কিংবদন্তি পপগুরু আজম খান। বাংলা পপ গানের ইতিহাসে তিনি নিজেই এক যুগ। তাঁর গানের মধ্যেই জীবনের রস, সমাজের গল্প, বন্ধুত্ব, প্রেম, প্রতিবাদ সবকিছু মিশে আছে। যেগুলো সৃষ্টির পেছনের গল্প তুলে ধরেছেন - পান্থ আফজাল
আলাল-দুলাল : বন্ধুত্ব থেকে সৃষ্টি
আলাল-দুলাল গানটা শোনেননি, এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। কিন্তু এর পেছনের গল্পটা জানলে গানটা যেন আরও আপন মনে হয়। ঢাকার কমলাপুরে পল্লিকবি জসীমউদ্দীনের বাড়ির বাগানে প্রতিদিনের আড্ডা, বন্ধুদের খুনসুটি, গিটারের টুংটাং-সব মিলিয়েই এই গানের জন্ম। শাহজাহান আর জাহাঙ্গীর, আজম খানের দুই বন্ধু-তাদের নিয়েই মজার ছলে বানানো হয় ‘আলাল’ আর ‘দুলাল’। আর সেই মজাটা একদিন গানে রূপ নেয়। প্রথমে গানে ছিল ‘ওই পুলে পৌঁছে বাড়ি’, পরে আলম খান ভাইয়ের পরামর্শে সেটা হয় ‘চানখাঁরপুল’ আর এতেই গানটার ঢং পাল্টে যায়। পুরান ঢাকার সেই চানখাঁরপুলে নাকি সত্যিই এক হাজি চাঁন ছিলেন, যিনি এই গান শুনে খুব খুশি হয়েছিলেন, ভেবেছিলেন গানটা বুঝি তাঁকেই নিয়ে লেখা!
ওরে সালেকা ওরে মালেকা : ট্যাংকের ঢং থেকে শুরু
এই গানটার শুরুটাই খুব মজার। একেবারে খালি ছাদে, একটা পানির ট্যাংকে কাঠি দিয়ে বিট তুলছে এক বন্ধু, আর আজম খানের মুখ দিয়ে হঠাৎ বেরিয়ে এলো-‘ওরে সালেকা ওরে মালেকা, ওরে ফুলবানু পারলি না বাঁচাতে’-সেটা তখন নিছক মজা ছিল। কিন্তু বছরখানেক পর যখন পপ গান রেকর্ড শুরু করলেন, তখন এই কথাগুলোতেই তৈরি হলো একটা চিরকালীন হিট।
অভিমানী তুমি কোথায় : এক পাগলের গান থেকে অনুপ্রেরণা
এই গানের শুরু একেবারেই ব্যতিক্রমী। চিটাগাং হোটেলের সামনে এক পাগল গাইত এক অদ্ভুত গান, ‘ইতলের বিনা, বিনারে ভাগি’, শুনলে কানে লাগে কিন্তু সুরে ছিল এক আবেশ। সেই সুর শুনে আজম খানের মনে হঠাৎ জন্ম নেয়- ‘অভিমানী, তুমি কোথায় হারিয়ে গেছো’। তাঁর গানগুলো এমনই-পথের ধারে পাওয়া যায়, ভিড়ের মাঝখানে মেলে, আবার একাকিত্বেও জন্ম নেয়।
পাপড়ি কেন বোঝে না : এক মেয়ে, এক অনুভব
পাপড়ি ছিল বাস্তব চরিত্র। ১৯৭৫ সালের দিকে আজম খানের বড় ভাইয়ের বাসায় ভাড়াটিয়া ছিল এক পরিবার, সেই মেয়েটির নাম ছিল পাপড়ি। এলাকার বখাটেরা তাকে উত্ত্যক্ত করত, আজম খান গিয়ে রীতিমতো ধমক দিয়ে শান্ত করেন তাদের। এরপর পাপড়িকে ঘিরে এক নিঃশব্দ দায়িত্ববোধ তৈরি হয়। একদিন পাপড়িরা হঠাৎ বাসা বদলে চলে গেলে, সেই না বলা অনুভব থেকে জন্ম নেয়, ‘সারা রাত জেগে কত কথা ভাবি আমি, পাপড়ি কেন বোঝে না তাই ঘুম আসে না’। অনেক পরে এক কনসার্টে পাপড়ির স্বামীর মাধ্যমে আবার দেখা হয় তার সঙ্গে। এমন গল্পগুলো শুনলে বোঝা যায়, গানগুলো জীবনের খুব গভীর জায়গা থেকে এসেছে।
হাই কোর্টের মাজারে : সমাজের বাস্তবতা গানে
হাই কোর্ট মাজারের নূরা পাগলা নামের এক চরিত্রকে কেন্দ্র করে তৈরি হয় গানটির মূল ভাবনা। তাঁর ব্যবহৃত ছালা একসময় ভক্তদের মাঝে ১০০ টাকায় বিক্রি হতে লাগল! এই অদ্ভুুত ঘটনার রেশ ধরেই আজম খান গানে তুলে ধরেন বাস্তবতার কৌতুক-‘হাই কোর্টের মাজারে কত ফকির ঘোরে’। গানের মধ্যে দিয়ে সমাজের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ার মতো সাহসী ছিল তাঁর গলা। আজম খানের গান মানে শুধু বিনোদন নয়, প্রতিটা গানে আছে একটা গল্প, একটা অনুভব। তার গানগুলো শুনলেই বোঝা যায়, তিনি ঠিক কী দেখেছেন, কী অনুভব করেছেন। যেসব কথা হয়তো কখনো বলা হয়নি, সেসবই যেন গানের লাইনে লাইনে বলে গেছেন। আজম খান নেই, কিন্তু তাঁর গান আমাদের সঙ্গে আছে এবং থাকবে, যতদিন এই মাটিতে কেউ ভালোবাসা, প্রতিবাদ, বন্ধুত্ব আর মানুষের গল্প খুঁজে ফিরবে।