আনুষ্ঠানিক প্রচার-প্রচারণা শুরু না হলেও সরগরম পাঁচ সিটি করপোরেশন এলাকা। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে গাজীপুর, সিলেট, বরিশাল, রাজশাহী ও খুলনা সিটি ভোটকে ধরা হচ্ছে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মহড়া। নির্বাচন কমিশনকে দিতে হবে নিরপেক্ষতার পরীক্ষা। আবার আওয়ামী লীগকে বিজয়ী হয়ে দিতে হবে জনপ্রিয়তা ধরে রাখার পরীক্ষা। আসন্ন এ সিটি ভোটে চ্যালেঞ্জে পড়েছেন নৌকার প্রার্থীরা। মনোনয়ন পাওয়ার পর থেকেই প্রার্থীরা ছুটে চলেছেন অবিরাম। জয়ের পথে বাধা হতে পারে দলীয় কোন্দল। টানা ১৪ বছর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকায় জেলা-উপজেলা, মহানগরে আওয়ামী লীগের কোন্দল, উপকোন্দল সৃষ্টি হয়েছে। একাধিক ধারায় বিভক্ত হয়ে পড়েছে দল। কোথাও কোথাও এমন পরিস্থিতি যেন আওয়ামী লীগই আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ।
২৫ মে গাজীপুর, ১২ জুন খুলনা ও বরিশাল এবং ২১ জুন রাজশাহী ও সিলেট সিটি করপোরেশনে ভোট গ্রহণ করা হবে। গাজীপুর সিটিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী অ্যাডভোকেট আজমত উল্লা খান, খুলনায় তালুকদার আবদুল খালেক, বরিশালে আবুল খায়ের খোকন সেরনিয়াবাত, রাজশাহীতে এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন আর সিলেটে আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী।
এসব সিটিতে বিএনপি দলীয়ভাবে ভোটে অংশ নিচ্ছে না। ভোট বর্জন করে দলটি প্রমাণ করতে চায় তাদের ছাড়া বাংলাদেশে কোনো অর্থবহ অংশগ্রহণমূলক, অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়। কিন্তু দলটির স্থানীয় নেতারা হাইকমান্ডের সিদ্ধান্তকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে প্রার্থী হয়েছেন। গাজীপুরে প্রার্থী হয়েছেন বিএনপির অঙ্গসংগঠন স্বেচ্ছাসেবক দলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত গাজীপুরের সরকার পরিবারের সদস্য সরকার শাহনূর ইসলাম রনি। তিনি বিএনপির সাবেক এমপি হাসান উদ্দিন সরকারের ভাতিজা এবং আহসান উল্লাহ মাস্টার হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কারাবন্দি নূরুল ইসলাম সরকারের ছেলে। সিটি নির্বাচনের আগে রনির চাচা হাসান সরকার ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘আওয়ামী লীগকে ফাঁকা মাঠে গোল দিতে দেওয়া হবে না। দল সিদ্ধান্ত না নিলেও এ নির্বাচনে আমরা কৌশল গ্রহণ করব।’ ভাতিজাকে প্রার্থী করার মধ্য দিয়ে তাঁর কৌশল পরিষ্কার হয়েছে। রনি সরকারের বাবা নূরুল ইসলাম সরকার ছিলেন নৌকার প্রার্থী আজমত উল্লা খানের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী। টঙ্গী পৌরসভা নির্বাচনে বারবার আজমতের কাছে পরাজিত হয়েছেন তিনি।স্থানীয়রা বলছেন, নৌকার প্রার্থী আজমত উল্লা খানের জন্য আহসান উল্লাহ মাস্টার হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কারাবন্দি নূরুল ইসলাম সরকারের ছেলে রনি সরকার যতটা না ফ্যাক্টর, তার চেয়ে বড় বাধা সাবেক মেয়র মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম। শেষ পর্যন্ত জাহাঙ্গীর মাঠে থাকলে ভোটের হিসাব পাল্টে যেতে পারে। আওয়ামী লীগের একটি বড় অংশ ওপরে নৌকা বললেও ভিতরে ভিতরে জাহাঙ্গীরের পক্ষেই তাদের অবস্থান। গাজীপুর সিটিতে স্থানীয় ভোটারের চেয়ে বিভিন্ন জেলা থেকে আগত কর্মজীবী ভোটার বেশি। তরুণ ও ভাসমান ভোটাররাও জাহাঙ্গীরের পক্ষে বলে জানা গেছে। শেষ পর্যন্ত যদি জাহাঙ্গীরকে বসিয়ে দেওয়া হয় তাহলে তিনি আজমত উল্লার বিরুদ্ধে খেলবেন তার মা জায়েদা খাতুনকে নিয়ে। বিরোধী পক্ষ না হলেও দলের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে। এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আবদুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘সিটি নির্বাচন নিয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা কাজ শুরু করেছেন। আমাদের নেত্রী নিজেও গাইডলাইন দিয়েছেন। কাজ করছি, বসে নেই। যারা প্রার্থীর বিরুদ্ধে কাজ করবে অথবা দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করবে গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এ নিয়ে বিভ্রান্ত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।’
