১২ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ১৭:৩৩

প্লাস্টিক খাচ্ছে মাটির ঘ্রাণ, মৃৎশিল্পীদের কষ্টের দিন

টাঙ্গাইল প্রতিনিধি

প্লাস্টিক খাচ্ছে মাটির ঘ্রাণ, মৃৎশিল্পীদের কষ্টের দিন

কালের বিবর্তনে সনাতন আর ঐতিহ্যের অনেক কিছুই আজকাল বিলীনের পথে। কোনো কোনো শিল্প একেবারেই হারিয়ে ফেলেছে তার অস্তিত্ব, কোনোটা আবার কোনোমতে সময়ের সাথে টেক্কা দিয়ে টিকে আছে। গোটা দেশেই মৃৎশিল্প ও শিল্পীদের অবস্থা এরকমই। বাপ-দাদার পেশা হিসেবে অনেক মৃৎশিল্পী তার পেশাটাকে আঁকড়ে থাকার চেষ্টা করছে, তবে সেই টিকে থাকার লড়াইটাও বড্ড কঠিন। পদে পদে তার ক্ষয় আর অবক্ষয়ের খেলা।

টাঙ্গাইলের মৃৎশিল্পও তেমন। উন্মুক্ত বাজারের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে না পেরে হারিয়ে যেতে বসেছে এই শিল্প। প্লাস্টিক, অ্যালুমোনিয়াম ও মেলামাইনের তৈজসপত্র খেয়ে ফেলছে মাটির ঘ্রাণ। ফলে জেলার মৃৎশিল্পীরাও অর্থাভাবে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে। কেউ কেউ ইতোমধ্যে বাধ্য হয়ে ভিন্ন পেশায় চলে গেছে।

জেলায় এক সময় তৈজসপত্রের চাহিদা পূরণ করতো মাটির হাড়ি, পাতিল, কলসি, থালা(সানকি), কুয়ার পাট, নানা ধরণের খেলনা, বিভিন্ন পিঠা তৈরির খরমা(সাজ) ইত্যাদি। গ্রাম্য মেলা ও হাট-বাজারে মাটির ওইসব পণ্য শোভা পেত। মাটির তৈরি এসব পারিবারিক তৈজসপত্র বিজ্ঞানভিত্তিক স্বাস্থ্যসম্মত ও সুস্বাদু পণ্যের আধার হিসেবে পরিগণিত হতো।

তবে সেই দিন এখন অনেকটাই হাওয়াই মিঠার মতো মিইয়ে গেছে। সুদিনের সেই গল্পে এখন কেবল স্মৃতির ভিড়, হারানো ঐতিহ্যের কথা আওড়েই অনেক মৃৎশিল্পী এই পেশায় মাটি কামড়ে পড়ে আছেন।

টাঙ্গাইল বিসিক সূত্রে জানা যায়, টাঙ্গাইল সদর উপজেলায় ১৫৮টি কুমার পরিবার, বাসাইলে ১১৫টি, নাগরপুরে ১০৭টি, মির্জাপুরে ৯৯টি, দেলদুয়ারে ৬৫টি, ঘাটাইলে ৬০টি, ভূঞাপুরে ২২০টি, কালিহাতীতে ২৮০টি, গোপালপুরে ১১২টি, ধনবাড়ীতে ১০টি এবং মধুপুর উপজেলায় ৯টি কুমার বা কুম্ভকর পরিবার বসবাস করছে। জেলায় এক হাজার ২৩৫টি কুমার পরিবার থাকলেও তাদের অধিকাংশই পৈত্রিক পেশা পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছে।

সরেজমিনে দেখা যায়, মৃৎশিল্পীরা সুনিপুণ শৈল্পিকতায় তৈরি করছেন পুতুল, ফুলের টব, কুয়ার পাট, হাঁড়ি-পাতিল, খেলনা, শো-পিসসহ বিভিন্ন নিত্য প্রয়োজনীয় ও সৌখিন জিনিসপত্র। এসব পণ্য তারা শহরের দোকান এবং বাসা-বাড়িতে বিক্রি করে থাকেন।


গ্রামীণ মেলা সংশ্লিষ্টরা জানায়, জেলার মৃৎশিল্পীরা প্রতিবছর তাদের পণ্যের পসরা সাজিয়ে মেলার আকর্ষণ বাড়ানোর পাশাপাশি ক্রেতাদের কাছে টানতো। মাটির তৈরি জিনিস-পত্রের ব্যবহার কমে যাওয়ায় এখন হাতেগোনা কয়েকজন মৃৎশিল্পী নানা ধরণের খেলনা, ফুলদানী ও শো-পিস নিয়ে মেলায় অংশ গ্রহণ করে থাকে। মেলার মৃৎশিল্পের সে স্থান এখন কাঠের তৈরি ফার্ণিচার দখল করে নিয়েছে।

টাঙ্গাইল সদর উপজেলার রসুলপুর জামাই মেলার আয়োজকদের অন্যতম রাজকুমার সরকার জানান, প্রায় দেড়শ’ বছরের ঐতিহ্য রসুলপুরের জামাই মেলা। একসময় এ মেলার অন্যতম আয়োজন ছিল মাটির তৈরি তৈজসপত্র। সময়ের সাথে সাথে সেসব এখন আর নেই, যৎসামান্য তৈজসপত্র কুমাররা মেলায় নিয়ে আসে।

টাঙ্গাইল সদর উপজেলার বাসাখানপুরের চৈতি পাল, বাদল পাল, ঝর্ণা রাণী পাল, দেলদুয়ারের গমজানির নিমাই পাল, মির্জাপুরের গণেশ পাল, ভূঞাপুরের ফলদা কুমার পাড়ার পিয়াতা পাল, কালিহাতী উপজেলার স্বপন পাল, পরিতোশ পাল, গদাই পালসহ অনেকেই জানান, মাটির তৈরি তৈজসপত্র এক সময় ঘর-গেরস্থালির প্রধান উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হত। এমনিতেই বর্ষাকালে মাটির তৈরি পণ্য রোদে শুকানো যায় না ও চুলায়(পুন/মুখাই/ভাটা) আগুন দেওয়া যায়না। এ কারণে মৃৎশিল্পীদের বছরের ৩-৪মাস বেকার সময় কাটাতে হয়।

মৃৎশিল্পীরা তাদের পৈত্রিক পেশাকে টিকিয়ে রাখতে জড়িতরা সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার দাবি করেন।

টাঙ্গাইল বিসিক শিল্প নগরীর সহকারী মহাব্যবস্থাপক শাহনাজ বেগম বলেন, ‘বিসিক থেকে সরকারি সহযোগিতায় মৃৎ শিল্পীদের বিভিন্ন ধরনের কারিগরি ও আর্থিক সহযোগিতা দেওয়া হয়। যে সব মৃৎ শিল্পীরা শো-পিস তৈরি করে তাদেরকে প্রশিক্ষণ ও ব্যাংক ঋণে সহযোগিতা করা হয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘যারা মাটির তৈরি শো-পিস তৈরি করে থাকেন মেধা বাছাই করে তাদের মধ্য থেকে মেধাবীদের শিল্পভবনে তিন মাসের একটি বিশেষ প্রশিক্ষণ দিয়ে ব্যবসা করার জন্য বিসিকের মাধ্যমে স্বল্পসুদে ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে।’

বিডি প্রতিদিন/নাজমুল

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর