি ‘আয়না’ হয়ে যায়। সেই আয়না দেখে চোর শনাক্ত করার জন্য দিতে হয় ৭২১ টাকা ৭ পয়সা। জটাধারী দাড়িমুখ কালো জোব্বা পরা গুনিন মন্ত্রপূত পানের দিকে তাকিয়ে চোরের গতিবিধি দেখেন আর ধারাবিবরণী দেন; ‘ট্রাউজার পরা চোর ঘরে ঢুকে চুপি চুপি একটা ড্রেসিং টেবিলের দিকে যাচ্ছে। টেবিলের ড্রয়ার খুলে হাতিয়ে কী একটা জিনিস বের করে প্যান্টের পকেটে ঢোকায়...।’
আর কিছু বলতে হয়নি। গুনিনের নাকে প্রচণ্ড ঘুসি মারলেন হেলাল। গুনিনের আস্তানার পান্ডারা এগিয়ে আসে। তাদেরও ধুমসে পিটুনি দিলেন হেলাল। গুনিনসহ পাঁচ ব্যক্তি জখম। পুলিশ এসে সন্ত্রাসের অভিযোগে ধরে নিয়ে যায় হেলাল উদ্দিন মুহাম্মদ বদরুল ইসলামকে। থানায় গেলাম তাকে ছাড়িয়ে আনতে। বলি, ‘এরকম পিটুনি দেওয়ার কারণ কী?’ হেলাল বলেন, ‘আগে বল আস্ত একটা গরু প্যান্টের পকেটে পোরা যায়?’
প্রকৃত ঘটনা জানা গেল। হেলাল তিনটি কচি ছেলেমেয়ের কান্না আড়াল করা পাহাড় হতে চেয়েছিলেন। তার বাসার পাশের বাসায় কিশোর বয়সের দুই মেয়ে ও এক ছেলে বিলাপ করছিল কোরবানির গরু চুরি হয়ে যাওয়ার দুঃখে : গরু নেই, আমাদের ঈদ হবে কিসে। হেলাল বলেন, ‘পোলাপানের কাঁদন সইতে না পাইরা গরু খুঁজতে বারইছিলাম রে দোস্ত। এখানে যাই, ওখানে যাই। গুনিন পাইয়া খুশি হইছিলাম। তারে কইলাম, একটা জিনিস চুরি হইছে। জিনিসটা যে গরু তা কই নাই। ব্যাডায় পান চালান দিয়া কয়, চুরি যাওয়া মাল পকেটে ঢুকানো হইছে। হ্যায় কইলো আর আমি মাইনা নিমু! আমারে ব্যাডায় গরু পাইছে?’
লেখক : সাংবাদিক