বাংলাদেশের আধুনিক গানের জনপ্রিয় শিল্পী শাকিলা জাফর। আশির দশকের শুরু থেকে গানের জগতে তার সফল পদচারণ। তিনি এখন পর্যন্ত অসংখ্য মনে রাখার মতো গান শ্রোতাদের উপহার দিয়েছেন। তার সংগীতজীবনের নানা বিষয় নিয়ে লিখেছেন- আলী আফতাব
যদিও তিনি মীন রাশির জাতিকা, তবু তাকে ‘তুলা রাশির মেয়ে’ বললে ভুল বলা হবে না। কারণ ‘তুলা রাশি’ শীর্ষক একটি গানই প্রথম তাকে এনে দেয় ব্যাপক পরিচিতি। হ্যাঁ, তিনি শাকিলা জাফর। আমাদের গানের ভুবনে শাকিলা জাফর পথ চলছেন তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে। এই দীর্ঘ পথচলায় তিনি গেয়েছেন শ্রোতাপ্রিয় অসংখ্য গান। অডিও সেক্টর আর প্লেব্যাকের পাশাপাশি স্টেজ প্রোগ্রামেও এতদিন ধরে রেখেছেন জনপ্রিয়তা।
গানের পাখি শাকিলা জাফর তার দীর্ঘ পথচলায় জনপ্রিয়তার পেছনে ছোটেননি, বরং জনপ্রিয়তাই ছুটেছে তার পেছনে। গান গাওয়ার ক্ষেত্রে কখনো আপস করেননি। প্রলোভনের কাছে মাথানত না করে একাধিকবার তাকে নকল ও বিকৃত গান গাইতে অস্বীকৃতি জানাতে দেখা গেছে। আজেবাজে গান গাইবেন-ই বা কেন? ধ্রুপদী গানকে অবলম্বন করে যার পথ চলা শুরু, তাকে আপস করা মোটেও মানায় না। যখন থেকে বুঝতে শিখেছেন তখন থেকেই গানের সঙ্গে তার সখ্য। ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশ বেতারে অনুষ্ঠিত জাতীয় উচ্চাঙ্গ প্রতিযোগিতায় শাকিলা জাফর প্রথম স্থান অর্জন করেন। এরপর তিনি বেতারে নিয়মিত গান পরিবেশন করা শুরু করেন। উচ্চাঙ্গসংগীত ছাড়া শুরুর দিকে ক্ল্যাসিক ও নজরুলসংগীত গেয়েছেন। পরে আধুনিক গানও গাইতে শুরু করেন। আজকের মতো এত টিভি চ্যানেলের ছড়াছড়ি তখন ছিল না। বিটিভিই ছিল একমাত্র ভরসা। বিটিভিতে নবীন শিল্পীদের অংশগ্রহণে একটি গানের অনুষ্ঠানে ‘তুলা রাশির মেয়ে...’ গানটি গেয়ে তিনি আলোচনায় উঠে আসেন। ১৯৮৩ সালে প্রয়াত ফজলে লোহানীর জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘যদি কিছু মনে না করেন’-এ গানটি পরিবেশন করার পর শাকিলা জাফরের কেবলই এগিয়ে চলা। একের পর এক অডিও অ্যালবাম, দেশ ও দেশের বাইরে বছরজুড়ে স্টেজ শো, নিয়মিত টিভি প্রোগ্রাম, সিনেমার প্লেব্যাক সবখানেই শাকিলা জাফর উজ্জ্বল-উচ্ছল। নিজের দীর্ঘ সংগীতজীবনকে কীভাবে মূল্যায়ন করেন? এ প্রশ্নের উত্তরে শাকিলা জাফর বললেন, নিজেকে মূল্যায়ন করা কঠিন। এ কাজটি করবেন শ্রোতা-দর্শক আর সংগীতপ্রিয় মানুষ। আমি চর্চা আর সাধনাটাকে সবসময় বড় মনে করি। এখনো আমি সাধনা বা চর্চার মধ্যে আছি। একজীবনে যা শেষ হবে না। সবসময় ভালো গান গাইতে চেয়েছি। জনপ্রিয় শিল্পী হতেই হবে এমন কোনো চাহিদা আমার কখনো ছিল না। সংখ্যার চেয়ে মানের বিষয়টিই সবসময় আমার কাছে প্রাধান্য পেয়েছে। পথ চলার ত্রিশ বছরে যদি আমি ৫টি ভালো গান গেয়ে থাকি তাতেই আমি সার্থক। শিল্পী তো আজীবন বেঁচে থাকে না, সৃষ্টিই তাকে বাঁচিয়ে রাখে। ‘আমার গানের মধ্যেই আমি বেঁচে থাকতে চাই।’
