জুলাই গণ অভ্যুত্থানে গত বছর আজকের দিনে (১ আগস্ট) ছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঘোষিত ‘রিমেম্বারিং আওয়ার হিরোজ’ কর্মসূচি। মূলত আগস্ট মাস ছিল আওয়ামী সরকার ঘোষিত শোকের মাস। জুলাইয়ে ছাত্র-জনতা এ শোক প্রত্যাখ্যান করে এবং যতদিন পর্যন্ত স্বৈরাচারী সরকারের পতন না ঘটবে ততদিন পর্যন্ত জুলাই চলবে বলে ঘোষণা করে। ফলে ১ আগস্ট রূপ নেয় ৩২ জুলাইয়ে। এদিন ‘রিমেম্বারিং আওয়ার হিরোজ’ কর্মসূচি ঘিরে সারা দেশের ছাত্র-জনতা জুলাই শহীদদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে এবং গণ অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের শপথ গ্রহণ করে। এদিন হারুনের ভাতের হোটেল খ্যাত ডিবি অফিস থেকে ছাড়া পান নিরাপত্তা অজুহাতে আটকে রাখা ছয় সমন্বয়ক। ছাত্র-জনতার আন্দোলনকে গুরুত্ব না দিয়ে একই দিন নির্বাহী আদেশে জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে সরকার। পরবর্তী দিনের (৩৩ জুলাই) জন্য বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে জুলাই আহত ও শহীদদের স্মরণে ঘোষণা করা হয়- ‘প্রার্থনা ও গণমিছিল’ কর্মসূচি।
সমন্বয়ক আবদুল কাদেরের পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়- ‘ছয় সমন্বয়ককে ডিবি কার্যালয় থেকে ছেড়ে দিলেও এখনো ডাকসুর সাবেক সমাজসেবা সম্পাদক আক্তার হোসেন, সমন্বয়ক আরিফ সোহেলসহ অসংখ্য ছাত্র-জনতাকে কারাগার ও রিমান্ডে নির্যাতন করছে। গণহত্যা ও গণগ্রেপ্তারের প্রতিবাদে এবং শিক্ষার্থীদের ৯ দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে ২ আগস্ট জুমার নামাজ শেষে দোয়া, শহীদদের কবর জিয়ারত, মন্দির, গির্জাসহ সব উপাসনালয়ে প্রার্থনার আয়োজন ও ছাত্র-জনতার গণমিছিল অনুষ্ঠিত হবে। শ্রমিক, পেশাজীবী, সংস্কৃতিকর্মী, গণমাধ্যমকর্মী, মানবাধিকারকর্মী, বুদ্ধিজীবী, আলেম, সব স্তরের ওলামাসহ বাংলাদেশের নাগরিকদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি ‘প্রার্থনা ও ছাত্র-জনতার গণমিছিল’ কর্মসূচিকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সফল করে তুলুন।’
৩২ জুলাই ‘রিমেম্বারিং আওয়ার হিরোজ’ কর্মসূচিতে দেশের বিভিন্ন স্থানে বাধা দেয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় এবং গাইবান্ধা ও কুমিল্লায় পুলিশ-বিজিবির বাধায় কর্মসূচি পণ্ড হয়ে যায়। মুখে লাল কাপড় বেঁধে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে মৌন মিছিল করে ‘রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক’। এতে বিশ্ববিদ্যালয় ও নগরীর বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা অংশ নেয়। কর্মসূচি শেষে সাদা পোশাকের পুলিশ সদস্যরা কয়েক শিক্ষার্থীকে টেনেহিঁচড়ে তুলে নেওয়ার চেষ্টা করে। শিক্ষকরা তা প্রতিহত করে শিক্ষার্থীদের নিরাপদ গন্তব্যে পৌঁছে দেন।
বৃষ্টি উপেক্ষা করে যেসব স্থানে আন্দোলনকারীরা জড়ো হন, নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে তাদের ধস্তাধস্তি হয়। নারায়ণগঞ্জে অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের লাঠিপেটা করে পুলিশ। কুড়িগ্রাম সরকারি উচ্চবিদ্যালয় মাঠে মুখে লাল কাপড় বেঁধে বিক্ষোভ করেন জেলার বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা। যশোরে প্রতিবাদ কর্মসূচি করেন সংস্কৃতিকর্মী ও আইনজীবীরা। আন্দোলনে হতাহতদের স্মরণে নারায়ণগঞ্জে শিক্ষার্থীদের ‘মোমশিখা প্রজ্বলন’ কর্মসূচি পণ্ড হয়ে যায় পুলিশি বাধায়। পুলিশি বাধায় পণ্ড হয়ে যায় বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ছাত্র-শিক্ষক সংহতি সমাবেশ’। আবু সাঈদসহ সব হত্যার বিচার দাবি করে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। মৌন মিছিল করেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে সমাবেশ করেন শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। ঢাবির লোকপ্রশাসন, অর্থনীতি বিভাগ ও নিপীড়নবিরোধী শিক্ষক সমাজের ব্যানারে পৃথক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। নিপীড়নবিরোধী শিক্ষক সমাজের ব্যানারে অনুষ্ঠিত সমাবেশে আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, ‘সরকার হত্যাকাণ্ডের বিচার করবে না। কারণ তারা নিজেরাই খুনি। সরকার গণহত্যা করে ভুক্তভোগীদের গণহত্যার জন্য দায়ী করে গ্রেপ্তার করছে। খুনের বিচার করতে না পারলে, শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা দিতে না পারলে সরকারকে অবশ্যই পদত্যাগ করতে হবে।’ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার চত্বরে এদিন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে প্রতিবাদের গানের মিছিল ও সমাবেশ করেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। সাভারের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরাও এ সমাবেশে যোগ দেন। সমাবেশে জাবির দর্শন বিভাগের অধ্যাপক রায়হান রাইন বলেন, ‘ছাত্র-জনতা এখন বুলেটের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়াতে জানে। সবাই জেগে উঠেছে। ভয় সন্ত্রাসকে জয় করে এ গণ অভ্যুত্থান নিশ্চয়ই জুলুমবাজ সরকারের পতন ঘটাবে।’ এদিকে ঢাকাসহ সারা দেশে আটক সব শিক্ষার্থীকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ছেড়ে দেওয়ার আলটিমেটাম দেয় বিক্ষুব্ধ নাগরিক সমাজ। এদিন রাজধানীর মিন্টো রোডের ডিবি কার্যালয়ের সামনে অনুষ্ঠিত সমাবেশ থেকে পরদিন ৩৩ জুলাই জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে ‘দ্রোহ যাত্রা’র ডাক দেন তারা।