সোমবার, ২৬ ডিসেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

সিনেমা হলের সুদিন ফিরেছে চট্টগ্রামে

আলাউদ্দীন মাজিদ

সিনেমা হলের সুদিন ফিরেছে চট্টগ্রামে

চট্টগ্রামে ফিরছে সিনেমা হলের সুদিন। মানসম্মত সিনেমা হল পেয়ে দর্শক আবার ছবি দেখতে হলমুখী হয়েছে। তবে সিনেমা হল মালিকরা বলছেন, শুধু মানসম্মত সিনেমা হল দিয়ে দর্শক ধরে রাখা যাবে না। একই সঙ্গে প্রয়োজন উন্নত চলচ্চিত্র। ভালো চলচ্চিত্রের অভাবেই সারা দেশের মতো চট্টগ্রামের প্রায় সব সিনেমা হল বন্ধ হয়ে গেছে। চট্টগ্রামে নব্বই দশকের শেষদিক পর্যন্ত সিনেমা হল ছিল ২৭টি। ২০০০ সালের পর থেকে ছবিতে ভালো গল্প, গান, নির্মাণ ও অভিনয়ের নিম্নগামিতা এবং সিনেমা হলের নোংরা পরিবেশের কারণে দর্শকশূন্যতায় এই সংখ্যা এসে ঠেকে দুটিতে। সর্বশেষ করোনার প্রথম ধাপে ২০২০ সালের দিকে স্থানীয় কাজীর দেওড়ি এলাকায় বন্ধ হয়ে যায় ‘আলমাস’ সিনেমা হলটি। একই চত্বরে অবস্থিত ‘দিনার’ সিনেমা হলটি বন্ধ হয়েছিল বেশ আগেই। মানসম্মত চলচ্চিত্র পেলে যে দর্শক পরিবার নিয়ে সিনেমা হলে ছুটে যায় তার প্রমাণ কয়েকবার মিলেছে। যেমন মনপুরা, মোল্লাবাড়ির বউ, হৃদয়ের কথা, সত্তা, আয়নাবাজি, ঢাকা অ্যাটাক, পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রেমকাহিনি, পোড়ামন টু, হাওয়া, পরাণ, গলুই, পাসওয়ার্ড, দিন : দ্য ডে, দেবী, রেহানা মরিয়ম নুরসহ আরও কয়েকটি রুচিসম্মত চলচ্চিত্র ২০০৫ সাল থেকে চলতি বছর পর্যন্ত মুক্তি পেয়েছে। এসব ছবির দর্শকপ্রিয়তা দেখে কয়েক বছর আগে চট্টগ্রামে প্রথম মাল্টিপ্লেক্স ‘সিলভার স্ক্রিন’ প্রতিষ্ঠিত হয়। এতে করে উন্নত মানের সিনেমা হল পেয়ে দর্শক উৎসাহ নিয়ে এই মাল্টিপ্লেক্সে ছবি দেখতে ভিড় করতে থাকে। চট্টগ্রামে মাল্টিপ্লেক্সে দর্শক আগ্রহ দেখে ঢাকার স্টার সিনেপ্লেক্স কর্তৃপক্ষ সেখানে মাল্টিপ্লেক্স নির্মাণে উদ্যোগী হয় এবং ২ ডিসেম্বর স্টার সিনেপ্লেক্স চালু করে। ফলে এই বাণিজ্যিক নগরীতে দুটি অত্যাধুনিক সিনেমা হল পেয়ে দর্শক ছবি দেখতে বেশ স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে এখন। তবে এসব মাল্টিপ্লেক্স মালিক ও দর্শকদের অভিন্ন অভিযোগ হলো- নিয়মিত মানসম্মত ছবি পাওয়া যায় না বলে ছবি প্রদর্শন ও দর্শনে সমস্যা দেখা দিচ্ছে। তারা নির্মাতাদের কাছে জোর অনুরোধ করে বলছেন- আপনারা ভালো মানের পর্যাপ্ত ছবি দিন। তাহলে দেশের এই বাণিজ্যিক রাজধানীতে আবার সিনেমার ব্যবসা রমরমা হয়ে ওঠবে এবং এতে করে চলচ্চিত্র জগৎ ফিরে পাবে প্রাণ ও কৌলিণ্য। বর্তমানে চট্টগ্রামে যে চারটি সিনেমা হল ও মাল্টিপ্লেক্স চালু রয়েছে সেগুলো হচ্ছে- সিলভার স্ক্রিন, সিনেমা প্যালেস, সুগন্ধা সিনেমা ও স্টার সিনেপ্লেক্স। একসময় চট্টগ্রামে মোট ২৭টি সিনেমা হল ছিল। প্রতিটিতে ছিল দেশীয় চলচ্চিত্রের রমরমা ব্যবসা। এই হলগুলো হলো- আলমাস, দিনার, মেলোডি, সঙ্গীত, নূপুর, সাগরিকা, উপহার, অলংকার, আকাশ, গুলজার, রঙ্গম, উজালা, জলসা, লায়ন, বনানী, সানাই, রিদম, চাঁদনী, সিনেমা প্যালেস ও কর্ণফুলী। এর মধ্যে ২৫টি সিনেমা হল ভেঙে গড়ে ওঠে বহুতল মার্কেট। বন্ধ হয়ে যাওয়া হলের মালিকদের সবাই ভালো ছবি না থাকায় দর্শকের অভাবে লোকসান