রবিবার, ২০ অক্টোবর, ২০১৯ ০০:০০ টা

প্রশাসনে এখনো বিএনপি জামায়াতের ভূত

গুরুত্বপূর্ণ পদে বসে আছেন সরকারবিরোধী কর্মকর্তারা

নিজামুল হক বিপুল

সরকারের প্রশাসনে এখনো বিএনপি-জামায়াতের ভূত দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। অনেক মন্ত্রণালয় ও দফতরের গুরুত্বপূর্ণ পদে বিএনপি-জামায়াতপন্থি কর্মকর্তারা দায়িত্ব পালন করছেন। মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও সচিবের একান্ত সচিব হিসেবেও আছেন বিরোধী রাজনীতিতে বিশ্বাসী কর্মকর্তারা। এমনকি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ পদেও এসব কর্মকর্তা কাজ করছেন অত্যন্ত চাতুর্যের সঙ্গে নিজেদের রাজনৈতিক পরিচয় গোপন রেখে। শুধু তাই নয়, এদের কেউ কেউ নিজেদের অনুসারী ও পছন্দের কর্মকর্তাকে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দফতরের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসাতে তৎপর। মাঠ পর্যায়ে জেলা প্রশাসক (ডিসি) পদেও রয়েছেন ছাত্রজীবনে ছাত্রদল ও ছাত্রশিবিরের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা। সরকারবিরোধী এই কর্মকর্তাদের অনেকেই নিজেদের পরিচয় আড়াল করতে যোগ দিয়েছেন তাবলিগ জামাতেও। প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে ও বিভিন্ন সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। গত কয়েকদিনে সচিবালয়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে খোঁজখবর নিয়ে ও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যে জানা যায়, সরকারের অনেক কাজই চলছে ঢিমেতালে। অনেকেই বলছেন, এর কারণ সরকারের ভিতরে ঘাপটি মেরে বসে থাকা সরকারবিরোধী কর্মকর্তাদের কারসাজি। তাদের নানা কর্মকা- ও সরকারের কাজকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। মন্ত্রণালয়ভিত্তিক খোঁজ নিতে গিয়ে জানা যায়, বিশেষ করে স্থানীয় সরকার, শিক্ষা, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক, নৌপরিবহন, স্বাস্থ্য, জনপ্রশাসন, তথ্য মন্ত্রণালয়, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগসহ অনেক মন্ত্রণালয় ও বিভাগে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে রয়েছেন বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সুবিধাভোগী কর্মকর্তা। এদের কেউ কেউ তো জোট সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রীর একান্ত সচিব পদেও ছিলেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব পদে রয়েছেন সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের একান্ত সচিব (পিএস) এবং আরেকজন হচ্ছেন জোট সরকার আমলের যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদের একান্ত সচিব (পিএস)। বিএনপি আমলের সুবিধাভোগী এ দুই ব্যক্তিই এখন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ডাকসাইটে কর্মকর্তা।

একইভাবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়েও রয়েছেন বেশ কয়েকজন; যাদের রাজনৈতিক মতাদর্শ বর্তমান সরকারের বিরোধী। কিন্তু তারাও অতিরিক্ত সচিব ও যুগ্মসচিবের মতো পদে রয়েছেন। এর মধ্যে কেউ কেউ আবার একদা জেলা প্রশাসক (ডিসি)। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়েও আছেন এই বৈশিষ্ট্যের কয়েকজন কর্মকর্তা; যাদের কর্মকা  সরকারকে বিব্রত করছে। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় নাকি ‘সরকারবিরোধী অফিসার ডিপো’। এ মন্ত্রণালয়ে গুটিকয় বাদে গুরুত্বপূর্ণ বেশির ভাগ কর্মকর্তাই সরকারবিরোধী এবং বিগত জোট সরকারের সুবিধাভোগী। তারা এখনো সুবিধা শিকার করেই চলছেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডারের ২১, ২২, ২৪ ও ২৫ ব্যাচের কর্মকর্তারা এখন প্রশাসনে দাপুটে কর্মকর্তা। এ চার ব্যাচেরই নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছিল বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়। এ ব্যাচগুলোয় চাকরি পাওয়া কর্মকর্তাদের বড় অংশই বিএনপি ও জামায়াতের রাজনীতিতে সরাসরি জড়িত। কিন্তু সময়ের ‘প্রয়োজনে’ তারা এখন ‘অরাজনৈতিক’ সেজে প্রশাসনে নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্রিয়। জোট সরকারের সময় নিয়োগ পাওয়া এসব বিসিএস ক্যাডারের একটা বড় অংশ যে ওই সময়ের ছাত্রদল ও ছাত্রশিবিরের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত তার একটা বড় উদাহরণ হচ্ছে- ২৪ ব্যাচে বিএনপির এক সংসদ সদস্যের দুই ছেলে একসঙ্গে নিয়োগ পেয়েছিলেন রাজনৈকিক প্রভাব খাটিয়ে। কুমিল্লার বুড়িচং-ব্রাহ্মণপাড়া আসনের তৎকালীন সংসদ সদস্য অধ্যাপক ইউনুসের দুই ছেলে তখন নিয়োগ পান রাজনৈতিক পরিচয়ে। একই ব্যাচে পুলিশে এএসপি পদে নিয়োগ পাওয়ার মধ্যে প্রায় অর্ধশত ছিলেন বগুড়া আজিজুল হক কলেজের ছাত্র, যারা সরাসরি ছাত্রদল ও ছাত্রশিবিরের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

এ ছাড়া প্রশাসনে ২১, ২২, ২৪ ও ২৫ ব্যাচ এখন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিসিএস ২৪তম ব্যাচ নিয়ে প্রশাসনের ভিতরে-বাইরেও রয়েছে নানা আলোচনা-সমালোচনা। তাদের নিয়ে এতটাই বিতর্ক ছিল যে একবার তো নিয়োগই বাতিল করতে হয়েছিল। তার পরও এই নিয়োগের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বৃত্ত থেকে বের হতে পারেনি তৎকালীন সরকার। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলের শেষ দিকে নিয়োগ পায় বিসিএস ২৫তম ব্যাচও; যাদের একটা বড় অংশই হচ্ছেন তৎকালীন সরকারের রাজনৈতিক আশীর্বাদপুষ্ট। এ দুই ব্যাচের কর্মকর্তারা ইতিমধ্যে উপসচিব পদে উন্নীত। ২৪ ব্যাচের অনেক কর্মকর্তা এখন তাদের ব্যাচের কর্মকর্তাদের সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসাতে তৎপর। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ২৪ ব্যাচের একজন কর্মকর্তা রয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে; যার রাজনৈতিক পরিচয় নিয়ে বিতর্ক আছে। ছাত্রজীবনে ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকলেও ভোল পাল্টিয়ে বর্তমানে তিনিই সরকারি দলের একনিষ্ঠ কর্মী-সমর্থক। তার ব্যাচের কর্মকর্তাদের তিনিই ভালো ভালো জায়গায় পদায়নে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। জানা গেছে, বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়, সরকারের মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের একান্ত সচিব নিয়োগ দেবে সরকার। মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের পছন্দে কাউকে নিয়োগ দেওয়া হবে না। তখনই সুযোগ নেন ২৪ ব্যাচের ওই কর্মকর্তা। তিনি অন্তত ২০ থেকে ২২ জন মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীর একান্ত সচিব পদে তার ব্যাচের কর্মকর্তাদের নিয়োগে ভূমিকা রাখেন বলে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে। শুধু তাই নয়, তার ব্যাচের কর্মকর্তাদের বিভিন্ন জেলায় ডিসি কার্যালয় ও বিভিন্ন সচিবের দফতরে পদায়নে তিনি ভূমিকা রাখেন। ঢাকার একজন এডিসি তারই পছন্দে পদায়ন পেয়েছেন। এই কর্মকর্তার বেশির ভাগই নিজেদের অরাজনৈতিক বলে পরিচয় দেন।

এর বাইরে মাঠ প্রশাসনেও বিশেষ করে জেলা প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন সরকারবিরোধী বেশকিছু কর্মকর্তা। এর মধ্যে রয়েছেন দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের এক জেলার ডিসি, আছেন বরিশাল বিভাগের এক জেলার ডিসি। ঢাকা বিভাগের দুটি গুরুত্বপূর্ণ জেলায় এ রকম ডিসি আছেন, চট্টগ্রাম বিভাগে আছেন একজন, ময়মনসিংহ বিভাগে আছেন দুজন, রংপুর বিভাগে আছেন একজন এবং রাজশাহী বিভাগে আছেন একজন জেলা প্রশাসক। তাদের সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রত্যেকেই ছাত্রজীবনে ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কেউ কেউ তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হল শাখা ছাত্রদলের নেতাও ছিলেন। এসব কর্মকর্তা প্রশাসনের ১৮ ও ২০তম ব্যাচের। এর বাইরে ডিসি হিসেবে নিয়োগ পাওয়া ২১তম ব্যাচের বেশ কয়েকজন আছেন যারা বিরোধী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

সর্বশেষ খবর