আসন্ন পাঁচ সিটি নির্বাচনের প্রথমটি গাজীপুরে। এ নির্বাচনে সবার দৃষ্টি জাহাঙ্গীরের দিকে। কারণ গাজীপুর সিটিতে ভোটের মাঠে জাহাঙ্গীর নিজেকে সেভাবে তৈরি করেছেন বলে স্থানীয়দের দাবি। মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের সময় বাকি থাকলেও এখন পর্যন্ত গাজীপুর নিয়ে তেমন উদ্যোগ চোখে পড়েনি।
গাজীপুর নিয়ে আওয়ামী লীগ ‘গা’ ভাসালেও সিরিয়াস বরিশাল সিটিতে। এখানে মনোনয়নবঞ্চিত হয়েছেন বর্তমান মেয়র সাদিক আবদুল্লাহ। তাঁর বদলে মনোনয়ন পেয়েছেন তাঁরই চাচা আবুল খায়ের আবদুল্লাহ খোকন সেরনিয়াবাত। তবে পারিবারিক পরিমণ্ডলে তাঁরা পরস্পরবিরোধী হিসেবে পরিচিত। খোকন সেরনিয়াবাত ২০ এপ্রিল বরিশালে যান। সেখানে কয়েকজন কেন্দ্রীয় হেভিওয়েট নেতাও তাঁর সঙ্গে যান। সেখানে অনুষ্ঠিত হয় এক বিশেষ সভা। গতকালও আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, ১৪ দলের মুখপাত্র ও সমন্বয়ক আমির হোসেন আমু, দলটির প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক, পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী কর্নেল (অব.) জাহিদ ফারুক বরিশাল সিটিতে নৌকার প্রধান নির্বাচনী কার্যালয়ের উদ্বোধন করেন। তাঁরা নৌকার প্রার্থীকে বিজয়ী করতে দলীয় নেতা-কর্মীদের আহ্বান জানান।
স্থানীয় এক সূত্র জানান, মনোনয়নবঞ্চিত সাদিক আবদুল্লাহ তাঁর চাচাকে সমর্থন দিলেও মহানগর আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা কতটা দলীয় প্রার্থীর পক্ষে থাকবেন, তা নিয়ে শংশয় রয়েছে। ফলে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী ফোরামের সদস্যদের বিশেষ দৃষ্টি রয়েছে বরিশালে।
রাজশাহীতে দলের মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ডাবলু সরকার। নৌকা পাওয়া আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য খায়রুজ্জামান লিটন এখন পর্যন্ত ডাবলু সরকার কিংবা তাঁর অনুসারীদের ডাকেননি। ডাবলু সরকারের অনুসারীদের বাদ দিয়ে এককভাবে চলছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এখন পর্যন্ত বিএনপির কেউ প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা না দেওয়ায় ফুরফুরে মেজাজে রয়েছেন নৌকার প্রার্থী। লিটন মেয়র হওয়ার পর রাজশাহীতে ব্যাপক উন্নয়ন করেছেন। দলীয় কোন্দল নিরসনে কেন্দ্রও এখন পর্যন্ত উদ্যোগ গ্রহণ করেনি।
সিলেট সিটিতে নৌকার প্রার্থী প্রবাসী আওয়ামী লীগ নেতা আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী শুরু থেকেই দলীয় নেতা-কর্মী, সাধারণ ভোটারদের কাছে যাচ্ছেন। এখানে বর্তমান মেয়র বিএনপি নেতা আরিফুল ইসলাম। যদিও তিনি বলে আসছেন ভোট করবেন না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভোটের মাঠে নামলে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হবে নৌকার প্রার্থীর জন্য। কামরানের মতো জনপ্রিয় নেতাকে হারিয়ে মেয়র হয়েছিলেন আরিফ। আবার এ সিটিতে নতুন করে ১৫টি ওয়ার্ড যুক্ত হয়েছে। এ ওয়ার্ডগুলো বিএনপির ভোটব্যাংক হিসেবে পরিচিত। এ ছাড়া সিলেট শহর আওয়ামী লীগের ভোটব্যাংক তুলনামূলক অন্য সিটির চেয়ে কম। গত বুধবার সিলেটে দলীয় নেতা-কর্মীদের নিয়ে বর্ধিত সভা করা হয়। এখানে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের একজন বাদে সবাই উপস্থিত ছিলেন। অর্থাৎ চ্যালেঞ্জ থাকলেও দলীয় নেতা-কর্মীদের নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী।
খুলনায় তালুকদার আবদুল খালেককে নিয়ে একাট্টা রয়েছে স্থানীয় আওয়ামী লীগ, সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনগুলো।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী ফোরামের সদস্যরা বলছেন, এ নির্বাচনকে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে অভ্যন্তরীণ কোন্দল মেটানোর একটা প্ল্যাটফরম হিসেবে দেখছে আওয়ামী লীগ। নানা কোন্দলে জর্জরিত আওয়ামী লীগ। এ কোন্দলের কারণে দলের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ হচ্ছে আওয়ামী লীগই। তাই প্রার্থী দেওয়ার পর কারা কীভাবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং কারা বিদ্রোহী প্রার্থী হন, কারা আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধাচরণ করেন সে বিষয়গুলো হিসাবনিকাশ করবে আওয়ামী লীগ। যেটি জাতীয় নির্বাচনে কৌশল তৈরি করার ক্ষেত্রে কাজে দেবে বলে মনে করছেন আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা।