রবিবার, ২৬ অক্টোবর, ২০১৪ ০০:০০ টা
দখল-দূষণ

বিলীন হচ্ছে গুলশান লেক

বিলীন হচ্ছে গুলশান লেক

ডিসিসি, রাজউক, ওয়াসা ও পরিবেশ অধিদফতরের সমন্বয়হীনতায় দখল আর দূষণে অস্তিত্ব বিলীনের পথে গুলশানের নয়নাভিরাম লেক। দায়িত্বে থাকা এসব বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চরম উদাসীনতাই বিলীনের জন্য দায়ী বলে মনে করছেন লেকের আশপাশে বসবাসকারীরা। গুলশান নিকেতনের নয়নাভিরাম এই লেক এলাকা এখন অপরাধীদের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। লেকপাড়ে দিনের বেলায়ও কেউ চলাফেরা করার সাহস পাচ্ছেন না। লেকের পাশ দিয়ে যাতায়াতকারী সাধারণ মানুষ নিরাপত্তাহীন পরিবেশে ছিনতাই-রাহাজানির শিকার হচ্ছেন প্রতিনিয়ত। এ ছাড়া আছে মাদকাসক্তদের বখাটেপনা আর ভ্রাম্যমাণ যৌনকর্মীদের অবাধ দৌরাত্ম্য। ময়লা, আবর্জনা, নর্দমা ও স্যুয়ারেজের বর্জ্য মিশে লেকের পানিকেও বিষাক্ত করে তুলেছে। এতে পানির রংও পাল্টে গেছে। পানির সাধারণ রং এখন কালো ধারণ করেছে। লেকের দুর্গন্ধে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে জনজীবন। পরিবেশ অধিদফতর ইতিমধ্যে লেকটিকে ‘প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা’ বলে ঘোষণা দিলেও বিপন্নতা রোধে নেওয়া হচ্ছে না কার্যকর পদক্ষেপ। ঠেকানো যাচ্ছে না জবরদখল। লেকের পানিতে ময়লা, আবর্জনা, কাপড়ের টুকরা, বিভিন্ন ফোম ও শলাজাতীয় ময়লা, হাঁস-মুরগির বিষ্ঠা, কুকুর-বিড়ালের মৃতদেহ ভাসতে দেখা যায়। কড়াইল বস্তি-সংলগ্ন লেকপাড় ঘেঁষে অর্ধশতাধিক খোলা ল্যাট্রিনও রয়েছে। স্থানীয় কাঁচাবাজারগুলোর ময়লা-আবর্জনাও ফেলা হচ্ছে লেকে। পাহারা বসিয়েও এসব রোধ করা যাচ্ছে না। লেকপাড়ের সাধারণ মানুষ জানান, মুক্ত বাতাস পেতে রাজধানী ঢাকার অনেক এলাকার মানুষ গুলশান লেকপাড়ে ছুটে আসেন। কিন্তু এই সুযোগটুকু যদি কেড়ে নেওয়া হয় তাহলে অবশিষ্ট আর কী-ই বা থাকে। এদিকে লেক রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা সেবা সংস্থাগুলো দেখেও না দেখার ভান করে আছে বলে জানান স্থানীয়রা। লেক উন্নয়নের নামে লুকোচুরি খেলা বলতে গেলে অঘোষিত নিয়মে পরিণত হয়েছে। পানিতে বাঁশের খুঁটি গেড়ে, ঘর বানিয়ে একশ্রেণির লোকজন রীতিমতো লেক দখলের প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছে। মাঝেমধ্যে উদ্ধারকাজ চললেও বন্ধ হচ্ছে না দখল ও দূষণের মাত্রা। উচ্চ আদালত থেকে লেক দখল ও দূষণমুক্ত রাখতে একাধিকবার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে সতর্ক করা হলেও আদালতের নির্দেশনা কার্যকর হচ্ছে না। হঠাৎ করেই লোক-দেখানো উচ্ছেদ অভিযান ও আবর্জনা পরিষ্কারের কাজ চালানো হয়। কিছুদিন পরই গুলশান লেকের চিত্র হয়ে যায় ব্যাক টু দ্য প্যাভিলিয়নের মতো। রাজধানীর এই নয়নাভিরাম লেকটির পূর্ব পাশ দিয়ে একটি সড়ক নির্মাণ করার কথা থাকলেও কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। হাতিরঝিল প্রকল্পের সঙ্গে সঙ্গে এই সড়কটির কাজ শেষ করার কথা ছিল। খোঁজ নিয়ে যানা যায়, লেকেরপাড় দিয়ে সড়ক নির্মাণের জন্য যে জায়গাটুকু