বুধবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৩ ০০:০০ টা

তালিকা হচ্ছে কমিটি বাণিজ্যে জড়িতদের

কেন্দ্র থেকে তৃণমূল, সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগ যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, কৃষক লীগ, তাঁতী লীগ, মৎস্যজীবী লীগ অভিযোগ সবখানেই

মাহবুব মমতাজী

আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনে কমিটি বাণিজ্যে যারা গডফাদার তাদের তালিকা হচ্ছে। কেন্দ্র থেকে তৃণমূল আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, কৃষক লীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ, যুব মহিলা লীগ, তাঁতী লীগ, মৎস্যজীবী লীগের কিছু নেতার বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ ওঠায় তৎপর হয়ে উঠেছে রাষ্ট্রীয় সংস্থা। সংস্থাগুলো তালিকা করে দলের সর্বোচ্চ মহলে পাঠাচ্ছে। ফলে কপাল পুড়তে পারে কমিটি ও মনোনয়ন বাণিজ্যে জড়িত কিছু নেতানেত্রীর। জেলা-উপজেলায় আওয়ামী লীগের সম্মেলন এবং সহযোগী-ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের কমিটি গঠনে ‘অনুপ্রবেশ’ ঠেকাতেই এ উদ্যোগ।

কয়েকটি সংস্থাসূত্র জানান, বিশেষ সুবিধা নিয়ে গত ১৪ বছরে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন ইউনিট, যুবলীগ-ছাত্রলীগ, কৃষক লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, যুব মহিলা লীগ, মহিলা লীগ, তাঁতী লীগ, মৎস্যজীবী লীগ, জাতীয় শ্রমিক লীগে জামায়াত-শিবির ও বিএনপি এবং ফ্রীডম পার্টির লোকেরা জায়গা করে নিয়েছেন। এর সঙ্গে সংগঠনের কিছু প্রভাবশালী নেতা, সহযোগী-ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের শীর্ষ নেতারা জড়িত। তাদের হাত ধরে রাতারাতি জামায়াত-শিবির ও ফ্রীডম পার্টির লোকেরাও আওয়ামী লীগ বনে যাচ্ছেন। আওয়ামী লীগের তকমা গায়ে লাগিয়ে করে বেড়াচ্ছেন নানা ধরনের অপকর্ম। সূত্র জানান, কেন্দ্রের এক প্রবীণ নেতা সম্প্রতি একটি জেলা কমিটিতে সাংগঠনিক সম্পাদক বানানোর কথা বলে এক ব্যক্তির কাছ থেকে ২৫ লাখ টাকা উৎকোচ গ্রহণ করেন। পরে সেই নেতাকে সাংগঠনিক সম্পাদক না বানিয়ে জেলার সদস্য করেছেন। শুধু কমিটি বাণিজ্য নয়, কারও কারও বিরুদ্ধে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, পৌরসভায় মেয়র পদেও মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে। একাধিক সংস্থাসূত্র জানান, জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে আওয়ামী লীগ ও সরকারের বিরুদ্ধে নানামুখী ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে শুরু করে সব জায়গায় সরকারের বিরুদ্ধে কুৎসাচার বিস্তার করছে। কিন্তু আওয়ামী লীগে ১৪ বছরে যে হারে ‘সুবিধাবাদী’ বেড়েছে, সে হারে এ অপপ্রচারের কোনো প্রতিবাদ ও যুক্তি খন্ডানো পরিলক্ষিত হচ্ছে না। তারা নিজেদের এবং নেতাদের চামচামি করতেই দিন পার করছেন। ফলে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে খোদ তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা দলটিতে। সরকারের উচ্চ পর্যায় সূত্র জানান, গত কয়েক বছরে আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশের বিষয়টি ব্যাপকভাবে আলোচিত। এ অনুপ্রবেশের কারণ কী তা-ও দলের নেতাদের কাছে চিহ্নিত এবং অনুপ্রবেশ ঠেকাতে দল থেকে বারবার তাগিদও দেওয়া হচ্ছে। টানা ১৪ বছর দল ক্ষমতায় থাকার কারণে সুবিধাবাদীরা নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারে অনুপ্রবেশ করছেন। সুবিধাবাদীরা যাতে দলে ঢুকতে না পারেন সেজন্য আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ শীর্ষ নেতারা দলের সর্বস্তরের নেতা-কর্মীকে দীর্ঘদিন ধরেই সতর্ক করে আসছেন। কিন্তু কিছু নেতা এসবে কর্ণপাত করছেন না।

রাষ্ট্রের দুটি সংস্থার করা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে : ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, বিভিন্ন সহযোগী-ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের দীর্ঘদিন সম্মেলন ও নতুন কমিটি নেই। মহানগর মূল দলসহ সহযোগী-ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনে প্রচুর হাইব্রিড, বহিরাগত অনুপ্রবেশকারী রয়েছেন। দলে হাইব্রিড ও সুবিধাবাদীদের দাপটে প্রকৃত ত্যাগী নেতা-কর্মীরা কোণঠাসা। এখন ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগের ওয়ার্ড, থানা কমিটি গঠনের কাজ শুরু হয়েছে। এসব জায়গায় ত্যাগী ও পরীক্ষিতদের বাদ দিয়ে হাইব্রিড, বিতর্কিত ব্যক্তি, এলাকায় পরিচিতদের আনা হচ্ছে। এ ছাড়া এক প্রভাবশালী ব্যক্তির ‘অযাচিত’ হস্তক্ষেপের ফলে দীর্ঘদিনের পোড় খাওয়া রাজনীতিকরা কমিটি থেকে বাদ পড়তে যাচ্ছেন। ওই প্রভাবশালী ব্যক্তির পছন্দের তালিকায় রয়েছেন সদ্য ছাত্রলীগ থেকে বিদায় নেওয়া কিংবা সদ্য কলেজ/বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে বের হওয়া নেতা। যারা কখনো বিরোধী দলের আন্দোলন মোকাবিলা কিংবা রাজপথে ন্যূনতম ঘাম ঝরাননি।

যেসব নেতাকে সামনে রেখে ওয়ার্ড-থানা কমিটি গঠনের কাজ চলছে, আগামীতে তাদের দিয়ে নির্বাচন পার করা এবং বিএনপি বড় ধরনের আন্দোলনের ডাক দিলে তা সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়বে। ফলে সংগঠন ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়বে।

আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র জানিয়েছেন, ঢাকা যে দলের দখলে থাকে সরকারও সে দলের দখলে যায়। আসন্ন ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ কমিটি গঠনের যে প্রক্রিয়া চলছে, তাতে সংগঠন আরও দুর্বল হবে। সে কারণে কারা এবং কেন ও কীসের বিনিময়ে এমন নেতাদের সামনে আনতে চাইছেন সেসব বিষয়ে খোঁজখবর নিতে নড়েচড়ে বসেছে কয়েকটি রাষ্ট্রীয় সংস্থা।

জানা গেছে, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবী লীগ, শ্রমিক লীগ ও যুব মহিলা লীগের সাংগঠনিক অবস্থা খুবই দুর্বল। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা দল এবং বিগত দুই বছর কভিডের কারণে দলের সাংগঠনিক কার্যক্রম দুর্বল অবস্থায় পতিত হয়েছে। সম্প্রতি ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের ওয়ার্ড কমিটি গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। সেখানে মহানগরের দুই শীর্ষ নেতার পছন্দের তালিকায় রয়েছেন বিতর্কিত ব্যক্তি, সরকারি চতুর্থ শ্রেণির চাকরিজীবী, ফ্রীডম পার্টি, হত্যা ও মাদক মামলার আসামি। দক্ষিণের এসব ওয়ার্ড হচ্ছে ২০ নম্বর, ৫ নম্বর, ৭ নম্বর, ২৪ নম্বর, ৩৭ নম্বর, ৩৮ নম্বর, ২৮ নম্বর। দীর্ঘদিনের ত্যাগী ও পরীক্ষিতদের বাদ দিয়ে দুই শীর্ষ নেতার মনগড়া কমিটি গঠনের পাঁয়তারা চলছে। অভিযোগ উঠে এসেছে, এ কয়েকটি ওয়ার্ডের শীর্ষ নেতা বানাতে কোটি টাকার ওপরে লেনদেনের তথ্য পেয়েছে কয়েকটি সংস্থা। সাত বছর আগেও চতুর্থ শ্রেণির চাকরিজীবী যুবলীগের ‘হঠাৎ’ কপাল খুলে যাওয়া এক নেতার পল্টন এলাকায় একটি আলিশান অফিস নিয়েও আলোচনা হচ্ছে।

সংস্থাগুলোর রিপোর্টে বলা হয়েছে : আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের একশ্রেণির নেতার মাধ্যমেই দলে অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটছে। অনুপ্রবেশকারী নেতাদের দ্বারা চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসসহ একের পর এক ঘটনা ঘটছে, যার দায় সরকার এবং আওয়ামী লীগের ওপর এসে পড়ছে। কারা কারা এ কর্মের সঙ্গে জড়িত তাদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। কোথায় এবং কার মাধ্যমে লেনদেন হয় সেসবও আছে সেই রিপোর্টে।

জানা গেছে, বলয় ভারী করতে সারা দেশে ১৪ বছরে লক্ষাধিক জামায়াত-শিবির, রাজাকার-আলবদর ও তাদের সন্তান এবং বিএনপির তৃণমূল নেতা-কর্মী ও সমর্থককে আনুষ্ঠানিকভাবে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগে যোগদান করানো হয়েছে। তাদের কারও কারও বিরুদ্ধে জমি দখল, হত্যা মামলা, ইয়াবা ব্যবসাসহ নানা অপকর্মের অভিযোগ রয়েছে। এলাকায় তারা চিহ্নিত। অতীত অপকর্ম থেকে রেহাই পাওয়া, দলের মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি, আগামী নির্বাচনে জনগণ থেকে দলকে বিচ্ছিন্ন করার টার্গেট নিয়ে তারা ক্ষমতাসীন দলে যোগ দিয়েছেন। আর কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্থানীয় একশ্রেণির জনপ্রতিনিধি নিজেদের আলাদা বলয় সৃষ্টি করতে জামায়াত-শিবির, রাজাকার-আলবদর ও তাদের সন্তান এবং বিএনপির-জামায়াত থেকে অনুপ্রবেশকারীদের দলে গুরুত্বপূর্ণ পদও দিয়েছেন। মাঠ এখন হাইব্রিডদের দখলে। দলে অনুপ্রবেশকারীদের নিয়ে অনেক আগে থেকেই সরব আওয়ামী লীগ।

অনুপ্রবেশকারীরা তৃণমূল পর্যায়ে ১০ থেকে ২০ লাখ টাকার বিনিময়ে, কেউ কেউ ৫০ লাখ থেকে কোটি টাকা দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদও কিনে নিয়েছেন। সরকারি দলে পদাধিকারী হয়ে তারা নানা অপকর্ম করে যাচ্ছেন।

সর্বশেষ খবর