শুক্রবার, ১২ মে, ২০২৩ ০০:০০ টা

ভাইরাল সাংস্কৃতির উদ্ধার কীভাবে

ভাইরাল সাংস্কৃতির উদ্ধার কীভাবে

সংগীত, সিনেমা, নাটক সবকিছুর ভাইরাল চান সবাই। সাংস্কৃতিক অঙ্গনে এখন ভাইরাল দাপট চলছে।  এই পরিস্থিতির উত্তরণ নিয়ে বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের মতামত তুলে ধরেছেন- আলাউদ্দীন মাজিদ ও পান্থ আফজাল

 

এদের বর্জন করতে হবে : ববিতা

এ অবস্থাকে অবক্ষয় ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। সাংস্কৃতিক অঙ্গনে এখন বেশির ভাগই কারা আসছে, কারা কাজ করছে, তাদের ব্যাকগ্রাউন্ড কেমন এটা একটা ধোঁয়াশার মধ্যেই রয়ে যাচ্ছে। ফলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে। সংস্কৃতির নামে অপসংস্কৃতি মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। আমরা যখন কাজ করতাম তখন শুধু কাজটাকেই ভালোবাসতাম, আত্মপ্রচারের কোনো চিন্তা বা মানসিকতাই আমাদের ছিল না। ভালো কাজের মাঝেই আমাদের পরিচিতি এসেছে এবং সেই পরিচিতি এখনো অটুট আছে। আসলে এ ধরনের ভাইরাল হওয়ার মানসিকতার অর্থ হলো বিকৃত রুচি ও শিক্ষা-দীক্ষার অভাবের পরিচয় দেওয়া। এ অবস্থা থেকে উদ্ধারে যারা এমন অপকর্মে লিপ্ত তাদের সাংস্কৃতিক জগৎ থেকে বর্জন করে এই জগৎকে কলুষমুক্ত করতে হবে। না হলে গুটিকয় অশিক্ষিত-কুশিক্ষিতর জন্য আমাদের দেশের প্রিয় সংস্কৃতি জগতের মান মর্যাদা আরও নষ্ট হয়ে যাবে।

 

বিবেকবোধ জাগ্রত করতে হবে : সোহেল রানা

এ অবস্থা থেকে উদ্ধার পাওয়ার সঠিক পথ স্বল্প সময়ে আবিষ্কার করা দুরূহ। এর জন্য দরকার সুশিক্ষা ও মানবিক গুণাবলির সমাহার। এ দুটি জিনিসের বর্তমানে খুবই অভাব বলে আমাদের সাংস্কৃতিক জগতে যে সে প্রবেশ করে তাদের নানা অপকর্মের মাধ্যমে জগৎটিকে কলুষিত করে চলছে। বিষয়টি এমন নয় যে, রোগ হলো আর ওষুধ খেলাম তারপর ভালো হয়ে গেলাম। এর জন্য সবার সচেতনতা দরকার। একটি ছুরি যখন একজন দুর্বৃত্তের হাতে যায় তা তখন খুন বা জখমের হাতিয়ার হয়ে যায়, আবার একই ছুরি যখন চিকিৎসকের হাতে যায় তখন তা জীবন রক্ষার বস্তুতে পরিণত হয়। সোশ্যাল মিডিয়ার এ অন্যায় ভাইরাল সংস্কৃতি এখন দুর্বৃত্তের হাতের ছুরির মতো হয়ে গেছে। সৃষ্টিকর্তা সবাইকে ভালোমন্দ বোঝার ক্ষমতা দিয়েছেন। বিবেকবোধ সবার মধ্যে জাগ্রত করতে হবে। এর জন্য প্রয়োজনে সরকার ও সমাজের উচ্চ স্তরের দায়িত্ববানদের উদ্যোগ নিতে হবে। না হলে আমাদের সাংস্কৃতিক জগৎ এক সময় একেবারেই ধ্বংস হয়ে যাবে।

 

শুভবুদ্ধির উদয় হোক : মামুনুর রশীদ

এখন তো টেকনোলজির সময় চলছে। আমি এ নিয়ে কী আর বলব। প্রযুক্তির উন্নয়ন তো আর থামছে না। এ বিষয়ে আমার একটাই কথা, সবার শুভবুদ্ধির উদয় হোক। এটা ছাড়া উত্তরণের আর তো কোনো উপায় দেখছি না। এটা এখন আমাদের একমাত্র আশ্রয়। প্রযুক্তি এমনভাবে আমাদের আঁকড়ে ধরেছে যে, দিনকে রাত আর রাতকে দিন করছে। আর এখন তো শুরু হয়েছে ভাইরাল কালচার! এটার জন্য তো দায়ী আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা। খুবই নাজুক পরিস্থিতিতে রয়েছে। সঠিক বিদ্যার অন্বেষণে নেই আমরা এখন। চিন্তারাজ্যে এখন আর কোনো শিক্ষা পৌঁছাচ্ছে না, কোনো ভাবনা তৈরি হচ্ছে না। আমরা বই পড়ি জ্ঞানের অন্বেষণে। সেই কাজটা কি আর হচ্ছে? প্রযুক্তির কারণে এখন সব হাতের মুঠোয়। তবে শুভবুদ্ধির উদয় হচ্ছে না, যেটা এই মুহূর্তে খুবই প্রয়োজন।