গুনতে গুনতে বাধ্য হয়ে সিনেমা হলের ব্যবসা ছেড়ে জীবিকার টানে চলে গেছেন অন্য ব্যবসায়। সম্প্রতি চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠিত স্টার সিনেপ্লেক্সের চেয়ারম্যান মাহবুব রহমান বলেন, ‘করোনা মহামারিতে অন্যদের মতো আমরাও অনেক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিলাম। করোনা-পরবর্তী সময় ‘পরাণ’ ও ‘হাওয়া’ সিনেমা দুটি চালিয়ে সিনেপ্লেক্সে আমাদের ব্যবসা ফিরেছে। ভালো সিনেমা নির্মিত হলে মানুষ সিনেমা হলে এসে অবশ্যই সিনেমা দেখবে। সে কারণে চট্টগ্রামে সিনেপ্লেক্স নির্মাণের সাহস দেখিয়েছি।’ চট্টগ্রামের সুগন্ধা সিনেমার মালিক শাহাদাত বলেন, ‘সিনেমা হলের পরিবেশ আগে ভালো হতে হবে। এখন ৫০০ সিটের হল বানিয়ে লাভ নেই। কমসংখ্যক মানুষের জন্য মানসম্মত হল বানাতে হবে। আমাদের এখানে সেটা করার চেষ্টা করেছি। এখানকার পরিবেশ অনেক উন্নত। সব বয়সী দর্শক এখানে সিনেমা দেখতে আসেন। শুধু সিনেমা বানালে হবে না, সিনেমার সঙ্গে প্রচারণার বিষয়গুলো তারকাদের মাথায় রাখতে হবে। ভালো গল্প, প্রচারণা, সিনেমা হলের পরিবেশ ভালো হলে মানুষ সিনেমা দেখতে আসবেই।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের এখানে ‘মিশন এক্সট্রিম’ মীর সাব্বির পরিচালিত ‘রাত জাগা ফুল’, আজমেরি হক বাঁধন অভিনীত ‘রেহানা মরিয়ম নুর’-এর মতো সিনেমাগুলো ভালো ব্যবসা করেছে। ‘হাওয়া’র মতো সিনেমা তো সবসময় হয় না। ‘হাওয়া’ ও ‘পরাণ’ সিনেমাগুলো ভালো ব্যবসা করেছে আমাদের হলে। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার সিনেমা ‘মেইড ইন চিটাগং’ আমাদের হলে ভালো ব্যবসা করেছে। পার্থ বড়ুয়া অভিনীত এই সিনেমাটি হাউসফুল চলেছে আমাদের সিনেমা হলে। এ ছাড়া শাকিব খান অভিনীত সিনেমাগুলো মুক্তি পেলে মানুষ এমনিতেই হলে আসে।’ সিনেমা প্যালেসের কর্মকর্তা গৌরপদ চৌধুরী বলেন, ‘অনেক সমস্যার মধ্যে আমরা এখন টিকে আছি। মাঝে মধ্যে দুই-একটি সিনেমা ভালো ব্যবসা করে। এই ধারাবাহিকতা বজায় রাখা প্রয়োজন। তাহলেই সিনেমার ব্যবসা টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে।’ চট্টগ্রামে চলচ্চিত্রচর্চার ইতিহাস অনেক পুরনো। বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে গত শতাব্দীর শুরুর দিকে চট্টগ্রামের সিনেমা হলগুলো তৈরি হতে থাকে। বিলুপ্ত লায়ন সিনেমা হলের বয়স শত বছরের কাছাকাছি। সত্তর, ষাট এবং আশির দশকেও চট্টগ্রামের সিনেমা হলগুলোতে সগৌরবে চলচ্চিত্র প্রদর্শন করা হয়। তবে নব্বই দশকের শেষদিকে এসে সিনেমা হলগুলোর ‘অপমৃত্যু’ ঘটতে থাকে। মানসম্মত ছবি না থাকায় দর্শকের অভাবে একের পর এক বন্ধ হয়ে যেতে থাকে সিনেমা হল। চট্টগ্রামের দর্শকরা বলছেন, আমাদের ভালো লাগছে চট্টগ্রামে সিনেমা দেখার আধুনিক ব্যবস্থায় দুটি সিনেপ্লেক্স প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এতে করে এখানে সিনেমা হলে গিয়ে ছবি দেখার জোয়ার আবার শুরু হয়েছে। এই আশার আলো জ্বালিয়ে রাখতে এখন পর্যাপ্ত পরিমাণে মানসম্মত ছবি দরকার। তাহলে বহু সমৃদ্ধ ইতিহাসের সাক্ষী এই বন্দরনগরী থেকেই শুরু হবে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের সাফল্যের বিপ্লব।

সর্বশেষ খবর