সোমবার, ২৬ জুলাই, ২০২১ ০০:০০ টা

হাড় ব্যথার কারণ ও প্রতিকার

ডা. মিজানুর রহমান কল্লোল

হাড় ব্যথার কারণ ও প্রতিকার
“ খনিজের ঘাটতি হলে হাড়ের ব্যথার সঙ্গে মাংসপেশি ও টিস্যুতে ব্যথা করে, ঘুমের সমস্যা হয়, পেশি কামড়ায়, অবসাদ ও দুর্বল লাগে।
অস্টিওপরোসিসে পিঠে ব্যথা করে, রোগী নুয়ে থাকে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ওজন কমে যায়। “

 

 

হাড়ের ব্যথা এক সাধারণ সমস্যা, বিশেষ করে মাঝ বয়সী বা তার বেশি বয়সের নারী-পুরুষদের জন্য। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আপনার শরীরেরও অনেক পরিবর্তন হয়। আপনার শারীরিক পরিশ্রম কমে যাওয়ার কারণে মাংসপেশির আকার ও হাড়ের ঘনত্ব কমে আসে। এতে আপনার হাতে বারবার আঘাত লাগার প্রবণতা দেখা দেয় এবং হাড় ভেঙে যায়। যদি আপনার হাড়ের ঘনত্ব কমে যাওয়ার কারণে বা হাড়ে আঘাত লাগার কারণে হাড়ে ব্যথা হতে থাকে তাহলে সেটা এক বড় ধরনের সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। এসব ক্ষেত্রে দ্রুত চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। যদি আপনার হাড়ের ব্যথার কোনো ব্যাখ্যা খুঁজে না পান তাহলে ব্যাপারটা উপেক্ষা করবেন না। চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন এবং ব্যথার কারণ বের করুন। এছাড়া অনেক কারণে হাড়ে ব্যথা হতে পারে-

ইনজুরি : ইনজুরি বা আঘাত হাড়ে ব্যথার সাধারণ কারণ। সাধারণত আঘাত থেকে গাড়ি অ্যাক্সিডেন্ট বা পড়ে যাওয়া থেকে ব্যথা হতে পারে। হাড়ে যে কোনো ধরনের ক্ষতি হলে হাড় ব্যথা করতে পারে।

খনিজের ঘাটতি : আপনার হাড় শক্তিশালী করতে বিভিন্ন ধরনের খনিজ ও ভিটামিন, বিশেষ করে ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন-ডি এর প্রয়োজন হয়। ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন-ডি এর অভাবে সচরাচর হাড়ের ভঙ্গুর রোগ অস্টিওপরোসিস হয়। অস্টিওপরোসিস হাড়ের খুব সাধারণ রোগ। অস্টিওপরোসিসের শেষ স্তরে হাড়ে ব্যথা হয়।

ছড়িয়ে পড়া ক্যান্সার : শরীরের এক স্থানের ক্যান্সার অন্য স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। স্তন, ফুসফুস, থাইরয়েড, কিডনি ও প্রোস্টেটের ক্যান্সার সাধারণত হাড়ে ছড়িয়ে পড়ে।

হাড়ের ক্যান্সার : হাড়ের ক্যান্সার হাড়েই উৎপন্ন হয়। হাড়ের স্বাভাবিক গঠন ধ্বংসের মাধ্যমে এটা হাড়ে ব্যথা ঘটাতে পারে।

হাড়ে রক্ত সরবরাহ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী রোগ : কিছু রোগ যেমন সিকেল সেল এনিমিয়া হাড়ে রক্ত সরবরাহে বাধা দেয়। রক্ত সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেলে হাড়ের টিস্যু মারা যেতে শুরু করে। আর এর ফলে হাড়ে মারাত্মক ব্যথা হয় ও হাড় দুর্বল হয়ে পড়ে।

লিউকেমিয়া : লিউকেমিয়া হলো অস্থিমজ্জার ক্যান্সার। অধিকাংশ হাড়ে অস্থিমজ্জা থাকে এবং এটা হাড়ের কোষ তৈরি করে। লিউকেমিয়ার রোগীদের হাড়ে বিশেষ করে পায়ে ব্যথার অভিজ্ঞতা ঘটে।