গানের জগতে শুরুটা নিয়ে বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘এটা বলতে গেলে একদম ছোটবেলায় ফিরে যেতে হবে। মধ্যবিত্ত রক্ষণশীল পরিবারে আমার জন্ম। এমন একটি পরিবারের মেয়ে হয়ে বাসার বাইরে গিয়ে গান করার চিন্তাটাই ছিল অকল্পনীয়। কিন্তু ম্যাট্রিক পরীক্ষার পর তিন মাসের ছুটিতে বাবা আমাকে গান শেখানোর ব্যাপারে আগ্রহী হন। তাঁর আগ্রহে শ্রদ্ধেয় মিথুন দের কাছে গানের তালিম নিতে শুরু করি। গান শেখানোর একটা পর্যায়ে ওস্তাদজি বাবাকে অনুরোধ করেন, আমাকে যেন সংগীতবিষয়ক বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে দেওয়া হয়। শুধু তা-ই নয়, তিনি নানাভাবে উৎসাহ ও পরামর্শ দিতেন যাতে আমি সংগীতসংশ্লিষ্ট প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করি। সেই থেকে আমার সংগীতজীবনের যাত্রা শুরু। একটা সময়ে চলচ্চিত্রে গান গাওয়ার প্রস্তাব আসা শুরু হলো। চলচ্চিত্রে গান করার ব্যাপারে প্রথমে পরিবারের সদস্যরা নেতিবাচক মনোভাব দেখালেও পরে তা স্বাভাবিক হয়ে যায়। শুরু থেকেই আমি সময়ের সঙ্গে থাকার চেষ্টা করেছি। এখনো করছি। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে আমি আমার গায়কি ও পোশাকে পরিবর্তন আনার চেষ্টা করেছি। এটা সব সময় অব্যাহত থাকবে।’ বাংলাদেশের অনেক গায়িকাই বিভিন্ন গায়কের সঙ্গে জুটি বেঁধে দ্বৈত গান গেয়েছেন। তবে দ্বৈত গানে শাকিলা জাফরই সবচেয়ে সফল শিল্পী। তিনি যখন যার সঙ্গে গান গেয়েছেন, মানিয়ে গেছেন ভীষণভাবে। প্রথমে গায়ক শুভ্রদেবের সঙ্গে তার গড়ে উঠেছিল সফল গানের জুটি। তারপর কুমার বিশ্বজিৎ, সুবীর নন্দী, তপন চৌধুরী, নকিব খানের মতো সিনিয়র শিল্পী থেকে শুরু করে হালের আসিফ ও বাপ্পা মজুমদারের সঙ্গেও গেয়েছেন বহু গান।
মাঝে সিনেমার প্লেব্যাক থেকে নিজেকে খানিকটা গুটিয়ে নিয়েছিলেন শাকিলা জাফর। কারণ গানের কথায় অশ্লীলতা আর সুরে নকলের প্রাদুর্ভাব। আজেবাজে লিরিক আর নকল সুর হওয়ায় স্টুডিওতে গিয়েও গান গাইতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বেরিয়ে এসেছেন একাধিকবার। হালে মিষ্টি হাওয়া বইতে শুরু করায় প্লেব্যাকে আবারও ফিরে এসেছেন। চাষী নজরুল ইসলাম পরিচালিত ‘রঙিন দেবদাস’ ছবির প্লেব্যাকে অংশ নিয়েছেন। গাজী মাজহারুল আনোয়ারের কথা ও ইমন সাহার সুরে জনপ্রিয় শিল্পী বাপ্পা মজুমদারের সঙ্গে একটি দ্বৈতগান গেয়েছেন শাকিলা জাফর। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘একটা সময় আমাদের মিউজিক ইন্ডাস্ট্রি ছিল প্লেব্যাক নির্ভর। আজও পুরনো দিনের ছবির গান শুনলে মানুষ মুগ্ধ হন। কিন্তু মাঝখানে চলচ্চিত্রে ভালো গান হয়নি। তাই নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলাম। এখন সিনেমায় ভালো গান করার চেষ্টা চলছে। আমি সেই চেষ্টায় অংশ নিতে চাই বলেই আবার প্লেব্যাক করছি।’
