রবিবার, ১ ডিসেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

চোখের সামনে লুটিয়ে পড়লেন লেফটেন্যান্ট আনোয়ার

মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বীরবিক্রম

চোখের সামনে লুটিয়ে পড়লেন লেফটেন্যান্ট আনোয়ার

১৯৭১ সালের ৩০ মার্চ যশোর ক্যান্টনমেন্টে পাকিস্তানি সৈন্যদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের মাধ্যমে যে যুদ্ধ শুরু করি, ১৫ ডিসেম্বরে সিলেট জয়ের মাধ্যমে শেষ করি সেই যুদ্ধ। তবে এই সময়ে হারিয়েছি অনেক সহযোদ্ধা। চোখের সামনে বন্ধুকে গুলি খেয়ে লুটিয়ে পড়তে দেখেছি। তখন আমি বেঙ্গল রেজিমেন্ট ব্যাটালিয়নে কর্মরত। তরুণ ক্যাপ্টেন। ১৬ মার্চ পশ্চিম পাকিস্তান থেকে যশোরে আমার কর্মস্থলে আসি। এসেই আমার সৈন্যদের সঙ্গে সীমান্তের প্রত্যন্ত এলাকায় প্রশিক্ষণ মহড়ায় যেতে হয়। ২৫ মার্চের বর্বর গণহত্যা বা স্বাধীনতার ঘোষণা হয়েছে এর কিছুই জানি না। ২৯ মার্চ হঠাৎ ক্যান্টনমেন্টে ফেরার জন্য বার্তা পাই। পায়ে হেঁটে ফিরতে রাত ১২টা বেজে যায়। ৩০ মার্চ সকালে যশোরের ১০৭ ব্রিগেডের কমান্ডার এসে আমার ব্যাটালিয়নকে নিরস্ত্র করার ঘোষণা দেন। এ খবরে বাঙালি সৈনিকরা বিদ্রোহ করে বসে। তারা অস্ত্রাগার থেকে অস্ত্র নিয়ে জয়বাংলা ধ্বনি তুলে পাঞ্জাবি ইউনিটে গুলিবর্ষণ শুরু করে। ইতিমধ্যে দ্বিতীয় ইস্টবেঙ্গল জয়দেবপুরে, তৃতীয় ইস্টবেঙ্গল সৈয়দপুরে, চতুর্থ ইস্টবেঙ্গল ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এবং অষ্টম ইস্টবেঙ্গল চট্টগ্রামে বিদ্রোহ করেছে আমরা তা জানতাম না। বাঙালি কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল রেজাউল জলিলের কাছে ঘটনা জানতে চাইলে তিনি বিদ্রোহের কারণ জানান। কাছাকাছি পাঞ্জাবি অফিসার থাকায় কোনো নির্দেশনা দিলেন না। বাইরে এসে দেখি পাঞ্জাবি সৈনিকেরা আমাদের দিকে অস্ত্র তাক করে দাঁড়িয়ে। হঠাৎ মর্টারের গোলা এসে পড়ল আমাদের পাশে। তিনদিক থেকে আমাদের ওপর আক্রমণ। আমরা বাংকারে লাফিয়ে পড়ি। সকাল ৮টা থেকে প্রবল যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। বাঙালি সৈন্যরা আমার কাছে নেতৃত্ব চাইল। তখনো জানি না এটা স্বাধীনতার যুদ্ধ। সিদ্ধান্ত নিলাম, আমি বাঙালি সৈন্যদের সঙ্গেই থাকব। এরপর তুমুল যুদ্ধ। ৮ ঘণ্টায় আমাদের গোলাবারুদ শেষ। সিদ্ধান্ত নিলাম বেরিয়ে যাওয়ার। কিন্তু তিনদিক দিয়ে আক্রমণ চলছে। চতুর্থ দিকে খোলা মাঠ। সেদিকেও গুলি চালাচ্ছে পাঞ্জাবি সৈন্যরা। আমরা মেশিনগানগুলো একপাশে এনে গুলি শুরু করি এবং ছোটো ছোটো গ্রুপে বের হতে থাকি। কিন্তু চোখের সামনে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট আনোয়ার হোসেন কোমরে গুলি লেগে লুটিয়ে পড়েন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনের প্রথম শহীদ। গ্রামে ঢুকে শুনলাম মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছে। সাড়ে তিনশর মধ্যে দুইশ সৈনিক নিয়ে বেরিয়ে আসতে পেরেছিলাম। যারা ক্যান্টনমেন্টে থেকে যায়, তাদের পাকিস্তানিরা মেরে ফেলে। ১৮ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় বাংলাদেশ সরকার শপথ গ্রহণ করে। সেখানেই দেখা হয় প্রধান সেনাপতি জেনারেল (তৎকালীন কর্নেল) ওসমানির সঙ্গে। তিনি আমাকে ছয়শ লোক রিক্রুট করতে বলেন। মে মাসের প্রথম দিকে নতুন ছয়শ সৈন্যকে মেঘালয়ের গভীর জঙ্গলে নিয়ে প্রশিক্ষণ দেই। সেখানেই প্রথম ইস্ট বেঙ্গল, তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল ও অষ্টম ইস্ট বেঙ্গলকে নিয়ে জেড ফোর্স নামে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রথম ব্রিগেড গঠন করা হয়। কমান্ডার ছিলেন মেজর জিয়াউর রহমান। এরপর অপারেশন শুরু করি। কামালপুরে পাকিস্তানিদের একটা শক্ত ঘাঁটিতে দুইশ নতুন সৈনিক নিয়ে আক্রমণ করি। আমাদের প্রায় ১০০ জন হতাহত হয়। ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন শহীদ হন। আমি নিজেও আহত হই। এই যুদ্ধে সাহসিকতা প্রদর্শনের জন্য আমাকে বীরবিক্রম ও শহীদ সালাউদ্দিনকে বীরউত্তম খেতাব দেওয়া হয়। ২২ নভেম্বর থেকে বাংলাদেশের সীমান্ত অঞ্চলে মিত্র বাহিনী আক্রমণ শুরু করে। তখন আমরা সিলেট অঞ্চলে। ভারতীয় বাহিনী জকিগঞ্জের আটগ্রাম, আমরা চারগ্রাম দখল করি। এরপর বড় যুদ্ধ হয় গৌরীপুরে। ভোরে পাকিস্তানিরা আমাদের অবস্থানে হামলা চালায়। আমাদের একজন কমান্ডার ক্যাপ্টেন মাহবুবুর রহমান ও ১৩ জন সৈনিক শহীদ হন। তবে পাকিস্তানিদের ৫০ জন নিহত হয়, ৩০ জনকে জীবিত বন্দী করি। এরপর শত্রুরা পিছনে হটতে শুরু করে। এরপর চা বাগানের ভিতর দিয়ে তিন দিন ক্রমাগত হেঁটে সিলেট পৌঁছি। দিনটি ছিল ১৪ ডিসেম্বর। পাকবাহিনী আমাদের ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। আমাদের ১৪ জন শহীদ হন। নায়েক সুবেদার ফয়েজ আহমেদ যুদ্ধ করে শহীদ হন। তাকে বীরউত্তম খেতাব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু শত্রুদের প্রায় ৪০ জন নিহত হয়। বিকালে ওয়্যারলেসে ভারতীয় বাহিনীকে বিমান হামলার অনুরোধ জানালে মিত্র বাহিনীর দুটি বিমান এসে গুলিবর্ষণ শুরু করলে পাকিস্তানিরা হতভম্ব হয়ে পড়ে। পরের দিন সকালে তারা আত্মসমর্পণের বার্তা পাঠায়। ১৫ ডিসেম্বর সিলেটের মাটিতে এই যুদ্ধ শেষ হয়।

অনুলিখন : শামীম আহমেদ।

সর্বশেষ খবর