উপসর্গ : হাড়ের ব্যথার সবচেয়ে লক্ষণীয় উপসর্গ হলো- বসে থাকলে বা নড়াচড়া করলে অস্বস্তি লাগে। অন্য উপসর্গগুলো নির্ভর করে আপনার হাড়ের ব্যথার নির্দিষ্ট কারণগুলোর ওপর। ইনজুরির ক্ষেত্রে যে হাড়ে ব্যথা হয় সেখানে আরও কিছু উপসর্গ থাকে যেমন স্থানটি ফুলে যাওয়া, দৃশ্যমান ভাঙা বা অঙ্গবিকৃতি, আঘাতের স্থানে কট করে শব্দ হওয়া ইত্যাদি। * খনিজের ঘাটতি হলে হাড়ের ব্যথার সঙ্গে মাংসপেশি ও টিস্যুতে ব্যথা করে, ঘুমের সমস্যা হয়, পেশি কামড়ায়, অবসাদ ও দুর্বল লাগে। * অস্টিওপরোসিসে পিঠে ব্যথা করে, রোগী নুয়ে থাকে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ওজন কমে যায়। * ছড়িয়ে পড়া বা মেটাস্ট্যাটিক ক্যান্সারে বিস্তৃত উপসর্গ থাকে যা নির্ভর করে ক্যান্সারটি কোথায় হয়েছে তার ওপর। এ ক্ষেত্রে মাথাব্যথা, বুকে ব্যথা, হাড় ভেঙে যাওয়া, খিঁচুনি, মাথাঘোরা, জন্ডিস, ছোট ছোট শ্বাস ফেলা, পেট ফুলে যাওয়া ইত্যাদি উপসর্গ থাকে। * হাড়ের ক্যান্সারে হাড়ভাঙা বেড়ে যায়, ত্বকের নিচে পি- অনুভব করা যায়, টিউমারটি নার্ভে চাপ দিলে অসাড় বা ঝিনঝিন অনুভূতি হয়। * হাড়ে রক্ত সরবরাহ কমে গেলে জয়েন্টে ব্যথা হয়, জয়েন্ট কাজ করে না, জয়েন্ট দুর্বল হয়ে যায়। * ইনফেকশনের ক্ষেত্রে ইনফেকশনের স্থানটি লাল হয়ে যায়, ফুলে যায়, গরম হয়ে যায়, অঙ্গ নড়াচড়া করতে সমস্যা হয়, বমি বমি ভাব হয়, ক্ষুধামন্দা দেখা দেয়। গর্ভাবস্থায় হাড়ে ব্যথা : অনেক গর্ভবতী মহিলার পেলভিক বা শ্রোণির হাড়ে ব্যথা হওয়া একটি সাধারণ ঘটনা। এ ব্যথা কখনো কখনো গর্ভাবস্থা সম্পর্কিত শ্রোণিচক্রে স্থানান্তরিত হয়। উপসর্গের মধ্যে রয়েছে- পিউবিক হাড়ে ব্যথা এবং পেভিক জয়েন্টগুলো শক্ত হয়ে যাওয়া ও ব্যথা করা। বাচ্চা প্রসব না হওয়া পর্যন্ত ব্যথা যায় না। অবশ্য প্রাথমিক চিকিৎসা নিলে উপসর্গ কমে যায়। চিকিৎসার মধ্যে রয়েছে- জয়েন্টগুলো সঠিকভাবে নাড়াচাড়া করা, ফিজিক্যাল থেরাপি, ব্যায়াম, তলপেটের ব্যায়াম।

হাড়ের ব্যথা কীভাবে নির্ণয় করবেন?

সঠিক চিকিৎসার জন্য হাড়ের ব্যথার কারণ নির্ণয় করা প্রয়োজন। হাড়ে ব্যথার নির্দিষ্ট কারণের চিকিৎসা করলে আপনার ব্যথাও কমে যাবে। আপনার চিকিৎসক আপনার শারীরিক পরীক্ষা করবেন, আপনার সমস্যার ব্যাপারে বিস্তারিত জিজ্ঞেস করবেন। সাধারণ প্রশ্নের মধ্যে রয়েছে- আপনার ব্যথা কোথায় হয়? প্রথম কবে ব্যথা শুরু হয়েছিল? ব্যথা কি খুব খারাপ অবস্থায় যায়? হাড়ে ব্যথার সঙ্গে কি অন্য কোনো উপসর্গ রয়েছে? আপনার চিকিৎসক আপনার ভিটামিনের ঘাটতি দেখার জন্য রক্ত পরীক্ষা দিতে পারেন, ক্যান্সার আছে কিনা নিশ্চিত হওয়ার জন্য ক্যান্সার মার্কার পরীক্ষা দিতে পারেন। রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে চিকিৎসক আপনার ইনফেকশন ও এড্রেনাল গ্রন্থির অস্বাভাবিকতা সম্পর্কে জানতে পারেন যা আপনার হাড়ের স্বাস্থ্যে বাধা প্রদান করে। চিকিৎসক আপনার হাড়ের এক্স-রে, এম আর আই এবং সিটি স্ক্যান দ্বারা ইনজুরি হাড়ের ক্ষত এবং হাড়ের মধ্যকার টিউমার দেখতে পারেন। মাল্টিপল মায়োলোমাসহ অস্থিমজ্জার মধ্যকার অস্বাভাবিকতা নির্ণয় করার জন্য প্রস্রাব পরীক্ষা করা যেতে পারে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে চিকিৎসক আপনার হাড়ের ব্যথার সঠিক কারণ নির্ণয়ের জন্য আরও বেশ কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে দিতে পারেন।

হাড়ের ব্যথায় কী চিকিৎসা দেবেন?

চিকিৎসক হাড়ের ব্যথার কারণ নির্ণয় করার পর সেই কারণ অনুযায়ী চিকিৎসা করবেন। আক্রান্ত স্থানটি যতটা সম্ভব বিশ্রামে রাখতে হবে। মাঝারি থেকে তীব্র ব্যথা উপশমের জন্য ব্যথানাশক ওষুধ গ্রহণ করা যেতে পারে।

ইনফেকশন সন্দেহ হলে চিকিৎসক আপনাকে অ্যান্টিবায়োটিক প্রদান করতে পারেন। ওষুধের পুরো কোর্স শেষ করবেন। এমনকি আপনার উপসর্গ চলে যাওয়ার পরেও কিছুদিন পর্যন্ত প্রদাহ কমাতে সাধারণভাবে কর্টিকোস্টেরয়েড ব্যবহার করা হয়। 

কখন ডাক্তার দেখাবেন: মারাত্মক অবস্থার কারণে হাড়ে ব্যথা হতে পারে। এমনকি কোনো জরুরি অবস্থাও হাড়ে মৃদু ব্যথার কারণ হতে পারে। যদি আপনার হাড়ে খুব ব্যথা করে এবং কয়েকদিনে ব্যথা ভালো না হয় তাহলে আপনার চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলুন। এসব বিষয়ে অবহেলা ঠিক নয়।

লেখক : ভাইস প্রিন্সিপাল, ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ।

 

সর্বশেষ খবর