বর্তমানের গান প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আগে শিল্পীদের ব্যস্ততা ছিল বিটিভিকেন্দ্রিক। একটা চ্যানেল হওয়ার কারণে তখন মানুষ খুব আগ্রহ নিয়ে সব ধরনের অনুষ্ঠান দেখতেন। আর অনুষ্ঠানসংশ্লিষ্টরাও অনেক যতœ নিয়ে অনুষ্ঠান বানাতেন। অনুষ্ঠানের মানের ব্যাপারে সচেতন থাকতেন। শিল্পীরাও দর্শক- শ্রোতাদের নিজেদের সেরাটুকু উপহার দেওয়ার চেষ্টা করতেন। সবকিছু মিলিয়ে একটা গান কিংবা অনুষ্ঠান অন্য রকম একটা উচ্চতায় চলে যেত। এখন আগের মতো ভালো গান হচ্ছে না এটা মানতে রাজি নই আমি। তবে এটা ঠিক যে, এখন বেশির ভাগ গান দীর্ঘ সময় ধরে শ্রোতাদের কাছে আবেদন রাখতে পারছে না। আমি বরাবরই শুদ্ধতায় বিশ্বাস করি। আজকাল অটো টিউনার দিয়ে গান করার একটা প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এটাকে আমি সমর্থন করি না। হয়তো এই কারণে এই সময়ের অনেক শিল্পীর গানে সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও পুরোপুরি হৃদয়গ্রাহী হয়ে উঠছে না। আমি মনে করি, অটো টিউনার দিয়ে গান করে শিল্পী নিজের সঙ্গে প্রতারণা করছে। আর নিজের সঙ্গে প্রতারণা করার পাশাপাশি সে শ্রোতাদের সঙ্গেও প্রতারণা করে যাচ্ছে। এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। একটা কথা সত্য যে, বিটিভি একমাত্র চ্যানেল হওয়ার কারণে দর্শকের মনোযোগ পাওয়াটা অনেক সহজ ছিল। মনে আছে, বিটিভিতে কোনো অনুষ্ঠান করার পরদিন অনেক প্রশংসা পেতাম। কারণ বেশির ভাগ মানুষই অনুষ্ঠান দেখতেন। এখন সবাইকে অনুষ্ঠানের সময়সূচি জানানোর পরও দেখার সময় পান না। সেদিক থেকে বলতে হয়, ‘এই প্রজন্মের শিল্পীরা অনেক দুর্ভাগ্যবান। অনেক প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে প্রতিনিয়ত তাদের প্রমাণ করতে হয় নিজেকে। তবে এটা ঠিক, ভালো গান হলে শ্রোতারা শিল্পীকে নিরাশ করবে না। হোক সে নতুন প্রজন্ম কিংবা আগের প্রজন্ম। সবকিছুর আগে গুণগত ব্যাপারটি নিশ্চিত করতে হবে।’
গত তিন দশকে অনেক জনপ্রিয় গান উপহার দিয়েছেন এই শিল্পী। তার পরও কিছু অপূর্ণ ইচ্ছা আছে তার মনে। তিনি বলেন, আমার শুরুটা হয়েছিল উচ্চাঙ্গসংগীত দিয়ে। বাংলাদেশ বেতারে উচ্চাঙ্গসংগীত বিভাগে জাতীয় পুরস্কারও অর্জন করেছিলাম। এখন বিষয়টা মনে পড়লে খুব কষ্ট পাই। অনেকে আবার আমার কাছে অভিযোগ করেন, কেন আমি খেয়াল, ঠুমরি কিংবা টপ্পার কোনো অ্যালবাম করলাম না? তখন মনে হয়, আমি শ্রোতাদের বঞ্চিত করেছি। নিজেকে বঞ্চিত করেছি। হয়তো সামনে সুযোগ পেলে এই অসম্পূর্ণ কাজটা সম্পূর্ণ করব। গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশে খুব একটা দেখা যাচ্ছে না তাকে। দিল্লিতে বসবাস করছেন তিনি। নিজের নামের শেষ ভাগ থেকে জাফর অংশটি ঝেড়ে ফেলেছেন নতুন বিয়ের পর থেকে। এখন তিনি ‘শাকিলা শর্মা’। বিয়ে করেছেন মুম্বাইবাসী রবি শর্মাকে। তার নামের পদবিই এখন যুক্ত হয়েছে শাকিলার সঙ্গে।
শাকিলা জাফরের কাছে তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, খুব বেশি পরিকল্পনা করে আমি কখনো পথ চলিনি আর চলতে চাইও না। গান নিয়ে আছি, গান নিয়ে থাকতে চাই, ভালো গান করতে চাই। এই হলো আমার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা।