করোনাকালের পর ২০২২ সাল থেকে ছবি মুক্তি এবং ব্যবসায়িক সফলতায় বেশ প্রাণ এসেছিল। গত ঈদুল আজহা পর্যন্ত ঢাকাই চলচ্চিত্রের এ রমরমা চিত্র আশা জাগিয়েছিল দর্শক-প্রদর্শক ও নির্মাতাদের মধ্যে। কিন্তু জুলাই মাসে দেশে ছাত্র আন্দোলন শুরু হলে সেই আশায় ছেদ পড়ে। বন্ধ হয়ে যায় ছবি মুক্তি ও সিনেমা হল। অথচ মুক্তির মিছিলে ছিল বড় বাজেটের এবং গল্পনির্ভর বেশ কয়েকটি ছবি। প্রদর্শক ও নির্মাতারা বলছেন, এসব ছবি মুক্তি পেলে আমাদের চলচ্চিত্রশিল্পের নবজাগরণ ঘটত।
আটকে পড়া ছবির তালিকায় রয়েছে- শাকিব খানের ‘দরদ’, সিয়াম আহমেদের ‘জংলি’, আরিফিন শুভর ‘নীলচক্র’। এ ছাড়া ‘এশা মার্ডার’, ‘কবি’, ‘নূর’, ‘নন্দিনী’, ‘হৈমন্তীর ইতিকথা’ ‘শরতের জবা’সহ আরও কয়েকটি সিনেমা। চলতি বছর শেষের আগেই সিনেমাগুলো মুক্তির কথা ছিল। কিন্তু আন্দোলন, সরকার পতন, পরবর্তী পরিস্থিতি এবং বন্যাকে ঘিরে অনিশ্চয়তায় প্রযোজক এবং পরিচালকরা নির্ধারিত সময়ে তাদের সিনেমা মুক্তি দিতে পারছেন না। ২০২২ সাল থেকে মুক্তি পাওয়া ব্যবসাসফল ছবির মধ্যে অন্যতম কয়েকটি হলো- ‘হাওয়া’, ‘পরাণ’, ‘গলুই’, ‘দিন দ্য ডে’, ‘জ্বীন মোনা টু’, ‘শান’, ‘প্রিয়তমা’ ‘রাজকুমার’, ‘তুফান’ প্রভৃতি। এসব ছবি দিয়ে সিনেমা হলে দর্শক ফিরেছিল। ছবিগুলো ভালো ব্যবসা করায় সিনেমা হল মালিক এবং ছবির নির্মাতারা আশায় বুক বেঁধেছিলেন। কারণ নব্বই দশকের শেষভাগে এসে ঢাকাই চলচ্চিত্র পড়েছিল অশ্লীলতা, নকল ও পাইরেসির মতো ভয়াবহ অন্ধকার করাল গ্রাসের কবলে। তখনকার সেন্সর বোর্ড কীভাবে একের পর এক অশ্লীল ছবিকে ছাড়পত্র দিয়েছিল তা এখনো এ দেশের জনগণের কাছে প্রশ্ন হয়ে আছে। তখন এফডিসি কোন মাফিয়া চক্রের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছিল তারও তদন্ত চাচ্ছেন এখন বোদ্ধাশ্রেণি ও সাধারণ মানুষ। কেন তখন সিনিয়র শিল্পী এবং নির্মাতারা এফডিসিতে প্রবেশ করা অশ্লীল ছবির হোতাদের রুখলেন না তা-ও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে আছে। ষাট থেকে নব্বই দশকের মধ্যভাগ পর্যন্ত এদেশের চলচ্চিত্রের ছিল স্বর্ণযুগ। তখন সুতরাং, রাজধানীর বুকে, তালাশ, চান্দা, নীল আকাশের নীচে, আবির্ভাব, বসুন্ধরা, অশিক্ষিত, ছুটির ঘণ্টা, ভাত দে, নয়নমণি, গোলাপী এখন ট্রেনে, সুন্দরী, কসাই, সবুজসাথী, ওরা ১১ জন, শুভদা, দেবদাস, রাজলক্ষ্মী শ্রীকান্ত, অবুঝ মন, ময়না মতি, বধূ বিদায়, অশ্রু দিয়ে লেখা, আলোর মিছিল, আবার তোরা মানুষ হ, সূর্যকন্যা, সীমানা পেরিয়ে, মেঘের অনেক রঙ, এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী, নাতবৌ, আরাধনা, সমাধি, অংশীদার, বন্ধু, জিঞ্জির, দি ফাদার, চাঁদনী, হৃদয়ের আয়না, সত্যের মৃত্যু নেই, অন্তরে অন্তরে, ভেজা চোখ, তিন কন্যা, সন্ধিসহ শত শত ছবি দেশের সিনেমা হলগুলোকে আলোকোজ্জ্বল করে রেখেছিল। সেই অবস্থা আবার কীভাবে ফিরবে সে অপেক্ষায় আছে চলচ্চিত্র প্রিয় মানুষ। যাই হোক এখন আবার চলচ্চিত্র মুক্তি অশনি সংকেতের কবলে পড়ায় শঙ্কিত চলচ্চিত্র জগতের মানুষেরা। এ বিষয়ে প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার কাজী হায়াৎ বলেছেন, মানুষ তখনই বিনোদন চায় যখন সবদিক দিয়ে তাদের মনে শান্তি বিরাজ করে। বর্তমান অবস্থায় গাঁটের পয়সা খরচ করে বিনোদন উপভোগ করার মতো মানসিক অবস্থা মানুষের নেই। সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে মানুষের মধ্যে ‘অস্থিরতা কাটেনি’। এখন সিনেমা মুক্তি দিলে কেবল আর্থিক ক্ষতিই হবে। তাই বড় বাজেটের অনেক সিনেমার মুক্তির সম্ভাব্য তারিখ প্রযোজকরা পিছিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছে। গত জুলাই ও আগস্ট, এ দুই মাসে মাত্র দুটি ছবি মুক্তি পায়। এর মধ্যে জুলাই মাসে শবনম ফেরদৌসীর ‘আজব কারখানা’ এবং আগস্টে মনতাজুর রহমান আকবের ‘অমানুষ হল মানুষ’ ছবি দুটি মুক্তি পেয়েছিল। দেশের এ অস্থির সময়ের কারণে ছবি দুটি হলে দর্শক টানতে ব্যর্থ হয়। ব্যবসায়িক এ অসফলতার কারণেই অন্য নির্মাতারা এখন ছবি মুক্তি দিতে সাহস পাচ্ছেন না। মুক্তির অপেক্ষায় থাকা ছবিগুলোর নির্মাতারা বলছেন, ‘আরও এক-দুই মাস গেলে মুক্তি নিয়ে পরিকল্পনা করব। সবকিছু এখনো স্বাভাবিক হয়নি। যখন মনে হবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক তখন মুক্তির পরিকল্পনা করব।’ চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির উপদেষ্টা সুদীপ্ত কুমার দাস বলেছেন, দেশের ৮০ শতাংশ সিনেমা হল বন্ধ এবং সিনেমা মুক্তি দিলে বড় লোকসান হওয়ার ভয়েই সিনেমা মুক্তি থেকে সরে দাঁড়াচ্ছেন প্রযোজকরা। এতে সার্বিকভাবে আবার ভয়ংকর ক্ষতির মুখে পড়ছে আমাদের চলচ্চিত্র শিল্প।