দরকার, তা দখল করে রেখেছে কতিপয় প্রভাবশালী। তারা এখন সরকারি এ কাজের জন্য জায়গা ছাড়ছে না। অন্যদিকে হাতিরঝিল প্রকল্পের সঙ্গে সংযোগ হিসেবে একটি সেতু নির্মাণ কার্যক্রম চলছে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন বিপন কুমার সাহা বলেন, গুলশান এলাকা থেকে প্রতিদিন প্রায় ১০০ টন বর্জ্য অপসারণ করা হয়। বর্জ্য অপসারণে চারটি কনটেইনারের পাশাপাশি একটি সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশন রয়েছে। নিয়মিত কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি মাঝেমধ্যে বিশেষ পরিচ্ছন্নতা অভিযানও চালানো হয় বর্জ্য অপসারণে। সরেজমিন দেখা গেছে, লেকের কড়াইল বউবাজার অংশে অনেকটা ফ্রি-স্টাইলে লেকের পাড় দখল চলছে। লেকের নতুন জায়গাসহ উচ্ছেদ করা অংশে বাঁশের খুঁটি গেড়ে টিনের ছাউনি দিয়ে দুই শতাধিক ঘর তুলেছে দখলকারীরা। কড়াইল গুদারাঘাটে টংঘরের সংখ্যা এখন দেড় শতাধিকের মতো। পাকা ঘাটের লেকপাড়ে রয়েছে অর্ধশতাধিক টংঘর। এ ছাড়া চামেলীর মার ঘাট ও মোমিনের ঘাটে শতাধিক টংঘর গড়ে উঠেছে। কড়াইল ঘাট, গুলশান ৩৩, ৩৪ ও ৩৫ নম্বর রোডের মাথায় রাজউকের উচ্ছেদ করা অংশ ইতিমধ্যে আবার দখল হয়ে গেছে। কড়াইল বস্তি-সংলগ্ন লেকের পাড় ঘেঁষে অর্ধশতাধিক খোলা ল্যাট্রিন করা হয়েছে। রাজধানীর লেকগুলোর অন্যতম নিয়ন্ত্রক সংস্থা ঢাকা সিটি করপোরেশন (ডিসিসি)। রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে আছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। আর পয়োনিষ্কাশনের দেখভাল করে থাকে ঢাকা ওয়াসা। অন্যদিকে লেক ও সংলগ্ন এলাকার পরিবেশ বিপর্যয় রোধে রয়েছে পরিবেশ অধিদফতর। লেক এলাকার বাসিন্দাদের অভিযোগ, এ চারটি সংস্থার কেউই তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করছে না। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের সভাপতি আবু নাসের খান জানান, রাজধানীর হৃৎপিণ্ড হিসেবে বিবেচিত লেকগুলো যে কোনো মূল্যে উদ্ধার ও দূষণমুক্ত করতে হবে। তিনি বলেন, যারা দখলকারী তারাই দূষণ করে চলেছেন। বাংলাদেশ প্রতিদিনের অনুসন্ধানে গুলশান-নিকেতন লেক সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে এ বিপর্যয়কর পরিস্থিতি। দখল-দূষণে এখন নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে গুলশান-নিকেতনের মনোমুগ্ধকর লেক। পার্শ্ববর্তী ভবন, বাড়িঘর, অফিসের স্যুয়ারেজ সংযোগ সরাসরি লেকে স্থাপন করা হয়েছে। শাহজাদপুরে লেকের অংশ ভরাট করে তৈরি করা হয়েছে কয়েক শ’ টিনশেড। ভরাট জমিতে গড়ে তোলা হয়েছে একাধিক বস্তি। গুলশান ৩১, ৩২ ও ৩৩ নম্বর সড়কের পাশে মাটি ফেলে ভরাট হচ্ছে লেক। দখলকারী চক্র কয়েক বছরে গুলশান ও বারিধারা লেকের মহামূল্যবান ৪০ থেকে ৫০ একর জমি দখল করে নিয়েছে। শাহজাদপুরের একাধিক বাসিন্দা জানান, রাজউকের কিছু অসাধু কর্মকর্তা লেকের জায়গা প্রভাবশালীদের দখলে দিয়েছেন। কিন্তু লেকের পূর্ব পাড়ের কিছু জায়গা, যা সরকারি নয়, প্রকৃত জোত, সেসব জায়গার নকশা ঘষামাজা করে তা দখলে নেওয়ার পাঁয়তারা করছেন প্রভাবশালীরা।

সর্বশেষ খবর