 

খারাপ জোয়ারকে টেনে ধরতে হবে : ডলি জহুর

আমি আসলে ভাইরাল কিছু বুঝি না। এখন তো মোবাইলে বিভিন্ন বিষয় দেখতে না চাইলেও চলে আসে। অসহ্য লাগে! কীসব জঘন্য রিল চলে আসে চোখের সামনে। সৃষ্টির প্রথম থেকেই তো মানুষ বিকৃত জিনিস বেশি পছন্দ করে। আমাদের মন-মানসিকতা তো শয়তান ঘোরাইতে পারে। নতুন প্রজন্মদের নিয়ে কী বলব, এখন তো নামাজি লোক বা ইসলামী মন-মানসিকতা লোকও এই মোবাইল আসক্তিতে পড়ে গেছে। আমি নেতিবাচক ভাইরাল বিষয় নিয়ে তীব্র প্রতিবাদ করি। এখন তো ছেলেমেয়েরা বাবা-মাকেই ঠিকমতো টাইম দেয় না; সর্বদা মোবাইল নিয়ে পড়ে থাকে। অ্যাডাল্ট মন হয়ে গেছে আমাদের। আমি মনে করি, আইন করে মোবাইলে কী দেখবে, কী দেখবে না সেটা ঠিক করা উচিত। আর পজিটিভ তো অনেক বিষয় আছে। আমাদের বিশাল সমৃদ্ধ সংস্কৃতি, আমাদের ইতিহাস-এগুলো নিয়ে ভাইরাল কম হয়। আমরা শুধু নেগেটিভ বিষয়কে ভাইরাল করি। যেমন মোবাইলে ফেসবুক বা সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে আমরা দরকারি অনেক কিছুই করতে পারি। আসলে কোথাও যেন কিছু একটা খারাপ জোয়ার বইছে। সেই জোয়ারকে টেনে ধরতে হবে।

 

প্রতিষেধক দরকার : হানিফ সংকেত

এক সময় টেলিভিশনে কিংবা অন্য কোনো মাধ্যমে- কোনো অনুষ্ঠান, নাটক বা ছবি দেখলে বা গান শুনলে আমরা প্রশংসা করে বলতাম- বাহ্ চমৎকার, খুব ভালো হয়েছে, শ্রুতিমধুর, নান্দনিক, অনবদ্য, অসাধারণ ইত্যাদি ইত্যাদি। আর এখন কোনো কিছু দেখলে এর মূল্যায়ন মানদন্ড হচ্ছে কত মিলিয়ন ভিউ হয়েছে কিংবা কনটেন্টটি ভাইরাল হয়েছে কি না। অন্তর্জালের এই দুনিয়ায় নির্মিত কিছু কিছু কনটেন্ট বা বিষয়বস্তু কতটা জনপ্রিয় জানি না, তবে এদের কারণে অশ্লীল শব্দের উৎপাতে ভাইরাল নামক শব্দটি অন্তর্জাল ভরিয়ে বেশ ছড়িয়েছে। সমাজ সমর্থন অযোগ্য বহুবিধ অসামাজিক কনটেন্টে ভরপুর এখন অন্তর্জাল। ভাইরাল শব্দটির উৎপত্তি ভাইরাস থেকে। তবে ভাইরাল-ভাইরাস না হলেও নীতি-নৈতিকতা বিবর্জিত, রুচি ও বিবেকবোধহীন কিছু মানুষ এই ভাইরালকে ভাইরাসে পরিণত করেছে। কথায় আছে, ‘সুস্থ’তা সংক্রমিত হয় না-সংক্রমিত হয় রোগ’। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে দিনে দিনে এই ভাইরালও রোগ হয়ে যাচ্ছে। একটা কথা মনে রাখতে হবে, ভাইরাল নিয়ে যে যতই তর্জন-গর্জন করুন না কেন সাময়িকভাবে এসব কনটেন্ট অর্থ এনে দিলেও এগুলোর স্থায়িত্ব কম। কত ভাইরাল এলো-গেল, কিন্তু যেসব ছবি, নাটক, গল্প বা কনটেন্টের আবেদন এখনো আছে, সেগুলো কিন্তু ভাইরাল মানদন্ডে বিবেচিত নয়। ভাইরাল হওয়া ভালো যদি তা সমাজ বান্ধব বা মানবকল্যাণে সহায়ক ভূমিকা রাখে, সময়কে ধরে রেখে মানুষের নীতি-নৈতিকতা জাগিয়ে তোলে, মানুষকে সুস্থ বিনোদন দেয়, মনকে প্রফুল্ল রাখে। তবে যে ভাইরাল-ভাইরাস হয়ে ভীতি ছড়ায়, এ ধরনের সমাজ দূষণ করা ভাইরাল হওয়া অশ্লীল-অকল্যাণকর অসামাজিক কনটেন্ট-গান-ছবি থেকে বর্তমান প্রজন্মকে রক্ষা করতে হলে এখনই এসব ভাইরাল ভাইরাসের প্রতিষেধকের ব্যবস্থা করা উচিত।

 

দিনের শেষে যেটা ভালো সেটাই টিকে থাকে : শমী কায়সার

সংগীত, নাটক, সিনেমা তথা সব সাংস্কৃতিক অঙ্গনে কেমন যেন একটা অস্থিরতা বিরাজ করছে। এখন তো অনলাইন ভাইরালের যুগ। সবাই যেন কিছু একটা হতে চায়। অবশ্যই হবে তবে আমাদের সংস্কৃতিতে বিশাল যে গ্যাপ সৃষ্টি হয়ে গেছে সেটা কিন্তু খুবই দুঃখজনক বিষয়। আমাদের দেশের ইতিহাস, সংস্কৃতিচর্চা, সাহিত্য বিষয়ে জানতে নিয়মিত বই পড়া অর্থাৎ সব মৌলিক জায়গা থেকে এই সময়ের তরুণ প্রজন্ম বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। তাই সস্তা জিনিস মানুষ দেখে, শেয়ার দেয়। সেটি ভাইরাল হয়, ছড়িয়ে যায়। তবে আমি মনে করি, দিনের শেষে যেটা ভালো সেটাই টিকে থাকে। দেরি করে হলেও। আরেকটা বিষয়, এখন অনেকে সবকিছুই করতে চায়। যেমন সবাই বই লিখতে চায়। অবশ্যই লিখবে, তবে বই লেখার জন্য যে মৌলিক স্কিল জানা দরকার সেটাকে ডেভেলপ করে। যদিও আমাদের এখানে এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে গিয়ে স্কিল ডেভেলপমেন্ট করতে পারে। আর সংস্কৃতিচর্চা করতে গেলে আর্থিক বিষয়ে ভাবতে হয়। সবকিছু তো গভ:-এর একার পক্ষে সম্ভব নয়, আমাদেরও কিছু করতে হয়। এসব ভেবে আমরাও নতুন প্রজন্মকে নিয়ে কিছু একটা করার চেষ্টায় ‘ন্যাশনাল স্কিল ডেভেলপমেন্ট অথরিটি’ গঠন করেছিলাম। অনেকগুলো কাউন্সিল আমরা করেছিলাম। মিডিয়া স্কিল ডেভেলপমেন্ট নিয়ে কাজ করেছিলাম। কোন গান চালাবে বা কোন লেখাটা শেয়ার করা যাবে সেটা নিয়ে কাজ করার চেষ্টা ছিল। কিছুদিন চাঁদা তুলে, ফান্ড গঠন করে একটা চেষ্টা করেছিলাম কিছু করার। কিন্তু লং টাইম চালাতে আর পারিনি। কিন্তু ফাইন্যান্সিয়াল সাপোর্টের অভাবে সেটি আর বেশি দূর এগোয়নি।  

 

ভাইরাল ব্যাপারটা তো যুগের হাওয়া : আফসানা মিমি

আমার নিজের কোনো সোশ্যাল মিডিয়া নেই। আমি ব্যক্তিগতভাবে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করা পছন্দ করি না। আর নিজেও চাই না কখনো ভাইরাল হতে। সেই প্রস্তর যুগ থেকে আমাদের শুরু, এখন তো চতুর্থ শিল্প যুগ চলছে। ভাইরাল ব্যাপারটা তো যুগের হাওয়া, চাহিদা। এটাকে কীভাবে ঠেকানো যাবে? সেটা কি আদৌ সম্ভব। অন্যদিকে এই প্রযুক্তির সময়টাকে তো অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে প্রযুক্তি কতটা সঠিকভাবে বা কীভাবে ব্যবহার করতে হবে সেটাই মূল বিষয়। আমরা সবকিছুতেই ভাইরাল হতে চাই। আমি মনে করি, ইতিবাচক বিষয়ে ভাইরাল হলে ঠিক আছে। কিন্তু উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বা অপ্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে ভাইরাল হওয়া খুবই খারাপ। সুন্দর চিন্তা, সুন্দর কাজ সামনে আনার জন্য ভাইরাল হলে তো অসুবিধা নেই!

সর্বশেষ খবর